সেলিম কাবাবের জাদু ‘গোপন মসলায়’

সেই হেকিম তাকে পরদিন দেখা করতে বলেন। পরদিন গেলে তার হাতে তুলে দেন একটি চিরকুট। যাতে লেখা ছিল কাবাবের রেসিপি।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 August 2022, 04:35 AM
Updated : 14 August 2022, 04:35 AM

রাস্তায় ঢুকতেই নাকে এসে সুড়সুড়ি দেবে ধোঁয়া আর মসলায় মাখামাখি চনমনে এক ঘ্রাণ। রসনা উস্কে দেওয়া ওই খুশবু ধরে একটু এগোলেই চোখে পড়বে কয়লার আগুনে পোড়ানো হচ্ছে নানা ধরনের কাবাব।

টিনের চালার মোটামুটি মাঝারি আকারের একটি দোকান। ভেতরে রাস্তার পাশের অংশে চলছে দ্রুত হাতে কাবাব পোড়ানো। পাশে বানানো হচ্ছে লুচি। গতি দেখে মনে হবে যেন কোনো যন্ত্রের কারবার।

সবচেয়ে জনপ্রিয় গরুর শিক কাবাব ছাড়াও এখানে পাওয়া যায়, চিকেন শিক কাবাব, চিকেন চাপ, বিফ চাপ, মগজ ফ্রাই। সঙ্গে থাকে পুদিনা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ, তেঁতুলের সঙ্গে শশা, পেঁয়াজ মেশানো একটি সালাদ।

মসলার পরিমাণ বেশি না থাকলেও এখানকার কাবাবে আলাদা একটা ঝাঁজ পাওয়া গেল। দাঁতের নিচে মাংসের টুকরো পড়লে সেই ঝাঁজের সঙ্গে যোগ হয় পোড়া স্বাদের মজাদার এক মিশেল।

বাঙালির হেঁশেলে উৎপত্তি না হলেও দীর্ঘদিন ধরে বাঙলার রসনায় অন্যতম একটি স্থান দখল করে আছে কাবাব। তুর্কিদের হাত ধরে আসা এই খাবারটি ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয় মোঘলদের মাধ্যমে।

মানুষ যখন আগুন জ্বালাতে শিখল তখন থেকেই সে আগুনে পুড়িয়ে মাংস খাওয়াও শিখেছে। তার বহু পরে আসে মসলার ব্যবহার। সেই মসলা আর মাংস আগুনে ঝলসে হয় নানা রকম কাবাব।

কয়েক যুগ ধরে রাজধানী ঢাকায় যে কয়টি কাবাবের দোকান চলছে তাদের মধ্যে অন্যতম মোহাম্মদপুরের শহীদ সলিমুল্লাহ রোডের ‘সেলিম কাবাব ঘর’।

১৯৭৮ সালে যাত্রা শুরু করে কাবাবের এই দোকান চলছে প্রায় ৪৪ বছর। প্রতিষ্ঠার সময়ের টিনের ছাপড়া ঘরটাই এখনও আছে। এক পাশে কাবাব বানানো হয়, অপর পাশে কিছু টেবিল আর বেঞ্চ।

সব মিলে একসঙ্গে ১৫ জনের বেশি বসতে পারেন না। ঠাসাঠাসি করে হয়তো আরও ২-৩ জন বসতে পারবেন।

কাবাবের স্বাদ নিতে ছোট্ট এই দোকানেই বিকাল ৫টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত দেখা যায় মানুষের লাইন। মূল দোকানের সামনে আরেকটি এবং কিছুটা দূরে আরও একটি দোকান চলছে। ভিড় সামলাতে এই ব্যবস্থা।

বিকেলের পর থেকেই দোকানের সামনে শুরু হয় রসনা বিলাসীদের আনাগোনা। দৈনিক শ’তিনেক লোকের রসনা মেটাতে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তার পেছনে রয়েছে এক গোপন মসলা।

সেলিম কাবাবের ইতিহাস

সেলিম কাবাবের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মোহাম্মদ সেলিম খান। জন্ম ভারতের বিহারে। সেখানেই এক হেকিমের কাছ থেকে পেয়েছিলেন কাবাবের রন্ধণপ্রণালী। যা বদলে দেয় তার জীবন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে এই গল্প তুলে ধরেন সেলিম খানের ছেলে মোহাম্মদ লিয়াকত খান।

১৯৯৩ সালে সেলিম খান মারা গেলে ১৪ বছর বয়সী লিয়াকতই নেন দোকানের ভার।

কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সেলিম কাবাব ঘরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। সেলিম খান প্রায় ১৪ বছর দোকান সামলেছেন। আর গত ৩০ বছর ধরে এর হাল ধরে আছেন লিয়াকত।

সাতচল্লিশে ভারত ভাগের পর অন্য অনেকের মত ভাগ্যান্বেষণে ভারতের বিহার থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন মোহাম্মদ সেলিম খান। পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে শুরু করেন পানের ব্যবসা।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার ফেরত যান বিহারে। সেখানে রান্না করা গরুর ভুড়ি আর নেহারি বিক্রি করতেন রাস্তার পাশে। একদিন এক হেকিম (কবিরাজ) এসে সেলিম খানকে বলেন, তার ‘রান্না ভালো হয় না’।

সেলিম নিজের দুর্দশার কথা বলেন হেকিমকে। সেই হেকিম তাকে পরদিন দেখা করতে বলেন। পরদিন গেলে তার হাতে তুলে দেন একটি চিরকুট। যাতে লেখা ছিল কাবাবের রেসিপি।

হেকিম সাহেবের নির্দেশ ছিল সেলিম যাতে নিজের পরিবারের বাইরে কারো কাছে এই রেসিপি না দেন। এই ঘটনার ছয় মাস পর আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন সেলিম। শুরু করেন সেলিম কাবাব ঘর।

“আব্বা যখন স্বাধীনতার পর আবার দেশে ফিরে আসতে চান তখন সেই হেকিম বাবাকে বলেন, সেলিম তুমি যেহেতু বাংলাদেশে চলে যাচ্ছ, তোমাকে আমি এমন একটি জিনিস শেখাব যাতে তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবে।

“তখন তিনি আব্বাকে এই কাবাবের মসলা ও রেসিপি বানানো শিখিয়ে দেন। বাবাকে সবকয়টি মসলা ধরে ধরে তিনি শিখিয়ে দেন, কোনটা কতটুকু পরিমাণ দিতে হবে।”

লিয়াকত বলেন, “মসলা তৈরি শেখোনোর পর সেই হেকিম আব্বাকে বলেছিলেন, সেলিম তোমার কাবাব সবচেয়ে বেশি চলবে। এর ধারে কাছে কেউ বানাতে পারবে না।”

আসল জাদু মসলায়

অন্যান্য কাবাব থেকে সেলিম কাবাব আলাদা কেন? এই প্রশ্নে লিয়াকত বলেন, বিহারের সেই হেকিমের মসলা বানানোর কৌশল বাবার কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন এবং এখনও তা ধরে রেখেছেন।

“আব্বা আমাকে সারাজীবনের জন্য এলেম দিয়ে গেছেন। সেই এলেম দিয়েই সংসার চলছে। শুধু আমার নয়। এখন আমার তিনটে কাবাব ঘর। ২৪ জন মানুষ কাজ করে। ২৪টি পরিবার চলছে সেই এলেমে।”

পরম্পরার এই ইতিহাস তুলে ধরে লিয়াকত খান বলেন, “আমার আব্বার কাছ থেকে যে মসলাটা বানানো আমি শিখেছি তা আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছি। আর এই মসলা বানানোর কৌশলটা কারও কাছে প্রকাশ করা হয় না।

“এটা আমি গোপন করে রাখি। আমি আর স্ত্রী ছাড়া কেউ জানে না।”

তিনি জানান, মোট ৩৩ রকমের উপাদান দিয়ে সেই মসলা বানানো হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি এই মসলায় কোনো ধরনের রাসায়নিক, খাবার সোডা, রঙ কিংবা টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় না।

এছাড়া কাবাবের মাংসের বিষয়ে তিনি বলেন, “আর সেই শুরু, আজ পর্যন্ত আমরা দেশি গরুর মাংস কিনি। এখন তো প্যাকেটের মাংসও চলে এসেছে। আমরা সেটা নেই না। দেশি গরুর মাংস প্রতিদিন আনা হয়।

“তাজা মাংসে নিজের হাতে মসলা মাখিয়ে রেখে দেই। পরে কর্মচারীরা শিকে গেঁথে পোড়ায়।”

সেলিম কাবাব ঘরের মূল আকর্ষণ- শিক কাবাব তৈরি করেন লিয়াকত নিজেই। তার দোকানে আরও নানা রকম কাবাব পাওয়া গেলেও তার বিশেষ নজর থাকে শিক কাবাবে।

ঢাকার বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর শিক কাবাবের ক্ষেত্রেই মনে হয় মাংসটা পিষে ফেলা হয়েছে। সেলিমের কাবাব সেখানে আলাদা। এখানে মাংসের টুকরোগুলো আলাদা করে বোঝা যায়।

তাই বলে এর ধরনটা শুকনো কিংবা খটখটে নয়। এক টুকরো মুখে পুরলে গোপন সেই মসলার স্বাদ আর ঘ্রাণ একেবারে তালুতে গিয়ে জেঁকে বসে। কাবাবের এই স্বাদটাই মানুষ নিতে আসে।

দীর্ঘ সময় মসলা মাখিয়ে রাখায় মাংস স্বাভাবিকভাবেই নরম হতে থাকে। কয়লার আগুনে তাই বেশিক্ষণ পোড়াতে হয় না। কাবাব মুখে দিলে সেই পোড়া স্বাদের সঙ্গে রসালো একটা ভাব জিভে জড়িয়ে যাবে।

বেশি নরম হওয়ায় অনেকের কাবাব মুখে দিলে মিলিয়ে যায়, তবে সেলিম সেখানে আলাদা। এখানকার কাবাব চিবোতে হয় বলেই পুরো স্বাদ আস্বাদন করা যায়। তখন মোলায়েম ভাবের বদলে স্বাদের একটা ‘জৌলুস’ এসে ধরা দেয়।

চলছে কেমন?

লিয়াকত খান জানান, ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে আঘাত লাগলে অপারেশন করে ঘাড়ে স্ক্রু লাগানো হয়। এক হাতে ঠিক মত জোর পান না। দুই কেজির বেশি ওজন তোলাও নিষেধ। তবু সবকিছু চালাচ্ছেন নিজ হাতেই।

একসময় কেবল মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দারা ভিড় করলেও প্রচার আর প্রসারের কারণে এখন ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ প্রতিদিন কাবাব খেতে আসেন সেলিম কাবাব ঘরে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফাহাদ বিন রফিক, পেশায় একজন ব্যাংকার। তিনি বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকে এই কাবাব খাচ্ছি। ঢাকায় বেশিরভাগ জায়গায় নানা কিছু মিশিয়ে মাংসটা একরকম পিষে ফেলা হয়। সেলিম কাবাবে সেটা নয়।

“মাংসের টুকরো মসলায় মাখিয়ে পোড়ানো হয়। সেই ছোটবেলায় যেমন খেয়েছি, এখনও স্বাদ একইরকম।”

মিরপুর থেকে আসা মো. ফয়সালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিভিন্ন ফুড ভ্লগে সেলিম কাবাব সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারি। এরপর অনেকবার এসেছি। মোটামুটি কম দামের মধ্যে অনেক ভালো একটি খাবার।”

এখানে গরুর শিক কাবাব ১২০ টাকা। এরপর বেশি জনপ্রিয় চিকেন চাপ, মগজ ফ্রাই ও চিকেন টিক্কা। প্রত্যেকটির দাম ১০০ টাকার আশেপাশে। কাবারের সঙ্গে লুচি খেতে চাইলে প্রতিটির দাম পড়বে ৫ টাকা।

সেলিম কাবাব ঘরে প্রতিদিন বিকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ৩০০-৩৫০ মানুষের জন্য কাবাব আর লুচি তৈরি হয়। শুক্রবার বা অন্য ছুটির দিন সেটা বেড়ে যায়।