হাতে মেহেদীর রঙ নিয়ে স্বজনদের চিরবিদায়

গত শনিবারই বিয়ে হয় হৃদয় ও রিয়ার। তিন দিন বাদে একজন বাবার লাশ নিয়ে গেলেন বাড়িতে, অন্যজন গেলেন মায়ের কফিন নিয়ে।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2022, 06:32 PM
Updated : 16 August 2022, 06:32 PM

স্বামীকে নিয়ে রিয়া আক্তার মনিও ছিলেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে, ময়নাতদন্তের পর এক এক করে বের করা হল পাঁচটি লাশ। এরা সবাই তার মা, খালা, খালাত ভাই-বোন, শ্বশুর।

ডুকরে কেঁদে উঠে রিয়া বলে ওঠেন- “এই লাশ দেখার জন্যই কি আমার বিয়ে হয়েছিল! কষ্টটা ওখানেই।”

রিয়ার হাতে তখনও মেহেদীর রঙ, পাশে থাকা স্বামী রেজাউল করিম হৃদয়কে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি।

গত শনিবারই বিয়ে হয় হৃদয় ও রিয়ার। দুদিন বাদে ঢাকার কাওলার শ্বশুর বাড়ি থেকে যাচ্ছিলেন আশুলিয়ায় নিজের বাড়িতে।

শ্বশুর রুবেল গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। গাড়ির সামনে বাবার সঙ্গে ছিলেন হৃদয়। পেছনে রিয়ার সঙ্গে বসেছিলেন তার মা ফাহিমা (৪০), খালা ঝর্না (২৮) এবং ঝর্নার দুই সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (২)।

উত্তরার জসীম উদ্দীন সড়কে বিআরটি প্রকল্পের একটি ক্রেন গার্ডার নামানোর সময় তা পড়ে সেই প্রাইভেট কারের উপর।

জানালার কাচ কেটে রিয়া ও হৃদয়কে বের করে আনা গেলেও চাপা পড়ে থাকেন অন্য পাঁচজন। পরে তাদের লাশ উদ্ধার করে পাঠানো হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিয়া বলেন, “গার্ডারটি বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঝুলছিল, তার নিচ দিয়ে বেশ কয়েকটা গাড়ি যেতে দেখে বাবা (শ্বশুর রুবেল) কিছুটা স্লো করেন। উপরে দেখে নেন আবার সাহস করে চালাতে গিয়েই....”

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রিয়া বলেন, “আমার শ্বশুর মা-খালাদের সাথে গাড়িতে বেশ মজাই করছিল। বেহাইন, বেহাইন বলে হাসি তামাশা করছিল। বাচ্চারাও নিজেদের মধ্যে খেলছিল।।”

গার্ডারটি যখন গাড়ির উপর পড়ে, তখন বিস্ফোরণের মতো একটি শব্দ শুনেছিলেন রিয়া। এরপর আর কিছু মনে করতে পারেন না তিনি, যখন জ্ঞান ফেরে, তখন নিজেকে আবিষ্কার করেন হাসপাতালে।

মানসিক অবস্থা ভালো নয় বলে রিয়াকে আর কোনো কথা বলতে দিতে চাননি তার স্বজনরা। হৃদয়ও কথা বলতে চাননি।

Also Read: গার্ডার সরাতে ৩ ঘণ্টা: ‘অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির ভেতর মরতে দেখলাম’

Also Read: গার্ডার চাপায় চিড়ে চ্যাপ্টা গাড়ি, ভেতরেই গেল ৫ প্রাণ

ময়নাতদন্ত শেষে রিয়ার মা, খালা এবং দুই শিশু ভাই-বোনের লাশ দুই গাড়িতে করে জামালপুর নেওয়া হয়। আর রুবেলের লাশ আলাদা গাড়িতে মানিকগঞ্জে নেওয়া হয়। সেখান থেকে মেহেরপুরে নিয়ে দাফন করা হবে।

বাবার মরদেহের সঙ্গে হৃদয় মেহেরপুর এবং মায়ের কফিন নিয়ে রিয়া জামালপুর রওনা হন।

ক্রেনের অপারেটর লাপাত্তা

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ক্রেনটি যিনি চালাচ্ছিলেন, তার নাম আল আমীন হোসেন হৃদয় বলে শনাক্ত হয়েছে। তবে তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মোরশেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হৃদয়কে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের নজরদারি চলছে।”

ক্রেন অপারেটর হৃদয়ের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মোরশেদ আশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা শিগগিরই তাকে আইনের আওতায় আনতে পারব।”

উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, “আশা খুব শিগগিরই ভালো কিছু একটা দেখাতে পারব।”

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুণ অর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা এখন পর্যন্ত হৃদয়ের কোনো খোঁজ পাননি। তবে তারা এ ব্যাপারে কাজ করছেন।

একই কথা জানিয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি ক্রেন অপারেটরকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে।”

এই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় ক্রেনের অপরেটর, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অজ্ঞাত ব্যাক্তিদের আসামি করা হয়েছে।