মেট্রোরেলের রুট বাড়লে গরমকালে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন কী ঘটবে– সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
Published : 05 Feb 2024, 12:11 AM
বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত ফেরত যাত্রীদের চাপে রোববারই সবচেয়ে বেশি ভিড়ের চাপে পড়েছিল মেট্রোরেলের উত্তরা উত্তর স্টেশন; আর বিদ্যুৎ বিভ্রাটে এদিনই দেড় ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল, যাত্রীদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে।
মেট্রোরেল পরিচালনাকারী ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, বিদ্যুতের লাইনে ‘ট্রিপ’ করায়, অর্থাৎ সাময়িকভাবে বিদ্যুত চলে যাওয়ায় এই বিপত্তি। কিন্তু কেন পওয়ার ‘ট্রিপ’ করল, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও ডিএমটিসিএলের কাছে এখনও নেই।
আগারগাঁও এলাকায় মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ডেসকোর দাবি, তাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। তাহলে সমস্যা আসলে কোথায় ছিল? সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর এক বছরে বেশ কয়েকবার নানা কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। এরমধ্যে বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে ট্রেন চলাচল এক ঘণ্টার বেশি সময় বন্ধ থেকেছে অন্তত দুইবার।
এর আগে গত বছরের ৯ অগাস্ট সকাল ৯টায় বিদ্যুতিক গোলযোগের কারণে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে সেদিন বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে ফের ট্রেনের চলাচল শুরু হয়।
২০৩০ সালের মধ্যে মেট্রোরেলের আরো পাঁচটি রুট চালুর জন্য কাজ করছে সরকার। এ অবস্থায় গরমকালে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন কী ঘটবে– সে প্রশ্নও সামনে আসছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলছেন, মেট্রোরেলের মত আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় দেড় ঘণ্টা ট্রেন বন্ধ থাকাকে ‘স্বাভাবিক বলা চলে না’। যাই ঘটে থাকুক, অনুসন্ধান করে তার সমাধান বের করা দরকার।
হঠাৎ বন্ধ ট্রেন, স্টেশনে ফিরল ‘ব্যাকআপ পাওয়ারে’
বেলা পৌনে ৩টার দিকে মেট্রোরেলের পথে চলন্ত ট্রেনগুলো হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। পরে জানা যায়, বৈদ্যুতিক লাইনে সমস্যা থেকে এ জটিলতা।
এই সময়ে ট্রেন বন্ধ থাকায় স্টেশনে স্টেশনে ভিড় বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বিভিন্ন স্টেশনের গেইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেকে টিকেট কিনেও যাত্রা বাতিল করেন।
এমআরটি পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মাহমুদ খান সে সময় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কাজীপাড়ায় বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে মেট্রো রেল চলাচল বন্ধ আছে। স্টেশনগুলোয় অনেক যাত্রী জমে যাচ্ছিল। অনেক ধরনের রিউমার শোনা যাচ্ছিল এবং অনেক মানুষ স্টেশনে জড়ো হচ্ছিল। আমরা লোকজনকে মাইকিং করে বৈদ্যুতিক ত্রুটির বিষয়টি জানিয়েছি। পাশাপাশি তাদেরকে অনুরোধ করেছি স্টেশনে ভিড় না করতে।”
লাইনে যাই ঘটে থাকুক, সেটা ‘মেরামত’ করার পর বিকাল সোয়া ৪টার দিকে আবার ট্রেন চলাচল শুরুর খবর দেন ডিএমটিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (ইলেকট্রিক্যাল) মীর মনজুর রহিম।
এই সমস্যার কারণ জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিস্টেম অপারেট করতে হলে ছোটোখাট চ্যালেঞ্জ আসেই। কিন্তু আজকের যে বিষয়টি তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। এটা কি ইন্টারনাল না এক্সটারনাল, আমরা ভালো করে দেখব। আমরা তো কাউকে দোষারোপ করতে পারি না। এবার আমরা বিদ্যুতের অ্যাপ্রোপ্রিয়েট লোক দিয়ে ইনকোয়ারি করছি।”
দেশের প্রথম মেট্রোরেলে জরুরি সময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই এই প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়।
সে সময় ডিএমটিসিএল জানায়, ঢাকা মেট্রোরেলে এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম বা ইএসএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। চলাচলের সময় ট্রেনের ব্রেকিং সিস্টেম থেকে চার্জ হতে থাকবে ব্যাটারি। কোনো কারণে কোনো সময় জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া না গেলে মেট্রোরেলের ইএসএস থেকে বিদ্যুৎ সরাবরাহ করে মেট্রো ট্রেনকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসা হবে।
রোববারের ঘটনায় এ প্রযুক্তি কাজ করেছে কি না জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়া ট্রেনগুলোকে স্টেশন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ প্রযুক্তি শুধু জরুরি সময়ের জন্য। পুরোদমে ট্রেন চলাচলের জন্য নয়।
“আমাদের এই ব্যাকআপটা একটা ট্রেনকে আট-দশবার চালাতে পারবে। কিন্তু আজকে আমাদের আটটি ট্রেন বিভিন্ন জায়গায় আটকে ছিল। ওই ট্রেনগুলোকে ব্যাটারির ব্যাকআপ দিয়ে নিয়ে এসে দরজা খুলে যাত্রীদের স্টেশনে নামিয়ে দিতে হয়েছে।”
এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, “ব্যাকআপ সমস্যা নয়, সমস্যা হয়েছে ‘ট্রিপ’ করার কারণে। লাইনে কোনো সমস্যা হলে সার্কিট ব্রেকার পড়ে যাবে। আমাদের এখানে যেহেতু একটা সিস্টেমের মাধ্যমে চলে, সেহেতু সার্কিট ব্রেকার পড়ে যাওয়া মানেই তো বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। যেখানে যে ট্রেনটা আছে সেটা থেমে যাবে।”
বিদ্যুৎ ‘ট্রিপ’ করেছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা জানার জন্যই আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত হলে আসল কারণটি জানা যাবে। এখন এ বিষয়ে কোনো কথা বললে তা ঠিক হবে না।”
সামনে মেট্রো রেলের আরও অনেকগুলো রুট চালু হবে, ট্রেনের সংখ্যা বাড়লে বিদ্যুৎ সঙ্কট কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “আমি তা মনে করি না। আমরা তো মেট্রো রেল চালাচ্ছি এক বছর। দীর্ঘ সময় ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ আছে এমন ঘটনা তো আজকেরটিসহ দুইবার হয়েছে।”
তিনি বলেন, ঢাকায় মেট্রো রেল চালু হওয়ার পর এ ধরনের বিদ্যুতজনিত কারণে ছোটখাট কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, তবে সেগুলো তেমন বড় ছিল না।
“এর আগে যেবার ঘটনায় ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল কিছু সময়, সেটার তদন্ত আমরা করেছি। সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করেছি। সে ধরনের সমস্যা আর হচ্ছে না।”
ডেসকো যা বলছে
মেট্রোরেল পরিচালনায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য উত্তরা ডিপো এবং মতিঝিল এলাকায় দুটি রিসিভিং সাবস্টেশন রয়েছে।
মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মানিকনগর গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির দুটি পৃথক সার্কিট; উত্তরা রিসিভিং সাবস্টেশনে পিজিসিবির টঙ্গী গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির একটি সার্কিট এবং ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) উত্তরা গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ১৩২ কেভির অপর একটি সার্কিটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাচ্ছে।
উভয় রিসিভিং সাবস্টেশনে ব্যাকআপ হিসেবে একটি করে অতিরিক্ত ট্রান্সফর্মার রয়েছে। পুরাতন বিমানবন্দর এলাকায় ডেসকোর ৩৩ কেভি সাবস্টেশন থেকে শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনে ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে।
রোববারের ঘটনাটি আগারগাঁও এলাকায়। ওই অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডেসকো। সরবরাহ পর্যায় থেকে কোনো ধরনের সমস্যা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের প্রান্ত থেকে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। মেট্রোরেলের কোথাও কোনো ত্রুটি থাকতে পারে।
“আমরা মেট্রোরেলে যে ১৩২ কেভি সরবরাহ লাইন দিয়েছি তা বিভিন্ন জায়গা থেকে সংযোগ দেওয়া। একটা যদি কোনো কারণে বন্ধ জহয়, অন্যটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে। এছাড়া আগারগাঁও থেকে ২৫ কেভির আরেকটা কানেকশন দেওয়া আছে। যেভাবেই হোক আমাদের এন্ড থেকে মেট্রোরেল পাওয়ার পাচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এতটা সময় ধরে ট্রেন বন্ধ থাকা গ্রহণযোগ্য নয়।
বুয়েটের দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টফোর ডটকমকে বলেন, সিগন্যালে ত্রুটি, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মেট্রোরেলের চলাচল ব্যাহত হয়। তবে বিদ্যুতের কারণে এমন নজির কম।
“মেট্রোরেল আরবান কমফোর্ট। এটা দ্রুতগামী একটা পরিবহন এবং যাত্রীরা স্বস্তির জন্যই মেট্রো রেল বেছে নিয়েছে। সেখানে এ ধরনের ঘটনা বারবার হওয়াকে আমি স্বাভাবিক হিসেবে দেখছি না। যদি ন্যাশনাল গ্রিড ফেইল করে সেটা ডিফারেন্ট, কিন্তু এত ব্যাকআপ থাকার পরেও বারবার কেন হচ্ছে তা অনুসন্ধান করাটা জরুরি।”
তিনি বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটি হতে পারে ধরে নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে। গণপরিবহনগুলোর মধ্যে একটি আন্তঃসংযোগ তৈরির মাধ্যমে এটা হতে পারে।
“এই যে এক ঘণ্টা সময় ধরে যাত্রীরা অপেক্ষা করলেন, তাদের বাসে করে গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে আসতে হবে একদম বিনা খরচে।”
পুরনো খবর