“আমরা আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে যারা মারা গেছেন, তাদের ছবি দেখিয়ে যেন আর কেউ টাকা নিতে না পারে,” বলছেন ইয়াসমিন এ চৌধুরী হ্যাপি।
Published : 25 Jun 2023, 06:55 PM
সাভারের রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের নামে সংগ্রহ করা অন্তত ১০০ কোটি টাকা এনজিওগুলো ‘আত্মসাৎ করেছে’ বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নাগরিক।
ইয়াসমিন এ চৌধুরী হ্যাপি ব্রিটিশ কোম্পানি লাভদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী লাভদেশ একটি ‘ইথিক্যাল লাক্সারি’ ব্র্যান্ড, যারা বিভিন্ন পণ্য বিক্রির পাশাপাশি ভ্রমণ সংক্রান্ত সেবা দেয়।
নেদারল্যান্ডসের একটি এনজিওর কাছ থেকে পাওয়া ২৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশের আওয়াজ ফাউন্ডেশনসহ দুটি বিদেশি এনজিওর নামে সিলেটের হাকিম আদালতে মামলা করার কথাও হ্যাপি বলেছেন।
ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়াজ ফাউন্ডেশন বলেছে, হ্যাপির বক্তব্য ‘ভিত্তিহীন ও বানোয়াট’।
জাতীয় প্রেসক্লাবে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে হ্যাপি বলেন, রানা প্লাজায় হতাহতদের জন্য বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান টাকা দিচ্ছে, কিন্তু যারা ওই টাকা পাওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছে না।
“কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। যারা আমার ভাই-বোনদের কষ্ট দিয়েছে আমি তাদের ধ্বংস করব।”
হ্যাপির অভিযোগ, বিদেশি এনজিওর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান তা রানা প্লাজায় হতাহতদের পরিবারকে না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে। এ অভিযোগে বাংলাদেশের আওয়াজ ফাউন্ডেশন, নেদারল্যান্ডসের ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন এবং যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন রেভোলিউশনের নামে গত ২৯ মে সিলেটের মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন তিনি।
মামলায় আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নাজমা আক্তারকে আসামি করা হয়েছে জানিয়ে হ্যাপি বলেন, “কোর্টে মামলা করার পর আমাদের সাক্ষী হৃদয়ের ওপর হামলা হয়েছে। ফলে আমরা আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে যারা মারা গেছেন, তাদের ছবি দেখিয়ে যেন আর কেউ টাকা নিতে না পারে।
“রানা প্লাজায় হতাহতদের নাম করে যত টাকা নেওয়া হয়েছে সেগুলো কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে তা তদন্ত করতে হবে। আত্মসাৎকৃত টাকা শ্রমিকদের ফেরত দিতে হবে। যেখানেই থাকি না কেন, আমি এই সংগ্রাম করে যাব। আমি যুদ্ধ ঘোষণা করছি।”
হ্যাপির কোম্পানি লাভদেশের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, তারাও রানা প্লাজার ভিকটিমদের নিয়ে বিভিন্ন প্রচারাভিযান পরিচালনা করেন। নিজে ওই ঘটনার ভিকটিম না হলেও একটি ‘অন্যায়ের প্রতিকার চাইতেই’ তহবিল তছরুফের অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বলে তার ভাষ্য।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন।
কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় এক হাজার ১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন।
রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের সহায়তায় বিদেশি এনজিওর কাছ থেকে পাওয়া ২৭ কোটি টাকা আওয়াজ ফাউন্ডেশন আত্মসাৎ করেছে বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন হ্যাপি।
এ সময় এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এনজিওগুলো রানা প্লাজায় হতাহতদের নাম করে নেওয়া ১০০ কোটি টাকার ওপরে আত্মসাৎ করেছে।”
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিদেশি এনজিওগুলো যেভাবে তহবিল সংগ্রহ করে, সেই পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি জানান হ্যাপি। এছাড়া রানা প্লাজায় হতাহতদের নামে বিদেশি এনজিতওগুলো যত টাকা নিয়েছে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে দিয়ে সংসদীয় তদন্ত করা এবং আত্মসাতকৃত অর্থ ফেরত দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
হ্যাপি বলেন, এ বিষয়ে তিনি নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসে চিঠি লিখেও কোনো সাড়া পাননি। বাংলাদেশ সরকার, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য তিনি আহ্বান জানাবেন। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন এবং এনজিও ব্যুরোতেও তিনি অভিযোগ দেওয়ার কথা বলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে হ্যাপির আইনজীবী মো. জাকারিয়া বলেন, রানা প্লাজার ভিকটিমদের পক্ষে বিদেশি কিছু এনজিও এবং বাংলাদেশের একটি এনজিওর বিরুদ্ধে তারা সিলেটে মামলা করেছেন, কারণ রানা প্লাজায় হতাহতদের কথা বলে বেশকিছু এনজিও টাকা নিলেও তা শ্রমিকদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না।
“তারা গরীব অসহায় মানুষ, রানা প্লাজা ধসে তাদের চরম ক্ষতি হয়েছে। বেশিরভাগই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মেরুদণ্ডে সমস্যা। এদের টাকার অনেক দরকার। কিন্তু এনজিওগুলো তাদের টাকা আত্মসাৎ করছে।”
জাকারিয়া বলেন, “বিদেশের এনজিওগুলো নিজেদের দেশে কার্যক্রম চালালেও বাংলাদেশেও তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিন্তু যেসব এনজিওর বাংলাদেশে শাখা নেই, তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনি পদক্ষেপ নিতে পারব না। এজন্য ইয়াসমিন চৌধুরী নিজে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেসব দেশের আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে “
সিলেটের আদালতে প্রতারণার যে মামলা করা হয়েছে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত কয়েকজন শ্রমিক ওই মামলার সাক্ষী।
তাদের একজন মাহমুদুল হাসান হৃদয় সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মামলা হওয়ার পর সাভারে তার ওপর হামলা করা হয়েছে। পরে তিনি হাসপপাতালে ভর্তি হন এবং সাভার থানায় জিডি করেন। সিলেটে যাওয়ার পর সেখানেও তার ওপর হামলা হয়।
রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিক সাদ্দাম হোসেন, আফরোজা বেগম এবং বুলবুলি খাতুন সংবাদ সম্মেলনে তাদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন।
অভিযোগের বিষয়ে ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন এবং ফ্যাশন রেভোলিউশনের বক্তব্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। আওয়াজ ফাউন্ডেশনে নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার দেশের বাইরে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্যও পাওয়া যায়নি।
ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর ইসমেত জেরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়াজ ফাউন্ডেশন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত। যে কোনো মাধ্যমেই হোক না কেন, যদি এক পয়সাও বৈদেশিক মুদ্রা অনুদান হিসেবে আসে, তাহলে তা সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিয়েই খরচ করতে হয়।
“রানা প্লাজার ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ফান্ড নিইনি। ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্যের উপর তিনি (হ্যাপি) সংবাদ সম্মেলন করেছেন।"
আওয়াজ ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে সিলেটে যে মামলা হয়েছে, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য তারা জানেন না বলে দাবি করেন ইসমেত জেরিন।