“প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ডের নামান্তর বলে আমরা মনে করি। কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হলে আমরা তা মেনে নেব না,” বলছেন বিবৃতিদাতারা।
Published : 02 Apr 2024, 08:12 PM
ঢাকায় বহুতল ভবন থেকে ‘পড়ে’ শিশু গৃহকর্মী প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ‘স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও দ্রুত’ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন দেশের ১১৭ নাগরিক।
মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা ‘দোষী’ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার স্বাক্ষরে পাঠানো ওই বিবৃবিতে বলা হয়, “প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ডের নামান্তর বলে আমরা মনে করি। কোনো প্রভাবশালী মহলের চাপে তদন্তকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হলে আমরা তা মেনে নেব না।”
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বহুতল ভবনের আট তলা থেকে পড়ে প্রীতি উরাং নামের ওই শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়। ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় গৃহ সহায়ক হিসেবে ছিল সে।
ভবনের নিচে তার লাশ মেলার পর স্থানীয়রা ‘প্রীতিকে হত্যা করা হয়েছে’ অভিযোগ করে এলাকায় বিক্ষোভ করেন। প্রীতির বাবা লোকেশ উরাং পরদিন মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার এখন ওই মামলায় কারাগারে আছেন।
এর আগে ২০২৩ সালের ৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকে পড়ে যায় ৭ বছর বয়সী শিশু গৃহশ্রমিক ফেরদৌসী। প্রাণে বাঁচলেও তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়।
ওই ঘটনায় মামলা হলেও সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেছেন ২ লাখ টাকায় আপসরফার মাধ্যমে।
মঙ্গলবার শামসুল হুদার পাঠানো ১১৭ নাগরিকের বিবৃতিতে বলা হয়, “বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পারি, গত ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ তারিখ ঢাকার মোহম্মদপুরে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্যা ডেইলি স্টার’-এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ১৩ বছর বয়সী শিশু (সাত বছরে স্কুল ছাড়ার বিবেচনায়) প্রীতি উরাং কর্মরত ছিল। অভিযোগ রয়েছে আশফাকুল হকের স্ত্রী তানিয়া হক প্রায়ই তার বাসায় কর্মরত গৃহকর্মীদের মারধর করতেন। সর্বশেষ প্রীতিকে আট তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
“প্রীতির বাবা অভিযোগ করেছেন, ওই গৃহে কাজ করার সময় সৈয়দ আশফাকুল হকের পরিবার প্রীতিকে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিত না। শিশুটি পড়ে যাবার আগে প্রায় ১৩ মিনিট ঝুলে ছিল এবং বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু আশফাকুল হকের বাসা থেকে কেউ তাকে সাহায্য করেনি। আশপাশের মানুষজন সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে চাইলেও ওই বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “শিশুটি পড়ে যাওয়ার পরে ওই বাড়ির কেয়ারকেটার তাকে হাসপাতালে ফেলে চলে আসে। পরে সে মারা যায়। লক্ষ্যণীয় হলো, প্রীতির প্রাক-স্কুলের নথি এবং ওই ফ্ল্যাটের ওই সময়ের সিসি টিভি ফুটেজ দুটোই গায়েব হয়ে গেছে। এটাও লক্ষ্যণীয়, এজাহারে প্রীতির বয়স ১৩ বছরের বদলে ১৫ বছর বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে একে অবহেলাজনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”
বিবৃতিদাতারা বলছেন, “সৈয়দ আশফাকুল হকের ওই ফ্ল্যাট থেকে ২০২৩ তারিখের ৬ আগস্ট ৭ বছরের আরো একজন গৃহকর্মী পড়ে গিয়েছিল বা লাফ দিয়েছিল। সে বেঁচে আছে। তার মেডিকেল রিপোর্টে উল্লেখ আছে, তার জননাঙ্গের গভীর থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত ৩-৩-৩ সেন্টিমিটার দীর্ঘ-চওড়া-গভীর ক্ষত রয়েছে। তার জননাঙ্গে অপারেশন করা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, পড়ে যাবার আগেই সে দু’পায়ের মাঝে আঘাত পেয়েছিল। সেকারণে সে মরে যেতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে ওই শিশুটির পরিবারের সঙ্গে ২ লাখ টাকায় বিষয়টির আপসরফা হয়েছে। যদিও টাকা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে চলে গেছে।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী লেখক ও গবেষক প্রিসিলা রাজ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিলসহ কয়েকজন সম্প্রতি প্রীতি উরাং-এর পরিবার ও গুরুতর আহত আরেক শিশুর বাড়ি গিয়ে তার সাথে কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে তারাও একই ধরনের কথা বলেছেন।
প্রীতির মৃত্যুর ১০ দিন পর ডেইলি স্টারের সম্পাদকের দেওয়া বিবৃতির প্রসঙ্গ ধরে ১১৭ নাগরিকের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “ডেইলি স্টারের উচিত ছিল ঘটনার পরপরই তাকে (আশফাকুল হক) সুরক্ষা দেওয়ার স্থলে অব্যাহতি দেওয়া, তাহলে সম্পাদকের বক্তব্য কিছুটা হলেও অর্থবহ হত।”
সে সময় আশফাকুল হকের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিলেও মঙ্গলবার ১১৭ নাগরিকের বিবৃতি আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ডেইলি স্টার এক প্রতিবেদনে তাদের নির্বাহী সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানায়। তবে ডেইলি স্টার এর কারণ ব্যাখ্যা করেনি।
১১৭ নাগরিকের বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কৃর্তপক্ষের উদাসীনতা এবং তদন্ত প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান অবহেলায় আমরা তীব্র ক্ষোভ এবং নিন্দা জানাচ্ছি।
“দেশের সকল সংবাদমাধ্যমের সম্মানিত সম্পাদকদের কাছে, এই মহান পেশার নিরপেক্ষতা ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবার ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখার আহবান জানাচ্ছি। আমরা বলিষ্ঠ কণ্ঠে এ ঘটনার নিরপেক্ষ স্বাধীন ও সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।”
বিবৃতিতে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে বেশ কিছু দাবিও তুলে ধরা হয়।
প্রীতি উরাংসহ পূর্বের সকল ঘটনার পুনঃতদন্ত করে দ্রুত দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রীতি উরাংয়ের মৃত্যুকে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা না করে এ মামলা অবিলম্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে।
প্রীতির পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। সেইসাথে তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
মৃতবৎ অবস্থায় যে শিশুটি বেঁচে আছে তার যথোপযুক্ত চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
শিশুটির শরীরের বিশেষ ক্ষতটি পরীক্ষা করে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করতে হবে।
সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় ৩ জন শিশু গৃহসহকারী ছিল। তারা ৭, ৮ এবং ১১ বছর বয়সে কাজে যোগ দেয়। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তি শিশু। শ্রম আইনের ৩৪ ধারা অনুয়ায়ী, কোন শিশুকে কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। সৈয়দ আশফাকুল হক কিংবা তার পরিবারের কোন সদস্য শিশু যৌন নিপীড়ক কিনা সে বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ তদন্তের দাবি জানাচ্ছি আমরা।
যে দারোয়ানরা প্রীতিকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে দেয়নি, তাদেরকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির, মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধাপক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না রয়েছেন বিবৃতিদাতাদের মধ্যে।
আরো রয়েছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধাপক মানস চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কণা, সামিনা লুৎফা নিত্রা, গীতি আরা নাসরিন, দিপ্তী দত্ত, খায়রুল ইসলাম চৌধুরী, লেখক ও গবেষক প্রিসিলা রাজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল, লেখক রেহনুমা আহমেদ, সাংবাদিক সাঈদিয়া গুলরুখ, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন।
এছাড়া জনউদ্যোগের আহ্বায়ক ডা. মুশতাক হোসেন, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক ফাল্গুনী ত্রিপুরা, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি বিচিত্রা তির্কী, শিল্পী মুনেম ওয়াসিফ, লেখক ও অনুবাদক ওমর তারেক চৌধুরী, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক মৃ, সংগীত শিল্পী ফারাজানা ওয়াহিদ সায়ান, রাঙামাটির চাকমা রানী য়েন য়েন বিবৃতিতে সই করেন।