Published : 12 Apr 2024, 10:56 PM
জাতীয় চিড়িয়াখানায় জাতীয় পশু রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখতে বাঘের খাঁচার সামনে ‘টাইগার টাইগার’ বলে চিৎকার করছিল ছোট্ট শিশু ফারিয়া। দেখতে অসুবিধা হওয়ায় বাবার কাঁধে চড়ে অবাক হয়ে দেখছিল বাঘ।
ঈদের পরদিন শুক্রবার বিকালে বাবা-মার সঙ্গে চিড়িয়াখানায় এসেছে এই শিশু।
ফারিয়ার বাবা খালিদ হাসান বলেন, বাচ্চাকে নিয়ে প্রথমবার চিড়িয়াখানায় এসেছেন তারা। ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন তিনি।
রাস্তা ফাঁকা থাকায় দ্রুত চলে আসতে পারলেও চিড়িয়াখানায় ঢোকার মুখে যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে এ পরিবারকে। টিকেট কাউন্টারের সামনেও দাঁড়াতে হয়েছে লম্বা সময়।
তবে খালিদ হাসান বলছেন, সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে বাচ্চার আনন্দ দেখে।
“বেশ কিছু খাঁচা দেখেই ও খুশিতে চিৎকার করছিল। এসব প্রাণী তার খুব পরিচিত। বইয়ে, কার্টুনে দেখেছে; চিড়িয়াখানায় এসে সরাসরি দেখতে পেরে খুবই উচ্ছ্বসিত সে। নতুন নতুন প্রাণীর সঙ্গেও পরিচিত হয়েছে।”
ঢাকার বিনোদনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ঈদে সবসময়ই দর্শনার্থীদের বাড়তি ভিড় থাকে মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। মূলত বাচ্চাদের ঘোরানোর মত জায়গা শহরে কম থাকায় অনেক পরিবারই ঈদের এ সময়টাতে বাচ্চাদের আনন্দ দিতে আসেন চিড়িয়াখানায়।
ঈদের দিন চিড়িয়াখানায় এসেছিলেন এক লাখের বেশি দর্শনার্থী। পরদিন দ্বিগুণ দর্শনার্থীতে উৎসবের আমেজ নেমে আসে সেখানে।
চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, শুক্রবার তারা সোয়া দুই লাখ দর্শনার্থী আসার তথ্য পেয়েছেন।
চিড়িয়াখানার কর্মীরা বলেন, সকাল ৯টায় দুয়ার খোলার আগেই অনেকে এসে ভিড় করেন। বিকালে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না বললে বেশি বলা হবে না।
মূলত যারা ঢাকায় ঈদ করেছেন, তারাই চিড়িয়াখানায় এসেছেন। কেউ কেউ এসেছেন ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকেও।
সকাল থেকে সময় যত গড়িয়েছে বাস, ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি অটোরিকাশা আর রিকশার চাপে চিড়িয়াখানার আশেপাশের রাস্তা স্থবির হয়ে থাকতে দেখা গেছে। ঢোকার সংযোগ সড়কে যানজটের কারণে অনেকে হাঁটতে শুরু করেছেন। টিকেট কাটতেও অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়।
চিড়িয়াখানায় ঘুরে দেখা যায়, পুরো এলাকাই লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছে। গরম উপেক্ষা করেই পশু-পাখি দেখছে নানা বয়সী মানুষ। বেশির ভাগ মানুষই এসেছেন পরিবারের সঙ্গে।
বাঘ, সিংহ, কুমির, গণ্ডার, জলহস্তি, হাতি, বানর, জেব্রা ও জিরাফ ও ময়ূরের খাঁচার সামনে মানুষের ভিড় ছিল বেশি।
বাবা-মায়েরাও তাদের সন্তানদের পশুপাখিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
গাজীপুরের সফিপুর থেকে স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেলা ১১টায় চিড়িয়াখানায় এসেছিলেন মো. ইব্রাহিম।
তিনি বলেন, “অনেকদিন ধরে বাচ্চারা আসতে চাচ্ছিল। ঈদের ছুটির অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ যানজট এই সময়টায় কম থাকে। সকাল সকাল চলে এসেছি। বাচ্চারা খুব এনজয় করেছে।”
আবদুল্লাহপুর থেকে ভাই, বোন, ভাবি, স্ত্রী, মেয়েকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় এসেছেন শফিকুল ইসলাম। দুপুরের খাবার রান্না করে এনে এখানেই খেয়েছেন তারা।
ঈদে বাড়িতে না যাওয়ায় বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে যাচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, “মেয়েকে নিয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) শিশুমেলায় গেছিলাম। আজকে সবাই মিলে আসলাম। পশুপাখি দেখলাম। একসাথে খাইলাম। পিকনিকের মতন হইয়া গেল। ভালোই লাগছে।”
লালবাগের সোনালী আক্তার রুনাও সেই ছোটবেলায় চিড়িয়াখানায় এসেছিলেন। বড় হয়ে আর আসা হয়নি তার। দুই সন্তানকে ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও এদিন সুন্দর সময় কাটিয়েছেন।
রুনা বলেন, “এক বছর ধইরা প্ল্যান করতেছি। আসা আর হয় না। ছুটির কারণে চলে আসছি। সেই ছোটবেলায় আসছিলাম। এখন বাচ্চাদের আনলাম, ওরাও খুশি হইছে।”
তার মেয়ে জান্নাতও চিড়িয়াখানার পশুপাখি দেখে আনন্দ পেয়েছেন।
জান্নাত বলেন, “অনেক মজা হইছে। সবচেয়ে সুন্দর লাগছে সাদা পাখিটা (পেলিক্যান)।”
গার্মেন্টসকর্মী শাবানা ইসলাম তিন ছেলে, স্বামী ও ভাইকে নিয়ে মিরপুরের দুয়াড়িপাড়া থেকে এসেছিলেন। তার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ময়ূর।
শাবানা বলেন, “আজকে প্রথম ময়ূরকে দেখলাম নাচতে। ময়ূরের খাঁচার সামনেই ছিলাম অনেকক্ষণ। খুব ভালো লাগছে। বাচ্চারাও ঘুরে ঘুরে দেখছে। আর ঢাকায় তো যাওয়ার তেমন জায়গায় নাই। তাই এখানেই আসলাম।”
১৮৭ একরের এ চিড়িয়াখানার ১৩৭টি খাঁচায় ১৩৫ প্রজাতির ৩ হাজার ৩৪২টি প্রাণী আছে। যেসব প্রাণীর খাঁচার সামনে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায়, তার একটি হাতি। ঈদের দিন হাতির চাপায় এক কিশোরের মৃত্যু হলেও পরদিন বিশাল এ প্রাণীকে ঘিরে দর্শনার্থীদের উৎসাহের কমতি ছিল না।
হাতির ঘটনায় কেউ কেউ সতর্ক
হাতি থাকার স্থানের নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থাকা অধিকাংশ দর্শনার্থীই ঈদের দিন হাতির চাপায় এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন।
তাদেরই একজন মাফিয়া আক্তার পপি। রামপুরা থেকে তিনি যমজ দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছেন।
হাতির চাপায় এক কিশোরের মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্কিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আতঙ্কিত না, তবে সতর্ক আছি। আমরা তো বাচ্চা নিয়ে ভেতরে যাচ্ছি না। হাতি তো এখানে আসছে না। ও তো অনেক দূরে আছে। সেজন্য তেমন ভয় লাগছে না। বাচ্চারা তো দূর থেকে দেখছে। ওরা হাতিই বেশি পছন্দ করেছে। কারণ বেষ্টনী খোলামেলা। ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে।”
মিরপুর ১১ নম্বর থেকে তিন মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন আলপনা আক্তার।
দেড় মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে দুই সন্তানকে হাতির সম্পর্কে বলছিলেন তিনি।
আলপনা বলেন, “গতকাল খুব খারাপ লেগেছে। কিন্তু আজকে এখানে এসে মনে হলো নিরাপত্তা বেষ্টনী ঠিকঠাকই আছে। ভয়ের আসলে তেমন কিছু নাই।”
কিশোরের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার।
তিনি বলেন, “তদন্তের পরই বলা যাবে আসলে কী ঘটেছিল এবং কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। আজ দুই লাখের ওপরে দর্শনার্থী। কিন্তু কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিন্তু ঘটেনি।”
বাঘ ও হাতিসহ কয়েকটি প্রাণির খাঁচা ও নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও মজবুত করার তথ্য দেন তিনি।
২০২৩ সালে ঈদের প্রথম দিন দর্শনার্থী এসেছিল ৭০ হাজারের মত। দ্বিতীয় দিনে দর্শনার্থী ছিল দুই লাখ।
ঈদ আর বাংলা নববর্ষ মিলিয়ে ছয় দিনের ছুটি থাকায় এবার দর্শনার্থীদের ভিড় আগের তুলনায় বেশি থাকবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
মিরপুর চিড়িয়াখানার সাপ্তাহিক ছুটি রোববার; তবে ঈদের পরের রোববার নববর্ষের দিন খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।