বাংলাদেশের ৫২ বছরের পথযাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো খুব কাছ থেকে দেখা জুলিয়ান ফ্রান্সিস মনে করেন, বৈষম্য কমাতে হলে কর আদায় এবং সামাজিক সুরক্ষায় মনোযোগ বাড়াতে হবে সরকারকে।
Published : 07 May 2023, 03:01 PM
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভাবনীয় উন্নয়নে বাংলাদেশে অতি দরিদ্রের সংখ্যা কমে এলেও সমাজের উঁচু ও নিচু তলার বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যবধান আরও বেড়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে তিনি বলছেন, “এটা খুব স্পষ্ট যে, খুব ধনী ও খুব গরিবের মধ্যে ফারাক বড় হচ্ছে। যদিও অতি দারিদ্র্য বেশ কমেছে, ১০ থেকে ১৪ শতাংশ মানুষ এখনো খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছে।”
জুলিয়ান ফ্রান্সিসের মতে, এর সমাধান আছে কর আদায় এবং সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে।
“প্রত্যেকে একমত হবেন, জনগণের যে কর পরিশোধ করা উচিত সেটা যদি পরিশোধ করে, তাহলে প্রয়োজন মেটানোর জন্য সরকার বেশি অর্থ পাবে। আর তখন যাদেরকে সাহায্য করা প্রয়োজন, তাদেরকে সামাজিক কল্যাণ অনুদান দিয়ে সহায়তা করা যাবে।”
অথচ যাদের আয়কর দেওয়াই উচিত, তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করেও এক ধরনের আত্মতুষ্টিতে ভোগার প্রবণতা দেখার কথা বলছেন জন্মসূত্রে ব্রিটিশ এই উন্নয়নকর্মী।
অক্সফামের হয়ে কাজের সূত্রে একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালি শরণার্থীদের সহায়তার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হয়ে ওঠেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
একাত্তরের সেই আত্মার বন্ধনে বাংলাদেশে থিতু হওয়া জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে ২০১৮ সালে নাগরিকত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এর আগে ২০১২ সালে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু’ সম্মাননা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, কোচবিহারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছয় লাখের বেশি বাংলাদেশি শরণার্থীর মধ্যে অক্সফামের শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচির সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।
বাহাত্তরের জানুয়ারিতে ঢাকায় এলেও উত্তর ভারতে অক্সফামের কাজে দিল্লিতে ফিরে যান; সেখানে ১৯৭৮ পর্যন্ত থাকার পর ফিরে আসেন ঢাকায়।
এরপর ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় অক্সফামের বিভিন্ন প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় থেকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে কানাডিয়ান দাতব্য সংস্থা সিইউএসও’র হয়ে কাজ করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের বন্যা এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় ত্রাণ তৎপরতায় ভূমিকা রাখেন।
এরপর জাকার্তায় সিইউএসও-র আঞ্চলিক কার্যালয়ে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় ফিরে রেড ক্রসের সঙ্গে যুক্ত হন এবং সংস্থার বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকার জন্য ২০১৮ ‘অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার’ বা ওবিই সম্মাননা পান জুলিয়ান ফ্রান্সিস। ২০২২ সালে তাকে যৌথভাবে ‘বঙ্গবন্ধু-এডওয়ার্ড হিথ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাওয়ার্ড’ দেয় ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাদেশের ৫২ বছরের পথযাত্রার চ্যালেঞ্জগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস; সেগুলো তুলে ধরতে লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন।
ইনসাইড আউটে অতিথি হয়ে এসে তিনি মেলে ধরেছেন একাত্তরের স্মৃতির ঝাঁপি; পরের পাঁচ দশকে নানা উত্থান-পতনে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পথকে তিনি দেখেছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে।
শত বিপদের মধ্যেও টিকে থাকার লড়াইয়ে এ দেশের মানুষের দৃঢ়তা জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে মুগ্ধ করেছে। আর এখন, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশের রাজনীতি আর সংস্কৃতি এবং সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েও নিজের ভাবনার কথা তিনি বলেছেন।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এই সর্বশেষ পর্বটি।
দূষণ, দুর্নীতি, রাজনীতি
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু শিল্প স্থাপন বা আবাসন নির্মাণের জন্য কতটুকু কৃষিজমি ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া দরকার বলে মনে করেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। তার ভাষায়, এটা এখন ‘বড় প্রশ্ন’।
“দূষণ রোধের জন্য সরকারকে আরও অনেক কাজ করতে হতে হবে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশকে যে দূষণ মোকাবেল করতে হচ্ছে তা নয়, এমনকি যুক্তরাজ্যেও খুব বাজেভাবে নদী দূষণ হয়।
“পরিবেশগত অনেক সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। আপনি জানেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বাজে বায়ুমান যেসব এলাকার, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এখানে আরও অনেক কিছু করতে হবে।”
দূষণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি দূর করারও তাগিদ দেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিতার আওতায় আসছে না, পার পেয়ে যাচ্ছে। আর এখানেই চলে আসছে দুর্নীতির প্রসঙ্গ, যা তার ভাষায় ‘দুর্ভাগ্যজন’। এ কারণে তিনি দুর্নীতি নিয়ে বেশ লেখালেখিও করেছেন।
উচ্চ শিক্ষার জন্য এ দেশের তরুণদের বিদেশমুখী হওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেকে বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসতে চায়। তাদের এই চারিত্রিক শক্তিতে তিনি ‘অভিভূত’।
“যে কেউ চাইবে শিক্ষার মান যাতে ভালো হয় এবং তা যেন সবার জন্য উন্মুক্ত হয়। এখানে সমস্যা হল, দেখা যায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী রয়েছে, কিন্তু তারা দরিদ্র পরিবারের, তাদের জন্য ভালো শিক্ষা পাওয়া কঠিন।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘প্রাণবন্ত বিরোধী’ দল না থাকলেও এ দেশের সংস্কৃতি বেশ শক্তিশালী বলে মনে করেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “কেউ এটা নিয়ে বিতর্ক করতে পারে, তবে অবশ্যই শক্তিশালী সংসদীয় গণতন্ত্র নির্ভর করে প্রাণবন্ত বিরোধীদলের ওপর।
“দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দেশে সেটা যেভাবে পাওয়ার কথা, সেভাবে আমরা পাইনি। সুতরাং এটা এক ধরনের উদ্বেগের বিষয়।”
সহায়তা নিয়ে শরণার্থীদের পাশে
অক্সফামের কাজে ভারতের বিহারে থাকার সময় পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তেজনা আর বিশৃঙ্খলার খবর পৌঁছাতে থাকে জুলিয়ান ফ্রান্সিসদের কাছে। সত্তরের বন্যা আর নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আন্দোলনে বাংলাদেশ তখন অগ্নিগর্ভ।
“বিহারের গায়া নামের যে জায়গায় আমি ছিলাম, সেখানে ছোট একটি বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস। তারা বেশ উত্তেজিত ছিল সেইসব খবর নিয়ে। এর মধ্যে আমরা অস্থিরতা, পুলিশের গুলির বিষয় জানতে পারি, শুনতে পাই ক্র্যাকডাউন আর ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের বিষয়।”
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অক্সফামের হয়ে কাজ করেন– এমন একজন যুদ্ধের শুরুর দিকেই ধারণা দিয়েছিলেন, এক কোটির বেশি মানুষ পালিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে। অক্সফাম তখন তার কথায় গুরুত্ব দেয়নি।
“কিন্তু খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের সীমান্ত এলাকায় চলে যেতে বলা হল। তখন আমরা তাদের জানালন, একেক সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন ২০ হাজার, ৩০ হাজার করে লোক ভারতে ঢুকছে।”
সে সময় খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় হিসাব-নিকাশ সারতে হয় সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে। ভারত সরকারও তখন ত্রাণ সহায়তা পেয়ে গেছে এবং আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও খাদ্য সরবরাহের মত মৌলিক চাহিদা পূরণে মনোযোগ দিয়েছে।
“কিন্তু আরও অনেক ধরনের প্রয়োজন সেখানে ছিল, যেমন- স্যানিটেশন, খাদ্য ও পুষ্টি, বিশেষ করে স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছিল,” বলেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
তিনি বলেন, অনেক দূর থেকে মানুষ যাচ্ছিল আশ্রয় শিবিরে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বাজেভাবে আহত ছিলেন। দিনের পর দিন হাঁটার কারণে কেউ কেউ ক্ষুধা আর পুষ্টিহীনতায় ভুগছিলেন। এসব ক্ষেত্রে অক্সফামের মত ছোট সংস্থাগুলো এবং ভারত সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক বেশি।
“কোথা থেকে শুরু করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই কঠিন ছিল। আমাদেরকে ভারত সরকারের সঙ্গে খুব নিবিড়ভাবে কাজ করতে হয়েছে। আমরা আমাদের ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিশেষ করে গান্ধীবাদী সংগঠনের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো যোগাযোগ ছিল।
“আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কলকাতা থেকে অনেক দূরে গিয়ে কাজ করব, কারণ অন্য বেশিরভাগ বিদেশি সংস্থার কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত ছিল এমন জায়গায়, যেখানে কলকাতা থেকে পৌঁছানো সহজ।”
এই চিন্তা থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসামের দিকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় অক্সফাম। সেখানে ছয় লাখ শরণার্থী ত্রাণ কর্মসূচি সমন্বয়ের দায়িত্ব পান জুলিয়ান ফ্রান্সিসের ওপর।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, ওই সময় স্বাস্থ্য সমস্যা ছিল ভয়াবহ। কলেরা আর ক্রনিক ডায়রিয়ার প্রকোপ ছিল, অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল তাতে।
“স্যাটিনেশন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা ছিল খুবই কঠিন। এর মধ্যে দেখা দিল চর্মরোগ, ৪০ গ্যালনের বহু ড্রাম স্কাইবিওল লোশন আমরা কিনেছি ওই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য।”
পরে ঢাকার কলেরা গবেষণা কেন্দ্রে (বর্তমান আইসিডিডিআর, বি) উদ্ভবিত ওর্যাল স্যালাইন শরণার্থী শিবিরে খাওয়ানো শুরু হলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা জানান জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
তিনি বলেন, “আমেরিকান চিকিৎসক, যাদেরকে এখান (ঢাকা) থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তারা সেই জ্ঞান শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দেন। কোনো কোনো ক্যাম্পে ৩০ শতাংশ মৃত্যু ছিল কলেরার কারণে, যেখানে আমরা ওআরএস ব্যবহার করতে পেরেছি, সেখানে মৃতের হার প্রায় ৩ শতাংশে নেমে আসে।“
যুদ্ধ শেষে অল্প সময়ের মধ্যে এক কোটি শরণার্থীকে দেশে ফেরানো সম্ভব হওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, “ভারত সরকারের সহযোগিতার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। আর আশ্রয় শিবিরের মানুষও দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ ছিল।
“এ কারণে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রায় সব শরণার্থী ফিরে আসে। আমরা সীমান্তে শুকনা খাবার তুলে দিয়েছিলাম, যাতে মানুষ খাবার নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।”
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখার কথা জানান জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
তিনি বলেন, “শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফেরি। তারপরও ওই সময়ে মানুষের মধ্যে আনন্দ ছিল যে, বঙ্গবন্ধু (পাকিস্তানের কারাগর থেকে দেশে) ফিরেছেন।”
যুদ্ধবিধ্বস্ত সেই বাংলাদেশ আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞের। সে বিষয়ে এক প্রশ্নে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, “মার্চের মধ্যে মানুষ যখন বুঝতে পারল, ব্যাপকমাত্রার ক্ষতি হয়েছে, খাদ্য সরবরাহের জটিলতা রয়েছে, সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তারা খুব সন্দিহান ছিলেন যে, দ্রুত খাদ্য সরবরাহ যদি নিশ্চিত করা না যায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি পুনঃস্থাপন করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র হিসাবে বেঁচে থাকতে পারবে কি-না।”
কিন্তু সেই অবস্থা থেকে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর মনোবলের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশিরা হচ্ছে বিশেষভাবে কর্মঠ, তারা যে কোনোভাবেই হোক, সহনশীল এবং তারা জানে কীভাবে বাঁচতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও উপকূলীয় এলাকার মানুষ।
“সেখানে হয়ত দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি সেভাবে নেই, কিন্তু তারা বেঁচে থাকে এবং সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ায়।”
বন্যাদুর্গত আর শরণার্থীদের সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশে অক্সফামের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, পরে তা উন্নয়ন সহযোগিতার রূপ নেয়। অক্সফামও বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপান করছে।
এই যাত্রাপথের কথা তুলে ধরে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, “বিষয়টা এমন ছিল যে, তুমি যদি এসব স্কিমে সফল হও, তাহলে তুমি মানবিক সমস্যা প্রতিরোধ করতে পারবে এবং দুর্যোগের কাছে মানুষের আত্মসমর্পণ রুখতে পারবে।”
অক্সফাম এখন কোন দিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে পারে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদারসহ সবার সঙ্গে মিলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একযোগে কাজ করতে চায় অক্সফাম।
“কারণ, বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, ঋতু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতে নানা বিঘ্ন দেখা যাচ্ছে। আমরা সম্প্রতি ৫৮ বছরের সবচেয়ে উষ্ণ দিন দেখেছি। সুতরাং এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।“
নারী-পুরুষ সমতার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কিছু করা দরকার জানিয়ে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, “আরও বেশি কিছু করার এবং আরও উদ্যোগ নিতে সরকারকে সহযোগিতা করা দরকার, যেমন বাল্যবিয়ের মত ক্ষেত্রে।
“এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং এসব চ্যালেঞ্জ বেশি হচ্ছে (বিত্তের হিসেবে) নিচের দিকে, ১০ বা ১৫ শতাংশের।”
নানা রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে গত পাঁচটি দশক পার করেছে বাংলাদেশ। তাতে কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, হরতালের মত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কাজের ব্যাঘাত হয়েছে, তবে দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে সেটা বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারেনি বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান জুলিয়ান ফ্রান্সিস।
‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি’
১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর অক্সফামের জনসংযোগ বিভাগ ‘দ্য টেস্টিমনি অব সিক্সটি: অন দ্য ক্রাইসিস ইন বেঙ্গল’ নামে একটি প্রকাশনা বের করে, যাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অক্সফামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৬০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখায় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং শরণার্থীদের দুর্ভোগের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয় ওই প্রকাশনায়।
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, শরণার্থী সংকটের খবর দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পত্রিকার প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশনের শীর্ষ খবরে ধরে রাখা কঠিন। সে কারণে ওই প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যাতে একটা ধাক্কা দেওয়া যায়।
অক্সফামের জনসংযোগ বিভাগ পরিকল্পনা করে, পৃথিবীকে ‘জাগিয়ে তোলার জন্য’ একটি দলিল তৈরি করতে হবে। যারা বাংলাদেশে কাজ করছে বা ঘুরে এসেছে তাদের বর্ণনাগুলো একসঙ্গে করে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করে তারা।
পরে অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সেটি তুলে ধরার কথা স্মরণ করে জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, “সাধারণ পরিষদে টেস্টিমোনি অব সিক্সটি প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে এই দলিলকে সেনেটে নিয়ে যান এডওয়ার্ড কেনেডি এবং বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় কী ঘটছে তা জানতে ওই দলিল গ্রহণ করার প্রস্তাব তোলেন।
“কোনো বিরোধিতা না থাকায় পুরো টেক্সটকে সেনেটের কনগ্রেশনাল রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ মার্কিন সরকার সে সময় পাকিস্তানের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল।”
হৃদয়ে বাংলাদেশ
জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকার স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব তার জন্য বিরাট সম্মানের।
তিনি বলেন, “এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেগুলোতে আমি সহযোগিতা করতে চাই বা লিখতে চাই। এ কারণে আমি এখনো এখানে।”
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি কোনো কোনো সময় অনুভব করি, আমি হয়ত খানিকটা বেশিই সম্মান পেয়েছি। কারণ, আমি যেটাই করছিলাম, আমি হয়ত কোনো টিমের নেতৃত্বে বা দলের অংশ ছিলাম, এখানে অনেকেই ছিলেন, যারা এই পুরস্কারের অংশ, তারা ছাড়া আমার নাম কোথাও থাকত না।”
আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছেন জুলিয়ান ফ্রান্সিস? তিনি বলেন, “হয়ত আমি হারিয়ে যাব, কিংবা উত্তরের কোনো গ্রামে গিয়ে থাকব, কৃষি নিয়ে লেখালেখি করব।
“আমার মূল ব্যাকগ্রাউন্ড কিন্তু অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি নিয়ে। আমি এমনও স্বপ্ন দেখি, হয়ত কিছু গাভীর দেখাশোনা করব, টাটকা দুধ খাব।”