প্রকাশিত তিনটি খণ্ড পুনঃমুদ্রণও করা হয়নি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে। এগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের তালিকায়ও নেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলীর নাম।
Published : 10 Jul 2023, 08:34 PM
বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অথচ তার রচনাবলী প্রকাশের কাজ ৩০ বছরেও শেষ করতে পারেনি গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
নব্বই দশকের শুরুর দিকে ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় রচনাবলীর তিনটি খণ্ড প্রকাশ হয়েছিল। চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড সম্পাদনার পর্যায়ে থাকার সময়ই ২০২০ সালের ১৪ মে মারা যান আনিসুজ্জামান। এরপরই থেমে যায় রচনাবলী প্রকাশের কাজ।
এদিকে বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকাশিত তিনটি খণ্ড পুনঃমুদ্রণও করা হয়নি ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে। এগুলো এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের তালিকায়ও নেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলীর নাম।
এই বহুভাষাবিদ, জ্ঞানতাপসকে নিয়ে বাংলা একাডেমির তেমন কোনো গবেষণাও নেই।
তবে বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ড প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান প্রয়াত হওয়ার পর এই পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার জন্য নতুন কাউকে এখনও নিযুক্ত করা না হলেও এজন্য যোগ্য কাউকে খোঁজা হচ্ছে।
পাশাপাশি তাকে নিয়ে একটি পিএইচডি গবেষণার থিসিসও প্রকাশ করতে যাচ্ছে একাডেমি।
একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) জি এম মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে তিনটি খণ্ড প্রকাশ হয়েছিল, সেগুলো পুনঃমুদ্রণ করার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি দ্রুতই পুনঃমুদ্রণ করা হবে।”
কবে থেকে কাজ শুরু হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঈদের পর থেকে আমরা কাজ শুরু করেছি।”
এতদিন কাজটি না করার কী কারণ ছিল এমন প্রশ্নে মিজানুর রহমান বলেন, “আমি তো এই বিভাগে নতুন দায়িত্ব নিয়েছি, এটি আমার জানা নেই।”
২০০৭ সালের মে থেকে ২০০৯ সালের মে পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন ভাষাবিদ, শিক্ষক ও গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ।
শহীদুল্লাহ রচনাবলীর চতুর্থ খণ্ড প্রকাশে বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেক কিছু তো এখন আর মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে আনিসুজ্জামান স্যার কাজটি তখনো পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারেননি। আর এ ধরনের কাজ তো অনেক সময়সাপেক্ষ, হুট করে করা সম্ভবও নয়।”
প্রকাশিত তিনটি খণ্ড দীর্ঘদিন পুনঃমুদ্রণ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “বাংলা একাডেমিকে সরকার বই ছাপার জন্য টাকা দেয়, পরে সেই বই বিক্রি করে পুনঃমুদ্রণ করার একটা ব্যাপার আছে। এখন বাংলা একাডেমিতে কীভাবে বাজেট হয় আমি জানি না। আমার ধারণা এখনও বই বিক্রি করে পুনঃমুদ্রণ করার কাজটি করতে হয়। অনেক বই ছাপতেও হয় বই বিক্রি থেকে উপার্জিত একাডেমির নিজস্ব অর্থায়নে। এখন সরকার থেকে বই ছাপতে কতুটুকু বাজেট দেয়, সেটা আমার জানা নেই।"
এসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের বিষয়টি নিয়ে আরও কাজ করা উচিৎ বলে মনে করেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ।
“এক্ষেত্রে আসলে প্রায়োরিটি বিবেচনায় আনা দরকার। কোন বইগুলোকে আগে ছাপার জন্য আমরা প্রায়োরিটি দেব, সেটা বিবেচনায় আনতে পারলে হয়তো শহীদুল্লাহ রচনাবলী বাজারে থাকত,” বলেন এই গবেষক।
লেখা হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন
দীর্ঘদিন ধরে শহীদুল্লাহ রচনাবলী প্রকাশ না হওয়ার পেছনে পাণ্ডুলিপির কিছু লেখা হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন রয়েছে সাহিত্য অঙ্গনে। তবে একাডেমি বলছে, লেখা হারানোর তথ্যটি সঠিক নয়।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহ পারিবারিক সংগ্রহ থেকে বিভিন্ন লেখা বাংলা একাডেমিকে দিয়েছিলেন। সেগুলো এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া আরও লেখা সমন্বয় করে ড. আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় শহীদুল্লাহ রচনাবলী সম্পন্ন করার কাজটি করছিল বাংলা একাডেমি।
নব্বই দশকে (৯৪-৯৫ সাল) তিনটি খণ্ড প্রকাশ হয়েছিল। তৃতীয় খণ্ডটি সম্পাদনা করেছিলেন অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। কিন্তু এরপর প্রায় ৩০ বছরেও চতুর্থ খণ্ড না আসায় ঘনীভূত হয় পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে মারা যান তকীয়ূল্লাহ। ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয় তাকে। তকীয়ূল্লাহ বাংলাদেশের বর্তমান বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রণেতাও।
মুহম্মদ তকীয়ূল্লাহর মেয়ে শান্তা মারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবা মারা যাওয়ার পর সম্ভবত ২০১৮ সালের দিকে বাংলা একাডেমি থেকে একজন কর্মকর্তা আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, পাণ্ডুলিপির কিছু লেখা হারিয়ে গেছে। কিন্তু কে ফোন করেছিলেন, সেই নামটি এখন আর মনে পড়ছে না। তখন বাবার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন ছিলাম, ঠিক কী কী বলেছিলেন, তা আর এখন নিশ্চিত করে বলতে পারব না।”
পাণ্ডুলিপি হারানোর গুঞ্জনের বিষয়ে একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগের পরিচালক মো. মোবারক হোসেন বলেন, “চতুর্থ খণ্ডের পাণ্ডুলিপি আনিসুজ্জামান স্যারকে দেওয়া হয়েছিল। স্যার মারা যাওয়ার পর উনার বাসায় গিয়ে আমরা যেটুকু পেয়েছি, সেগুলো নিয়ে এসেছি। তখন পুরোটা আমরা একসঙ্গে পাইনি।”
কিছু অংশ কী হারিয়ে গেছে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “হারিয়ে গেছে সরাসরি বলা ঠিক হবে না। এই সময়ের মধ্যে আমাদের তিনটি বিল্ডিং শিফট করতে হয়েছে। ফলে সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় আছে। ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারিনি। আমাদের এখানে এলোমেলো অবস্থায় যেগুলো আছে, সেগুলো গোছানোর কাজ চলছে। তারপর বুঝতে পারব, কিছু মিসিং আছে কিনা। তখন আমরা পরিবারের দ্বারস্থ হব।”
দ্রুতই চতুর্থ খণ্ড প্রকাশের কাজ শুরু হবে জানিয়ে একাডেমির এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা পরিবারের সহযোগিতা নেব। দেখি, আমাদের কাছে এবং পরিবারের কাছে মিলিয়ে কতটুকু ম্যাটার আছে। পরিবারের সাথে আমি যোগাযোগ করেছিলাম। আবারও যোগাযোগ করে পরিবারের সহযোগিতা নেব। আর আনিসুজ্জামান স্যার মারা যাওয়ার কারণে এখন তো নতুন কাউকে বাকি কাজের সম্পাদনার দায়িত্বও তো দিতে হবে। আসলে এরকম একটা কাজ করার জন্য যোগ্য লোকও খুব বেশি নেই।”
সরকারি দপ্তর থেকে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ নয় উল্লেখ করে সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, “অনেক বছর হওয়ার কারণে হয়ত এলোমেলো অবস্থায় আছে কিংবা ফাইল চাপা পড়ে আছে, কিন্তু হারিয়ে যায়নি বলেই আমার ধারণা। হয়ত কোনো ফাইলের মধ্যেই আছে।”
যা বলছেন বর্তমান মহাপরিচালক
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ রচনাবলী প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা রয়েছে বলে জানান বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা।
তিনি বলেন, “রচনাবলীর সম্পাদক ছিলেন আনিসুজ্জামান স্যার, উনি তো মারা গেছেন। উনি আসলে এটা শেষ করে যেতে পারেননি। আনিস স্যারের মধ্যেও জীবিত অবস্থায় অনেক ইচ্ছা ছিল এই কাজটি শেষ করে যাওয়ার। উনি বলতেনও যে ‘এই কাজটি যদি শেষ করে যেতে পারতাম!’ সেটা আসলে করা সম্ভব হয়নি।
“আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিবারের সাথে আমাদের দিক থেকে যোগাযোগ করেছি। আশা করি, দ্রুতই চতুর্থ খণ্ড প্রকাশ হবে। কিন্তু সম্পাদনা ছাড়া তো আর প্রকাশ করা যাবে না। তার জন্য এখন নতুন সম্পাদক নিযুক্ত করতে হবে। সেটি নিয়ে আমরা কাজ করছি।”
পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়ার গুঞ্জনের বিষয়ে নূরুল হুদা বলেন, “হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি সত্যি নয়। আর মূল কপি তো পরিবারের কাছেও থাকবে। আমাদের এখানেও থাকবে। কতটুকু সম্পাদিত হয়েছে, কীভাবে আছে, সেটা আমাদের এখন দেখতে হবে। দ্রুতই চতুর্থ খণ্ড প্রকাশ হবে।”
১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই জন্মেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ১৩ জুলাই ১৯৬৯ সালে তিনি প্রয়াত হন।