“চ্যালেঞ্জটা হল সেটা পরিকল্পিতভাবে করা, যাতে অন্তত কৃষি জমি যতটুকু পারি রক্ষা করা যায়।”
Published : 13 Jan 2024, 11:53 PM
সরকার বাংলাদেশেকে উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার যে লক্ষ্য ধরে এগোচ্ছে, রাজধানী ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ না হলে, শহরগুলোকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে না পারলে, সেই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না বলে মনে করেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেছেন, “মাথাপিছু আয় বাড়াতে গেলে, উন্নত মধ্যম আয়ে যেতে হলে আমাদের নগরায়ন, শিল্পায়ন করতেই হবে।… চ্যালেঞ্জটা হল সেটা পরিকল্পিতভাবে করা, যাতে অন্তত কৃষি জমি যতটুকু পারি রক্ষা করা যায়। যত্রতত্র আবাসন তৈরি না করে পরিকল্পিতভাবে করে যাতে আমরা শহরগুলোকে বাসযোগ্য করতে পারি।”
শনিবার ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ন: সমস্যা ও সমাধান’ বিষয়ক এক বিশেষ সম্মেলনে সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক ঢাকার কেআইবি মিলনায়তনে এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, যে কোনো শহরে জন ঘনত্বের একটা সুবিধা পাওয়া যায়। সেটাকে বলে ‘বেনিফিট অব একোমোডেশন’। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কাছাকাছি থাকলে নাগরিকরা সুবিধা পায়।
“কিন্ত সেই ঘনত্ব বেশি বেড়ে গেলে তৈরি হয় ডিজঅ্যাডভান্টেজ অব কনজেশন। এবং সেটাই আমরা সবাই দেখতে পাই। ঢাকায় সুবিধার থেকে অসুবিধা অনেক বেশি হয়ে গেছে সেটা আমরা সবাই অনুভব করি।”
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঢাকায় নগরবাসীর যে মাথাপিছু আয়, সেই আয়ে এত জনবহুল একটি শহরের নাগরিকদের চাহিদা অনুযায়ী সুযোগ সুবিধার অর্থায়ন করা সম্ভব না। সে কারণে সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হয়। এই চক্র ভাঙার জন্যও ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার।
“আমরা ঢাকায় যতই উড়াল সেতু বানাই, এলিভেটেড সেতু বানাই, তাতে কোনো লাভ হবে না। আসল সমস্যা হল এত ছোট জায়গায়… আমাদের নতুন নগরায়ন, শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নাই।”
আর সেজন্য কেবল ঢাকা নয়, দেশের সব শহরের দিকেই মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তিনি বলেন, ছোট শহরগুলো ঢাকার থেকেও বেশি ‘অবাসযোগ্য’ হয়ে পড়েছে। ছোট শহরগুলোর অবস্থার উন্নতি করতে না পারলে ঢাকার ওপর চাপ কমানো যাবে না।
“টেকসই নগরায়ন মানে হল পরিবেশবান্ধব নগরায়ন। সেটা এমন হতে হবে, যাতে আমাদের পল্লি অঞ্চলগুলোকে রক্ষা করতে পারি, কৃষি জমিগুলোকে যতদূর সম্ভব রক্ষা করতে পারি। এবং পুরো দেশকে পরিবেশবান্ধব নগরায়নের দিকে যেতে হবে, শুধু ঢাকা শহর নয়। ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।”
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ঢাকায় যেমন অপরিকল্পিত নগরায়ন হয়েছে, বর্তমানে গ্রামগুলোও একইরকম অপরিকল্পিত নগরায়নের দিকে যাচ্ছে।
“এখনই সময় গ্রামগুলোর পরিবেশবান্ধব নগরায়নের জন্য পরিকল্পনা করার। স্থায়ীত্বশীল নগরায়নের জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরের সুবিধাগুলো শুধুমাত্র ঢাকাকেন্দ্রিক না করে ভৌগোলিক সমতা বজায় রেখে প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।”
অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ঢাকায় যেভাবে একটি নগরীর মধ্যে সবকিছু কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এরকম উদাহরণ আর কোথাও নেই। আবার নাইজেরিয়ার লাগোস ছাড়া আর কোনো শহরে গত ৪০ বছরে এতো বেশি দ্রুত গতিতে বাড়েনি।
“সব দোষ নগর কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের লাভ নেই। এটা সামলানো সোজা কথা না।… এই বাসযোগ্যতা বাড়াতে না পারলে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, বিশেষ অতিথি ছিলেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের (সিইউএস) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।
বাপার সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিবের সঞ্চালনায় সম্মেলনে প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর বক্তব্য দেন বাপার সহ-সভাপতি ও বেনের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম।
সম্মেলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে নজরুল ইসলাম বলেন, “যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নগরায়ণের প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। গ্রাম থেকে লোক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদন ব্যতীত অন্য পেশা গ্রহণের সীমিত সুযোগ ও গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য-বস্ত্র, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা এবং পাশাপাশি জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবের কারণে মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়েই শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
“প্রত্যাশিতভাবেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে নগরায়ন এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শহর বা নগরাঞ্চলে বসবাস করছে এবং নগরবাসীর প্রায় ৩২ শতাংশ ঢাকায় বাস করে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে রাজধানী ঢাকা থেকে এবং দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা।”
এ পরিস্থিতিতে নগরায়ন যে সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে, সেই বাস্তবতা তুলে ধরে ড. নজরুল ইসলাম বলেন, “দেশের শহরাঞ্চলগুলোর (বিশেষত রাজধানী ঢাকা) জনসংখ্যা অতিদ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত এই জনসংখ্যার ভারবহনে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
“অপ্রতুল সড়ক ব্যবস্থার কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে পরিবহন খাত। শহরের বাসিন্দাদের নির্বিঘ্নে যাতায়াতের জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়কের প্রয়োজন হলেও রাজধানী ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ, তার ৫২ শতাংশই আবার মোটরযান চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে যানজট।
“নগরবাসীর বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ বিদ্যুৎ, পানি, পয়নিষ্কাশন, সড়ক, পরিবহন, বাসস্থান ইত্যাদির চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এছাড়াও দেশব্যাপী ক্রমাগত দখল এবং দূষণে শহরগুলোর সবুজ ও জলজ অংশসমূহ বিলীন হয়ে পড়ছে।”
সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে মোট ১৬টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয়।