বঙ্গবন্ধু হত্যা: এখনও অধরা ৫ খুনি

তাদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বারবার দাবির পরও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2022, 06:05 AM
Updated : 15 August 2022, 06:05 AM

দুই দফায় ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর হলেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকি পাঁচ খুনি এখনও রয়েছে অধরা।

তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী।

এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের বারবার দাবির পরও তাদের ফেরত পাঠানো হয়নি।

বাকি তিনজনের কোনো খোঁজ এখন পর্যন্ত পায়নি সরকার কিংবা গোয়েন্দারা। মোসলেম উদ্দিন ভারতে আছেন বলে গত বছর পত্রিকায় খবর এলেও তার ‘সত্যতা নিশ্চিত’ হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে।

এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে।

বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।

এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান।

তার প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ৬ জনের একজন ৭২ বছর বয়সি মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।

তখন গোয়েন্দারা বলেছিলে, মাজেদ এতদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর সময় দেশে ফেরেন।

পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। তবে রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা নাকচ হওয়ার পর কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

তখনই কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে খবর এসেছিল যে পলাতক বাকি পাঁচজনের একজন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েছেন।

ওই খবর পেয়ে নড়েচড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ সরকার, ভারতের এনসিবির কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকাশিত খবরটি ‘সত্য নয়’।

যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সে দেশের সরকার পর্যালোচনার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে দুই বছর আগে খবর এসেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ২০২০ সালের ১৭ জুন দেশটির ইমিগ্রেশন আপিল বোর্ডের কাছে রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয় মামলার নথি পর্যালোচনার জন্য তলব করেছিলেন।

মার্কিন সাময়িকী পলিটিকো তখন লিখেছিল, বারের এই পদক্ষেপের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে তার রাজনৈতিক আশ্রয় হারাতে পারেন এবং তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোও হতে পারে।

রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে ওই বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সেই উদ্যোগের কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত নেই।

অন্যদিকে আইনি জটিলতার কারণে কানাডা থেকে নূর চৌধুরীকেও ফিরিয়ে আনতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ কানাডা শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।

এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে সোমবার কানাডায় বাংলাদেশ হাই কমিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, কানাডা বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম দেশ এবং দুই দেশের সম্পর্কও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু “জঘন্য ও সাজাপ্রাপ্ত খুনি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর বিষয়টা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসাবে বিরাজমান রয়েছে।

“কানাডার বাংলাদেশ হাই কমিশন সাজাপ্রাপ্ত খুনি নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সম্ভাব্য সকল বাধা নিরসনে সংশ্লিষ্ট কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।”

রশীদ ও ডালিম যে কোথায় আছেন, তার তালাশ এখনও পায়নি দেশের গোয়েন্দারা। পুলিশ সদরদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, তাদের ’অবস্থান সনাক্তকৃত নয়’। ডালিমের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ পাকিস্তান কিংবা লিবিয়া আর রশীদের ‘সম্ভাব্য অবস্থান’ লিবিয়া কিংবা জিম্বাবুয়ে।

ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) বরাবরের মতোই বলছে, পলাতক খুনিদের আনতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আর তাদের সবার নামেই ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি আছে।