“চোখের সামনে আটটা দিন ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে রাজীব তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। অথচ এই সম্ভাব্য পরিণতির কোনো আভাসই চিকিৎসকরা রাজীবকে আইসিউতে নেওয়ার আগে দেননি।”
Published : 07 Mar 2024, 07:22 PM
চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে ‘ভুল চিকিৎসায় ও চিকিৎসার অবহেলায়’ এক স্থপতির মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
রাজীব আহমেদ নামের ৩৮ বছর বয়সী ওই স্থপতি ‘রুফলাইনার্স- স্টুডিও অব আর্কিটেকচার’ নামে একটি ফার্মে কাজ করতেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৩ ব্যাচের এই শিক্ষার্থী গত ১৪ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
রাজীবের স্ত্রী স্থপতি সারাওয়াত ইকবাল বলছেন, তার স্বামীর মৃত্যুর ‘দায়’ মূলত শমরিতা হাসপাতালের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এম ইউ কবীর চৌধুরী। তার ‘ভুল চিকিৎসায়’ রাজীব অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এবং সেখান থেকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে এই অভিযোগ তুলে ধরেন রাজীবের স্ত্রী সারাওয়াত এবং তার বড় ভাই চিকিৎসক আরেফ উদ্দিন আহমেদ।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে ডা.কবীর চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। আর স্কয়ার হাসপাতাল বলেছে, তাদের চিকিৎসায় অবহেলার কোনো ‘সুযোগ নেই’।
রাজীবের পরিবারের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত দেড় বছর ধরে তিনি ডা. এম ইউ কবীর চৌধুরীর অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত ২২ জানুয়ারি নিয়মিত ফলোআপের অংশ হিসেবে ওই চিকিৎসকের কাছে গেলে আগের ওষুধগুলোর সঙ্গে নতুন করে অ্যাসিট্রেটিন ১০ এমজি ক্যাপসুল দিনে একটি করে খেতে দেন।
ওই ওষুধ খাওয়া শুরুর পর ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজীবের জ্বর ও পেট ব্যথা শুরু হয়। ব্যথা বাড়তে থাকলে ৬ ফেব্রুয়ারি ডা. কবীর চৌধুরীর কাছে যান। তবে তিনি সেসময় না থাকায় রাজীবকে স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।
রাজীবের স্ত্রী সারাওয়াত বলেন, “ইমার্জেন্সিতে বলা হয় নতুন ওষুধের কারণে লিভারে রিঅ্যাকশন হয়েছে। রাজীবকে জেনারেল সার্জনকে দেখাতে বলা হয়। এরইমধ্যে ব্যথা আরো বাড়লে তাকে কবীর চৌধুরীর কাছে আবার নেওয়া হয়।
“শমরিতায় শিরাপথে দুটি অ্যান্টিবায়োটিক এবং স্কয়ারে আটটি অ্যান্টিবায়োটিক মিলিয়ে মোট ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় তাকে। এগুলোর ব্যাপক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিষক্রিয়া বোধহয় রাজীবের অকাল মৃত্যু হয়েছে।”
রাজীবের স্ত্রীর অভিযোগ, “শমরিতায় লিভার এনজাইমগুলোর মাত্রা অনেক বেশি থাকার পরও তারা লিভার ফেইলিওরের ডায়াগনোসিসকে আড়াল করে অন্য ডায়াগনোসিস উল্লেখ করে। স্কয়ার হাসপাতালে রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ার পরেও কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরিদর্শনে আসেননি। সুনির্দিষ্ট ডায়াগনসিস না করে কালক্ষেপণ করা হয়।”
তিনি বলেন, চোখের সামনে আটটা দিন ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে রাজীব তিলেতিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। অথচ এই সম্ভাব্য পরিণতির কোনো আভাসই চিকিৎসকরা রাজীবকে আইসিউতে নেওয়ার আগে দেননি। এই ‘কালক্ষেপণ, সঠিক ও সময়োচিত ব্রিফিংয়ের অভাব’ রাজীবকে না ফেরার পথে নিয়ে যায়।
“সময়মত চিকিৎসকরা অসুস্থতার তীব্রতা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত করলে আমরা তাকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতাম। কারণ, আমাদের দেশে লিভার ডায়ালাইসিসের কোনো সুবিধা নেই।”
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমএন্ডডিসি) অভিযোগ দেওয়ার কথা জানান সারাওয়াত। প্রতিবাদে বুধবার বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধনও করেন তার পরিবার ও সহপাঠীরা।
এ ঘটনায় মামলা করবেন কিনা- এমন প্রশ্নে রাজীবের স্ত্রী বলেন, “বিএমএন্ডডিসিতে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা কী ব্যবস্থা নেন, সেটি দেখে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
অন্যদের মধ্যে স্থপতি নবী নেওয়াজ খান ও রাজীবের ছোট বোন তানিয়া শবনম সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে শমরিতা হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার নুরুল ইসলাম তুহিনকে ফোন করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারছি না। এটা ডা. কবীর চৌধুরী বলতে পারবেন।”
এ কথা বলে তিনি ফোন কেটে দেন। আর কয়েকবার ফোন করার পরও ডা.কবীর চৌধুরী ফোন ধরেননি।
স্কয়ার হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউসুফ সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওই রোগী স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু তখন কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আজ খবরে এই অভিযোগ দেখে আমরা খুব অবাক হলাম।
“এ ধরনের কোনো অভিযোগ তখন কেউ করেনি। তাদের স্পেসিফিক অভিযোগ কী জানতে পারলে ভালো হতো। তারা বলেছেন আমাদের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কেউ তাকে দেখেনি। কিন্তু আমাদের সবাই তো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আমাদের নিজেদের এমপ্লয়ি। তারা বাইরে রোগী দেখেন না, সো তাদের কোনো অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।”
বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
এদিকে রাজীব আহমেদের মৃত্যুতে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন স্থপতিরা।
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় বুয়েটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে স্থপতিদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এই দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধনে স্থপতি রাজীবের সহপাঠী, বুয়েট আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের নেতা ও রাজীবের পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন।
মানববন্ধনে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের সহ-সভাপতি মাহফুজুল হক জগলুল বলেন, “আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখেছি রাজীবের চিকিৎসায় মেডিকেল নেগলিজেন্সির প্রমাণ পাওয়া গেছে এবং তার মেডিকেল রিপোর্টিংয়ে অসামঞ্জস্য ও অধারাবাহিকতা পাওয়া গিয়েছে।
"ওর পরিবারের পক্ষ থেকে বিএমডিসিতে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, আমরা এর সাথে সংহতি প্রকাশ করছি। আমরা ও ডাক্তাররা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার সাথে জড়িত। তাদেরকে আমরা সম্মান করেই আমাদের অভিযোগ জানাচ্ছি এবং সুষ্ঠুভাবে বিবেচনা করবেন।”
তিনি বলেন, “এই বিচার আমরা শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে দাবি করছি। যদি আমরা এর প্রতিকার না পাই, আমরা কিন্তু ঘরে বসে থাকব না, পথে নেমে আসব। আমরা স্থপতি সমাজ এর সুবিচার গ্রহণ করেই ঘরে ফিরবে। কেননা ওর দুটি নিষ্পাপ কন্যা সন্তানের সামনে আমরা তাহলে দাঁড়াতে পারব না।”
মানববন্ধনে বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি নবী নেওয়াজ খান বলেন, “আমাদের স্থাপত্য পেশায় যে অনিয়ম হত, যে দুর্নীতি হত তার বিরুদ্ধে সে ( রাজীব) সবসময় সোচ্চার ছিল। সে আমাকে বলেছিল, যদি আমি এ কাজ শেষ না করি তাহলে আমি ডিজাইন টেবিলে বসতে পারব না। এটা আমার বিবেকে তাড়না করবে৷
“ওর সেই কথা আমার এখনো মনে আছে। ওর ক্ষেত্রে যে অন্যায়টা হল, ওর যে অকালে প্রাণ ঝরে গেল সেই অন্যায়কে যদি আমরা অ্যাড্রেস না করি তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য দুরূহ হবে ডিজাইন টেবিলে বসা। আমরা ন্যায়বিচারের জন্য শেষ বিন্দু পর্যন্ত লড়ব। আমাদের ইন্সটিটিউট, স্থপতি সমাজের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত লড়ব।”