বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকি: ২৬ মাসেও শেষ হয়নি মামলার পুনঃতদন্ত

পিবিআই বলেছিল, ভাস্কর্য ভাঙার হুমকিতে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কিছু ছিল না; এখন তদন্ত করছে সিআইডি।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Feb 2023, 04:01 PM
Updated : 26 Feb 2023, 04:01 PM

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দেওয়ার হুমকির মামলা তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল পুলিশের ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যে প্রতিবেদনে আপত্তি জানিয়ে নারাজি আবেদন দেন বাদী।

এতে আদালতের নির্দেশে ২০২০ সনের ৭ ডিসেম্বর পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। এরপর দুই বছর দুই মাস পার হয়ে গেলেও তদন্ত শেষ হয়নি।

মামলার বাদী মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিআইডির কয়েকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল অনেক দিন হল।

“আমার কাছ থেকে কিছু প্রমাণ, আলামত তারা নেন। তারা বলেছিলেন, আমাকে জানাবেন কী হল। কিন্তু তার পর আর কিছু জানি না। সরকারি তদন্ত সংস্থাকে তো আমি চাপ দিতে পারি না।”

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক শাহজালাল মুন্সী। আর তদন্ত তদারক করছেন একই বিভাগের বিশেষ সুপার আনিসুর রহমান।

তদন্ত কতদূর এবং কবে প্রতিবেদন জমা পড়বে প্রশ্ন করা হলে আনিসুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময় মতো জানবেন।”

শাহজালাল মুন্সীও বলেছেন একই কথা- “কবে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলা যাবে না।”

বাদীর আইনজীবী মো. আনিস-উজ-জামান প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঢাকার মহানগর হাকিম শফি উদ্দিনের আদালতে মামলাটি রয়েছে।

তিনি বলেন, “পিবিআই কর্মকর্তা ফৌজদারি সংশ্লিষ্ট আইন মেনে তদন্ত করেননি। ঘটনাস্থলে না গিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। প্রতিবেদন তৈরিতে আসামিদের প্রভাব ছিল।

“পিবিআইয়ের প্রতিবেদন দেখে মনে হয়েছে, তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনাস্থলই পরিদর্শন করেননি। ঘটনাস্থলের কারও বক্তব্য গ্রহণ করেননি। তিনি আসামিপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে এই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। আদালতে পিটিশন আকারে যেসব লিংক ও তথ্য দিয়েছিলাম, সেগুলো নিয়েও যথাযথ তদন্ত করা হয়নি।”

আনিস-উজ-জামান বলেন, “তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেছেন, যাত্রাবাড়ীতে উনি শুধু একদিন গিয়েছেন। অথচ আমাদের আবেদনে যাত্রাবাড়ী, বিএমএ মিলনায়তন ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীর কথা উল্লেখ করেছি। চট্টগ্রাম ও বিএমএ মিলনায়তনে পিবিআই কর্মকর্তার কোনো ভিজিট নেই।

“চট্টগ্রামের বিষয়ে কোনো মতামতও দেননি। তিনজন আসামির তিনটা ঘটনাস্থল, কিন্তু উনি প্রতিবেদনে কেবল যাত্রাবাড়ী যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।”

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী হেফাজতের আন্দোলন, হামলা, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের সভাপতি বুলবুল মামলাটি করেন, তাতে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।

মামলায় আসামি করা হয় হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক, চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফয়জুল করিম এবং হেফাজতের নেতা জুনাইদ বাবুনগরীকে (বর্তমানে প্রয়াত)।

বুলবুল আরজিতে বলেন, এই তিন ব্যক্তি তাদের জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও সংবিধানের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন, যা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।

ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে করা ওই মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, “২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর মামুনুল হক তোপখানা রোডে বসে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্যে বলেন- ‘যারা ভাস্কর্যের নামে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন করে, তারা বঙ্গবন্ধুর সুসন্তান হতে পারে না, এই মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে’।”

চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেন, “২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর যাত্রাবাড়ির গেণ্ডারিয়া এলাকায় এক সমাবেশে ফয়জুল করিম সেখানে আসা মানুষদের হাত উঁচিয়ে শপথ পড়ান।

“তিনি শপথে বলেন, ‘রাশিয়ার লেলিনের ৭২ ফুট মূর্তি যদি ক্রেইন দিয়ে তুলে সাগরে নিক্ষেপ করতে পারে, তাহলে আমি মনে করি শেখ সাহের মূর্তি, আজকে হোক কালকে হোক, তুলে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করা হবে’।”

জুনাইদ বাবুনগরীও ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক সমাবেশেও একই ধরনের বক্তব্য দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।

মামলার তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া পিবিআইর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পরিদর্শক মো. তৈয়বুর রহমান গত বছর ১৭ জানুয়ারি আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। আসামিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের প্রমাণ মেলেনি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, “তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশের সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেনি। তাদের বক্তব্যে সরকারের একটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অসমর্থনমূলক অভিমত প্রকাশ পেয়েছে। আর এই অভিমতটি ধর্মপ্রাণ মুসলিমপ্রধান দেশের জনমনে কুরআন-হাদিসের আলোকে তারা উপস্থাপন করেছেন।

“একটি স্বাধীন দেশে সরকারি কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে তা যদি জনবিরোধী, ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক, জাতি ও ধর্মবিরোধী হয়, তবে সেসব কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রত্যেক নাগরিক মত প্রকাশ করতে পারেন। এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবরে প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়েছে।”

তদন্ত কর্মকর্তা আরও লিখেছেন, “এছাড়া বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুসলিম বিশ্বের কাছে মসজিদের শহর হিসেবে পরিচিত। মুসলমানদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে তারাসহ দেশের বিশিষ্ট ইসলামী জ্ঞানসম্পন্ন আলেমরা ধর্মের প্রশ্নে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কাজেই তাদের এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহী অপরাধে বিবেচ্য নয়।”