Published : 29 Feb 2024, 12:24 PM
ফেব্রুয়ারি ছাড়িয়েও বাড়তি দুদিন পাওয়ায় প্রকাশক, লেখক, পাঠক- সবার বইমেলা এবার শেষ হচ্ছে বাড়তি আনন্দ নিয়ে, কিন্তু পরের বছরের জন্য থেকে যাচ্ছে খানিকটা সংশয়।
প্রশ্ন উঠেছে, চার দশকের অমর একুশে বইমেলা আগামী বছর বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করা যাবে কি না। গুঞ্জন রটেছে, বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে পূর্বাচলে নিয়ে যাওয়া হবে। বইমেলার মাঠে আর চায়ের আড্ডায় সে আলাপ নানা রকম ডালপালা মেলছে।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো চূড়ান্ত কিছু জানানো হয়নি। তারপরও এই সংশয় কেন?
মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাংলা একাডেমির আট জন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। তারা বলছেন, বর্তমানে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় বইমেলা হচ্ছে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির অংশ হিসেবে মার্চ মাস থেকে কিছু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আগামী বছর তারা বইমেলার জন্য উদ্যানের জায়গা বরাদ্দ দেবে না বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েও দিয়েছে। সে কারণেই প্রশ্ন উঠছে, বইমেলা কোথায় হবে।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গণপূর্ত তো এবারও মেলার আগে জায়গাটি বরাদ্দ দিতে আপত্তি করেছিল। পরে বইমেলার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অনুমতি দিয়েছে। আগামী বছর অনুমতি দেবে না বলছে, পরে হয়ত দিতেও পারে। এটা এখনই বলা যাচ্ছে না।”
যদি অনুমতি না দেয়, তখন বইমেলা কোথায় হবে? এ প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, “আগামী বছর যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অনুমতি না পাওয়া যায়, তখন মেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে চাইব, বইমেলা বাংলা একাডেমিতেই থাকুক। এই বইমেলার সঙ্গে একুশের চেতনা, শহীদ মিনার এবং বাংলা একাডেমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বইমেলার স্থানিক দূরত্ব কোনোভাবেই কাম্য নয়।”
বইমেলা সরিয়ে নেয়ার কোনো নির্দেশনা সরকারের দিক থেকে আছে কিনা জানতে চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
“সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে নান্দনিকতা বৃদ্ধিসহ অনেক ধরনের প্রকল্পের কাজ চলছে। তার বাস্তবায়ন শুরু হলে, ওই জায়গাটি আগামী বছর হয়ত আর ব্যবহার করা যাবে না। এরকম একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বইমেলার ব্যাপারে ভীষণ আন্তরিক। তিনি চাইছেন, বইমেলার জন্য একটা স্থায়ী জায়গা কীভাবে দেওয়া যায়? এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
বইমেলা পূর্বাচলে সরিয়ে নেওয়ার যে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে সচিব বলেন, “এরকম কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।”
প্রকাশকরা কী ভাবছেন?
লেখক-প্রকাশকসহ বইমেলা সংশ্লিষ্টরা চান বইমেলা বাংলা একাডেমি এবং সোহাওয়ার্দী উদ্যানেই হোক। পূর্বাচলে যদি বইমেলায় নেওয়া হয়, তবে প্রকাশরা সেখানে যেতে আগ্রহী নন।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বইমেলা বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হতে হবে। পূর্বাচলে হলে আমাদের প্রকাশকদের কেউই অংশগ্রহণ করবে না। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বরাদ্দ দিতে সমস্যা তো হওয়ার কথা নয়।
“শুনেছি, উদ্যানে সাংস্কৃতিক বলয়ের জন্য কিছু প্রকল্পের কাজ হবে এবং উদ্যানের নান্দনিকতা বাড়ানোর কাজও হবে। উদ্যানে তো নিশ্চয় কোনো স্থাপনা করা হচ্ছে না। এটা পার্কই হবে। আর সাংস্কৃতিক বলয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ তো বই। পার্ক মানেই তো মানুষের সমাগম। তাহলে এখানে বইমেলা হলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
কবি শাহেদ কায়েস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিত্তরঞ্জন সাহা একুশের চেতনাকে ধারণ করে কিন্তু বাংলা একাডেমিতে এই বইমেলা শুরু করেছিলেন। ফলে এখান থেকে মেলা সরিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক হবে না।”
বিকল্প ভাবনা জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলা একাডেমির পাশেই পরমাণু শক্তি কমিশন। শুনেছি এ প্রতিষ্ঠানের কাজের ব্যপ্তি অনুযায়ী তাদের আরও বড় জায়গা প্রয়োজন। যতদূর জেনেছি, তারা সেটা পেয়েছেও। পরমাণু শক্তি কমিশনের এখনকার জায়গাটি বইমেলার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। বাংলা একাডেমি এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের মাঝের দেয়ালটি ভেঙে দিয়ে এখানে সারা বছরই উন্মুক্ত উৎসবসহ নানা রকম সাংস্কৃতিক আয়োজন করা যেতে পারে।”
বাংলাদেশের বই ও বইমেলা নিয়ে ‘ষড়যন্ত্র চলছে’ মন্তব্য করে কয়েকটি দাবি নিয়ে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছন লেখক মাহবুব মোর্শেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বইমেলা আয়োজনের স্থান একুশের স্মৃতি বিজড়িত বাংলা একডেমি ও সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই রাখতে হবে। কোনো অজুহাতেই এটা স্থানান্তর বা বন্ধ করা যাবে না। একুশে বই মেলার জাতীয় চরিত্র ক্ষুণ্ন করা যাবে না। বাংলাদেশে প্রকাশিত বই ছাড়া অন্য দেশে প্রকাশিত বই এ মেলায় বিক্রি ও প্রদর্শন করা যাবে না।”
মেলায় দেশের ছোট-বড় সকল প্রকাশনীকে স্থান দেওয়ার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে ভালো জায়গা দেওয়ার এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশিত বই বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার দাবি জানান মাহবুব মোর্শেদ।
তিনি বলেন, “ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রকাশিত বইসহ অন্য দেশে প্রকাশিত বই বিক্রি ও প্রদর্শনীর জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র বা সেরকম কোনো স্থানে পয়লা বৈশাখ বা ১৬ ডিসেম্বর ঘিরে ঢাকা আন্তর্জাতিক বই মেলা আয়োজন করতে হবে। বাংলাদেশের বই বিপণন কেন্দ্রগুলোতে অন্য দেশের বইয়ের পাশাপাশি বিক্রির জন্য বাংলাদেশের ৫০% বইয়ের প্রদর্শনী নিশ্চিত করতে হবে। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে সকল সেন্সরশিপ, ভিন্নমত দমনের পদক্ষেপ বন্ধ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।”
ইতিহাসের পাতা থেকে
১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা।
১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা।
১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।
মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে।
২০২০ সালের মেলার উদ্বোধনপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে ‘গ্রন্থমেলা’র পরিবর্তে ‘বইমেলা’ শব্দটি ব্যবহার অধিক শ্রুতিমধুর ও পাঠকপ্রিয় হবে বলে মত প্রকাশ করেন। এর পরের বছর বইমেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।
ধীরে ধীরে বইমেলার পরিসর বাড়তে থাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আর জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। পরে একাডেমির সামনের সড়কেও বইমেলার স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তবে মেলার মূল মঞ্চ এবং তথ্যকেন্দ্র রাখা হয় একাডেমি প্রাঙ্গণেই।
বিগত এক দশক ধরে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হচ্ছে বইমেলা।