"পান্না কায়সার দুঃখের মধ্য দিয়ে যে জীবন পার করেছেন, সেই দুঃখ থেকেই আবার শক্তি আরহণ করে সামনে এগিয়ে চলেছেন।”
Published : 04 Aug 2023, 04:18 PM
লেখক, শিশু সংগঠক, শহীদজায়া পান্না কায়সারের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে দেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা তাকে স্মরণ করছেন একজন লড়াকু মানুষ হিসেবে, যার সংগ্রামী জীবন অনুপ্রাণিত করেছে বহু মানুষকে, বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া নারীদের।
শুক্রবার সকালে ঢাকার বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে পান্না কায়সারকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা পান্না কায়সার শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী। তিনি অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা।
বদরুন্নেসা কলেজের সাবেক এই শিক্ষক তার লেখার জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। জীবনভর যুক্ত থেকেছেন শিশু সংগঠন খেলাঘর এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর সঙ্গে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি।
সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী, অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর ছাত্রজীবন থেকেই পান্না কায়সারকে চিনতেন। পান্না কায়সারের জীবনে ঘটে যাওয়া একের পর এক বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো তিনি দেখেছেন কাছ থেকে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নূর বলেন, "তখন আমি বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। শহীদুল্লা কায়সার তখন সংবাদ পত্রিকায় কাজ করতেন। আমরা প্রায়ই তার সাথে দেখা করতে যেতাম। ধীরে ধীরে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তখন পান্না ভাবীর সাথেও আমাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
"মুক্তিযুদ্ধে শহীদুল্লা কায়সার শহীদ হলেন, তারপর থেকে পান্না ভাবি যে লড়াই করেছেন এবং লেখালেখি করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, সেটি অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে নারীদের। পিছিয়ে পড়া নারীরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন পান্না কায়সারকে দেখে।"
মাস ছয়েক আগে পান্না কায়সারের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছিল জানিয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, "একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। দেখেছিলাম, শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। বিভিন্ন সময় উনার মেয়ে শমীর সাথে দেখা হলেও মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতাম।
“পান্না কায়সার সম্পর্কে বলব, একজন লড়াকু মানুষ। যিনি অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।"
১৯৫০ সালের ২৫ মে পান্না কায়সারের জন্ম। তার পারিবারিক নাম সাইফুন্নাহার চৌধুরী। কলেজে পড়ার সময় ঢাকায় এক উচ্চবিত্ত পরিবারে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির অমানবিক পরিবেশ তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসে ফের পড়ালেখায় মন দেন পান্না। এইচএসসি পাস করে কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি নেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন বাংলায় মাস্টার্স করতে।
সে সময়ই পরিচয় হয় তরুণ বুদ্ধিজীবী, লেখক শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল এক দিনে কারফিউয়ের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়।
কিন্তু আড়াই বছরের মাথায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে স্বামীকে হারান পান্না কায়সার। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আলবদর বাহিনীর কিছু সদস্য শহীদুল্লা কায়সারকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। তার আর ফেরা হয়নি।
এরপর থেকে পান্না কায়সার একাই মানুষ করেছেন তার দুই সন্তান শমী কায়সার এবং অমিতাভ কায়সারকে।
ঢাকার মঞ্চ নাটক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ রামেন্দু মজুমদার বলেন, "পান্না কায়সার দুঃখের মধ্য দিয়ে যে জীবন পার করেছেন, সেই দুঃখ থেকেই আবার শক্তি আরহণ করে সামনে এগিয়ে চলেছেন।
“তার সামনে এগিয়ে যাওয়া দেখে অনেক নারী অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তার লেখা এবং সংগ্রামী জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি শিশুদের নিয়ে সংগঠন করেছেন। অনেক প্রতিকূল পরিবেশেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেছেন।"
শহীদুল্লা কায়সারের চাচাতো ভাই ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের ভাষায়, পান্না কায়সার ছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ‘অন্যতম বাতিঘর’।
“স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন পান্না কায়সার। উদীচী, খেলাঘরের সাথে তিনি যুক্ত থেকে আমাদের পথ দেখিয়েছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিতে।"
শাহরিয়ার কবির বলেন, "পান্না কায়সার তো কেবল শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পরিচয় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি। নিজের মেধার দ্যুতিও ছড়িয়েছেন। তিনি লেখক এবং সংগঠক হিসেবেও আলাদাভাবে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী, শহীদ জায়া পরিচয়টিও আমাদের কাছে বিশেষ সম্মানের।"
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, তার কাছে পান্না কায়সার ছিলেন ‘বিশেষ সম্মানীয় এবং সংগ্রামী’ একজন মানুষ, যার লেখা নারীদের এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছে। বাংলাদেশকে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছে।
"আমাদের ঢাকা থিয়েটার, গ্রাম থিয়েটারের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের প্রায় অনুষ্ঠানে আসতেন। শেষ কয়েক বছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনেক জায়গায় সরব দেখা যায়নি। আমরা থিয়েটারের প্রয়োজনে যখনই তার কাছে গেছি, তিনি কখনো না বলতেন না। আমাদের সকল আবদারে তিনি হ্যাঁ বলতেন। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তাকে কাছে পেয়েছি। প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তাকে পেয়েছি।"
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, "স্বাধীনতার ৫১ বছরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সাথে কখনো আপস করেননি পান্না কায়সার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে এগিয়ে গেছেন। গণজাগরণ মঞ্চেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তার মৃত্যু আমাদের জন্য অপরুণীয় ক্ষতি।"
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, "পান্না কায়সার অল্প বয়সেই বিধবা হয়েছেন। তার স্বামী শহীদুল্লা কায়সার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, এটা আমরা সবাই জানি। মুক্তিযুদ্ধের পর তার যে লড়াই এবং সেই লড়াইটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করবার। সেই লড়াইয়ের জন্য জাতি তাকে মনে রাখবে। তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।"
শিশু কিশোরদের সংগঠন খেলাঘরের সঙ্গে আজীবন সক্রিয় ছিলেন পান্না কায়সার। ১৯৭৩ সাল থেকে ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য। আর ১৯৯০ সালে এ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন।
খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রণয় সাহা বলেন, "শিশুদের ভীষণ ভালোবাসতেন পান্না কায়সার। শিশুরাও তাকে আপন করে নিত সহজে।”
প্রণয় সাহা জানান, শুক্রবার সকালে খেলাঘরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ছিল, পান্না কায়সার নিজেই সে সভা ডেকেছিলেন।
“এখানে সারা দেশ থেকে খেলাঘরের নেতৃবৃন্দ এসেছেন। সবাইকে ডেকে উনিই চলে গেলেন অনন্তলোকে। আমরা পান্না কায়সারের পরিবারের সাথে আলাপ করে খেলাঘর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কিছু কর্মসূচি নেব এবং সবাইকে পরে বিস্তারিত জানাব।"
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, জুমার নামাজের পর গুলশানের আজাদ মসজিদে পান্না কায়সারের জানাজা হয়েছে। আসরের পর ইস্কাটনে তার বাড়ির কাছে আরেক দফা জানাজা হবে।
এরপর মরদেহ বারডেম হাসপাতালে রাখা হবে। রোববার বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার কফিন রাখা হবে সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে আরেক দফা জানাজা হবে। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শায়িত হবেন শহীদজায়া পান্না কায়সার।