প্রাণে বেঁচে গেছে, হারিয়েছে ‘জীবন’

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, “সরকার থেকে শুরু করে যানবাহনের মালিক সমিতি বা ইউনিয়নগুলো কেউই দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে দাঁড়ায় না; ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থাও নেই।”

গোলাম মর্তুজা অন্তুগোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2022, 04:03 AM
Updated : 21 Oct 2022, 04:03 AM

মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে তখন ১২২ কিলোমিটার গতিতে ছুটছিল মোটরসাইকেল, হঠাৎ আরেকটি মোটরসাইকেল সামনে চলে এলে ধাক্কা খেয়ে সড়কে ছিটকে পড়েন আশরাফ আহমেদ তালহা, এরপরই তার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায় ট্রাকের চাকা।

১৯ বছরের এই তরুণ এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১৩ নম্বর কক্ষে কাতরাচ্ছেন; একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে, অন্যটিও ক্ষতিগ্রস্ত। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটছে পরিবারের।

সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতি বছর কতজন আহত হন বা পঙ্গু হন তার সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের পরিসংখ্যান একেক সংগঠনের কাছে একেক রকম।

বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, গত বছর দেশে ৫ হাজার ৩৭১টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন, আর আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬৮ জন।

অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হন; আহত হন ৯ হাজার ৩৯ জন।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, আহতের এই সংখ্যা বাস্তবে অনেক বেশি। কারণ যারা পরিসংখ্যান তৈরি করেন, তারা সাধারণত বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ব্যবহার করেন। আর গণমাধ্যমে সব সময় আহতের তথ্য সঠিকভাবে আসে না।

চিকিৎসকেরাও বলছেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আসা হাড় ভাঙা রোগীদের বেশিরভাগই দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আসছেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বেঁচে গেলেও আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না তাদের অনেকেই।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক নোমান খালেদ চৌধুরী বুধবার তার ফেইসবুক পেইজে লিখেছেন, “বাংলাদেশের নিউরোসার্জারিতে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থেকে মোটরসাইকেলের নতুন নামকরণ করতে ইচ্ছে হয়: মরণ সাইকেল।”

তার সেই পোস্টের নিচে অন্য চিকিৎসকরাও মন্তব্য করেছেন। আবু হেনা মাহবুব নামের একজন লিখেছেন, “ডিজ্যাবিলিটি সাইকেল, মরে গেলে তো বেঁচে গেল। পঙ্গু হলে বাকি জীবন অন্যদের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকে।”

পা হারিয়ে ‘দিশেহারা’ তালহা

গত ৩০ সেপ্টেম্বর মধ্য রাতে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার শিকার তালহা তিন ভাই বোনের মধ্যে মেজো। দুর্ঘটনার দুদিন আগে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে তার ভর্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল।

দুর্ঘটনার সাড়ে ৪ মাস আগে বাবা ব্যবসায়ী হাজী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন মারা যান। তার মা রাজিয়া সুলতানা এখন বাড়ি ভাড়া থেকে সংসার খরচ চালাচ্ছেন। চিকিৎসাধীন ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালেই দিন কাটছে তার।

সেদিন কী ঘটেছিল- জানতে চাইলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তালহা বলেন, পড়াশোনার চাপ নেই আর একটু ঘুরতে যাবেন বলে সেদিন বের হয়েছিলেন। তিন বন্ধু তিনটি মোটরসাইকেল নিয়ে মধ্যরাতে মাওয়ার দিকে রওনা হন।

“এক্সপ্রেসওয়েতে আমার ইয়ামাহা আর ওয়ান ফাইভ মোটরসাইকেল ঘণ্টায় ১২২ কিলোমিটার গতিতে ছুটছিল। কিন্তু হঠাৎ সামনে থেকে আরেকটি মোটরসাইকেল আমাকে ধাক্কা দিলে রাস্তায় পড়ে যাই। এরপর একটি ট্রাক আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে যায়।”

এখন হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথাই মনে করছেন তালহা। কয়েক দফা অস্ত্রপচারের পর বাম পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকেরা। ডান পায়ের আঘাতও এখনও ভালো হয়নি।

এখনও আঁতকে ওঠেন আব্বাস

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার আব্বাস উদ্দীনের আয়ের উৎস ছিল অটোরিকশা। কিন্তু আট বছর আগে ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে যায় তার।

ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় তার অটোরিকশায় থাকা দুই যাত্রীর প্রাণ যায়। আব্বাস প্রাণে বাঁচলেও এখন দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছেন।

তিনি বলেন, গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গিয়েছিলাম। কয়েক দফা অস্ত্রপচারের পর দুই পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলে দেন চিকিৎসকেরা। এখন পুরোপুরি পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছি।

‘মরে যাওয়াই ভালো ছিল’

গাইবান্ধার মেরু মিয়ার বয়স তখন মোটে ১৫ বছর। ২০১২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন কাজের খোঁজে। কিন্তু ব্যস্ত রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির নিচে চাপা পড়েন।

মেরু জানান, প্রাণ বাঁচলেও বাম পা কেটে ফেলতে হয়। অনেক ধার-দেনা করে চিকিৎসা করিয়েছিলেন তার বাবা।

কিছুদিন পরে তার বাবার মৃত্যু হলে পা হারানো মেরুকেই নামতে হয় জীবিকার খোঁজে। এখন একটি রিকশার গ্যারেজে মেকানিক হিসেবে কাজ করছেন।

মেরু মিয়া বলেন, “যার এরকম হয় নাই সে কুনোদিন বুঝবে না। কী যে পাপ করছিলাম ভাই। যখন পা কাটলো তখন মনে হয় মরে যাওয়া এর চাইতে ভালা আছিল। কী যে কষ্ট!”

তাদের খোঁজ কে রাখে?

প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় যারা আহত বা পঙ্গু হন, পরিবারগুলো হারায় একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষকে, সেইসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি বলে মনে করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের পুরোধা অভিনয় শিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার থেকে শুরু করে যানবাহনের মালিক সমিতি বা ইউনিয়নগুলো কেউই দুর্ঘটনায় আহতদের পাশে দাঁড়ায় না। নেই ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা।

“পরিবারের একটা কর্মক্ষম লোক দুর্ঘটনায় প্রথম পঙ্গু হয়ে উপার্জন হারান। এরপর তার চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ করতে গিয়ে পরিবারটিও নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এরকম শত শত, হাজার হাজার উদাহরণ তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশ জুড়ে।”

তিনি বলেন, “আমরা আমাদের সংগঠন (নিসচা) থেকে সাধ্যমত এসব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু এই সমস্যার ব্যাপ্তি অনেক বেশি।”