মনিপুর স্কুল: কর্তৃত্বের রেষারেষিতে বিপর্যস্ত এক শিশু কানন

“এই স্কুলের কোটি কোটি টাকা, এই টাকা আত্মসাতের জন্যই এসব ঝামেলা,” বলেন এক শিক্ষক।

শাহরিয়ার নোবেলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2023, 07:35 PM
Updated : 23 May 2023, 07:35 PM

ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় যে প্রতিষ্ঠান থাকার কথা মুখরিত, সেখানে পুলিশেরও অবস্থান নিতে হয়, ক্ষুদেদের শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হতে হয় বহিরাগতদের হাতে। এমনই ঘটনা ঘটে চলছে ঢাকার মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। সম্পদশালী ও নামি এ প্রতিষ্ঠানটিতে ফিরেছে মাস দুয়েক আগের বিশৃঙ্খল দৃশ্য, তাতে বরাবরের মতো ভুক্তভোগী হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই।

প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান শিক্ষক পদে কে থাকবেন, তা নিয়ে পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বার বার। এরইমধ্যে গত বৃহস্পতিবার স্কুলের মূল বালিকা শাখার সামনে শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে আতঙ্ক ছড়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে।

শিক্ষকরা বলছেন, ৮৩৩ জন শিক্ষকদের মধ্যে বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন জনা পঞ্চাশেক। ২০০৭ সালের পর নতুন করে কাউকে এমপিওভুক্ত করা হয়নি। ২০০৯ সালে এমপিওভুক্তি প্রত্যাহারে শিক্ষকদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। এখনও তারা চাইছেন এমপিওভুক্তই থাকতে।

তবে স্থানীয় রাজনীতিকরা ‘আর্থিকভাবে লাভবান হতে’ প্রতিষ্ঠানটিকে ট্রাস্টের অধীনে পরিচালনা করতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের। ট্রাস্ট গঠনে ২০১৬ সালে নিবন্ধনও করা হয়েছে, আর তখন থেকেই পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির স্বাক্ষর না করায় এমপিওর আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছেন না শিক্ষকরা। আর এই কয়েক বছর স্থানীয় রাজনীতিকরাই ছিলেন পর্ষদের নেতৃত্বে।

স্কুলটির অভিভাবক শায়লা ইয়াসমিন শনিবার বলছিলেন, “স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে এত নোংরামি কেন? বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ভয়ে আর কতদিন আমরা ঘরে বসে বাচ্চাদের পড়াশোনার ক্ষতি করব। কাল না হয় পাঠাব না, কিন্তু এরকম করে কতদিন চলবে?”

যদিও রোববার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠিয়েছেন শায়লা, সেদিন স্কুলের পরিবেশ ছিল শান্ত।

প্রতিষ্ঠানটির মূল বালিকা শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক মশিউর রহমান রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সব শিক্ষক আজ ক্লাসে ফিরেছেন, শিক্ষার্থী উপস্থিতিও প্রায় ৯০ শতাংশ। শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তা আজ স্কুল পরিদর্শন করে গেছেন। পরিবেশ ঠিকঠাক আছে।”

তবে স্থিতিশীলতা নিয়ে সন্দিহান অনেক অভিভাবকই। তাদের একজন নাজমুল কবির রোববার বিকালে বলছিলেন, “আজ কোনো গণ্ডগোল হয়নি। কিন্তু একটা স্কুলে যদি কিছুদিন পরপর এমন সমস্যা হয়, বহিরাগত ঢুকে পড়ে, তাহলে তো বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়।”

পাঁচ দশক আগে প্রতিষ্ঠিত মনিপুর স্কুলের ঢাকার মিরপুর এলাকায় বর্তমানে ছয়টি ক্যাম্পাস আছে। মনিপুর এলাকায় বালক ও বালিকাদের জন্য রয়েছে আলাদা ক্যাম্পাস। এর বাইরে শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর ও রূপনগরে শাখা রয়েছে। রূপনগরেই আলাদা ভবনে কলেজ শাখার কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৮ হাজারের উপরে। প্রতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসের টিউশন ফি, ভর্তি ও সেশনচার্জ বাবদ প্রতিষ্ঠানটিতে এককালীন আয় হয় প্রায় ৩৮ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রতি মাসে টিউশন ফি বাবদ ওঠে প্রায় ৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানটির আয় প্রায় ৮২ কোটি টাকা।

এর বাইরে রয়েছে কয়েকটি এফডিআর, যেখান থেকে প্রতি মাসে আসে লভ্যাংশ। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ প্রতি মাসে খরচ হয় ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার মতো। তাতে বছরে ৫২ কোটি টাকা ব্যয় হলেও ৩০ কোটিরও বেশি টাকা অব্যয়িত থাকে। এসব টাকায় নানা ধরনের উন্নয়নকাজ ও কেনাকাটা চলায় স্থানীয় রাজনীতিকরা সুবিধা নেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন বলে জানাচ্ছেন একাধিক শিক্ষক। তারা এও জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, “এই স্কুলের ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। কোটি কোটি টাকা। এই টাকা আত্মসাতের জন্যই এসব ঝামেলা।”

২০১৫ থেকে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সরবরাহ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ৩১৪ কোটি টাকা মনিপুর স্কুল পরিশোধ করেছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরেরে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

প্রধান শিক্ষকের পদ নিয়ে রেষারেষি

গত সেপ্টেম্বরে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ মো. ফরহাদ হোসেনকে অবৈধ ঘোষণা করে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত কমিটি। তিনি সোয়া দুই বছর ধরে অবৈধভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২ জুলাই বয়স ৬০ বছর হওয়ার পরও তার চাকরির মেয়াদ তিন বছর বাড়ায় গভর্নিং বডি।

এরপর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরেরও তদন্তে ফরহাদ হোসেনের নিয়োগ বিধিসম্মত না হওয়ার কথা জানানো হয়। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়।

পরে আদালতের নির্দেশে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক মো. জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিতে নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। তবে পরিচালনা কমিটি কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ৬ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির মূল বালিকা বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যান জাকির হোসেন। তখন দুই পক্ষের রেষারেষিতে অচলাবস্থা তৈরি হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে।

পরে ১১ মার্চ শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার বিদ্যালয়টির রূপনগর শাখায় সংবাদ সম্মেলন ডেকে শিক্ষক-কর্মচারী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সামনে জাকির হোসেনের অধীনে স্কুলের কার্যক্রম চালানোর আহ্বান জানান।

হঠাৎ করেই গত ১৭ মে তখনকার অ্যাডহক কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জাকির হোসেনকে অব্যাহতি দিয়ে আখলাক আহম্মদকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়।

এর প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দেন বিদ্যালয়টির শিক্ষকরা। ওই দিন সকালে মূল বালিকা শাখার সামনে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। এক পর্যায়ে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে আখলাক আহম্মদ দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে দেন।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই দেলোয়ার হোসেন নেতৃত্বাধীন অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় মঙ্গলবার নতুন কমিটি দিয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, যেখানে সভাপতি করা হয়েছে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানকে। এই অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ হবে ৬ মাস, এ সময়ের মধ্যে নিয়মিত গভর্নিং বডি গঠন করে বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে।

মারধরের শিকার শিক্ষকরা, আতঙ্কে অভিভাবক

শিক্ষকদের অভিযোগ, বৃহস্পতিবারের তাদের ক্লাস বর্জন কর্মসূচি ছিল। এ দিন বিদায়ী এডহক কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম দেলোয়ার হোসেনের লোকজনের হামলায় আহত হন কয়েকজন শিক্ষক।

সেদিন মারধরের শিকার ইংরেজির শিক্ষক নাজির উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার আখলাক সাহেব আর বহিরাগত সন্ত্রাসীরা একসাথেই স্কুলে ঢুকেছে। এদের কাউকে আমরা চিনি না, ওরা এসে আখলাক সাহেবকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে বসাইছে। শিক্ষকরা এমনিতে ৮টায় আসে, কিন্তু সেদিন আখলাক সাহেব আর তার দলবল সাড়ে ৭টা থেকেই স্কুলে উপস্থিত। আমরা স্কুলে ঢুকতে গেলে দেখলাম বহিরাগতরা শিক্ষকদের চেক করে করে ঢোকাচ্ছে। এই ক্যাম্পাসের শিক্ষক ছাড়া আমাদের অন্য শাখার কোনো স্যার ম্যাডামকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

“তারা আখলাক সাহেবকে বসাইল, আমরা ধীরে ধীরে মেইন গেইটের সামনে জড়ো হলাম। হঠাৎ করেই বহিরাগতরা আমাদের উপর হামলা করে বসে। আমাকে দুইটা থাপ্পড় দিছে। আমাদের অনেক ম্যাডামকে ছাতা দিয়ে পিটিয়েছে। এক স্যারকে থাপ্পড় মেরে চশমা ভেঙ্গে ফেলেছে। এক পর্যায়ে আমরা সব শিক্ষক ঐক্যবদ্ধ হলে তারা সেখান থেকে সরে যায়। শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দেখে ইস্তফার জন্যে আখলাক সাহেব এক-দুই ঘণ্টা সময় চান, শিক্ষকদের প্রতিবাদের জন্যেই মূলত তিনি সরে গেছেন।”

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, “একটা পক্ষ আমাকে এত চাপে রেখেছে। তবে সেই চাপ সামলানোর শক্তি আমি রাখি। সে যাই হোক, আমার রূপনগর ক্যাম্পাসে ১৭ মে পূর্বনির্ধারিত সভা ছিল অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে। সেখানে যখন গেলাম, তখন দেখি- পুলিশ, চেনা-অচেনা অনেক লোক, স্থানীয় অনেক ক্যাডার উপস্থিত। তারা সেই মিটিং করতে দেবে না, শিক্ষকদের ঢুকতে দিচ্ছিল না।

“এই ঘটনায় শিক্ষকরা কর্মসূচি দেয় যে তারা পরদিন ১৮ মে মূল বালিকা শাখায় থাকবে। সেখানে তারা উপস্থিত হলে বহিরাগতরা আমার শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। এখানে ছোটখাটো মারামারি-হট্টগোল হয়েছে।”

এই হামলায় কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, তা জানতে বিদায়ী এডহক কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।

বিদায়ী কমিটির সদস্য সামছুল আলম বলেন, “আমরা তাকে প্রত্যাহার করেছি বলতে কী, আমরা যে জাকির সাহেবকে শোকজ করেছি বা চাইছি না তা আমাদের আওতার মধ্যে মাউশিকে জানিয়েছি, সবাইকে তার সিসি (অনুলিপি) দিয়েছি।

“মারামারি তো কেউ একা করে না। কমিটির ইশারায় কিছু হয়নি। তারাও (শিক্ষকরা) অনেকের গায়ে হাত তুলেছে।”

বৃহস্পতিবারের বিশৃঙ্খলার পর দুপুরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন স্থানীয় এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তিল তিল করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। আমার প্রতিষ্ঠানে কোনো জামায়াত-শিবিরের লোক থাকবে না, স্বাধীনতাবিরোধী লোক থাকবে না। এডহক কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী আখলাক আহম্মেদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন।”

তাহলে গত মার্চে সংবাদ সম্মেলন করে জাকির হোসেনকে কেন বসালেন- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “তাকে (জাকির হোসেন) বসানোর পর যেসব প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তার একটিও রাখেননি। আমরা ইতোমধ্যে সমস্ত বিষয়গুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অবহিত করেছি। আমি এখন একটা ডিও লেটার পাঠিয়ে দিই, মাউশি থেকে এটা কনফার্ম করে দেবে।”

তবে ঘটনার দিন সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন দাবি করেন, স্কুলের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী তার পাশে আছে।

“আমি অবশ্যই দায়িত্বরত থাকব। শিক্ষা কার্যক্রম যথারীতি চলবে।”

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ার কথা মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের ফেইসবুক পাতায় লিখতে থাকেন অভিভাবকরা।

মোহাম্মদ মাসুদ আলম নামে এক অভিভাবক লিখেন, “… আমরা কি প্রতিদিন এভাবেই আতঙ্কিত হয়ে সন্তানদের স্কুলে দিয়ে বাইরে অপেক্ষায় সময় অতিবাহিত করবো? আদৌ কি এটা সম্ভব?”

এই ফোরামের আহ্বায়ক সাইফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এডহক কমিটির নেতৃত্বে অনেক বহিরাগত এসে স্কুলে হামলা করেছে, শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলেছে।

“আমাদের দাবি হচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছেমতো এডহক কমিটি করা যাবে না। গভর্নিং বডি ও লোকাল এমপি মিলে এই কমিটি করে। আমাদের বর্তমান আন্দোলন অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ ভোটে কমিটি করতে হবে।”

Also Read: ‘এখতিয়ারবহির্ভূত’ ছুটি: মনিপুর স্কুলের সভাপতিকে ঢাকা বোর্ডের শোকজ

Also Read: জাকির হোসেনের ‘অধীনে’ চলবে মনিপুর স্কুল, বললেন কামাল মজুমদার

Also Read: ঢাকার ডিসিকে সভাপতি করে মনিপুর স্কুলের অ্যাডহক কমিটি

জাকিরকে নিয়ে আপত্তি কেন?

জাকির হোসেনকে দায়িত্ব পালন করতে বলে গত মার্চে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন- এখন আপত্তি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল আহমেদ মজুমদার সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হাই কোর্টের নির্দেশনা ছিল এমপিওভুক্ত সিনিয়র শিক্ষক থেকে একজনকে যেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক করা হয়। মাউশিও তাই বলেছে। মাউশি থেকে আখলাক সাহেবকে যে চিঠি দিয়েছিল, জাকির সাহেবে তা গায়েব করে রেখেছিল। এই চিঠি সভাপতিও পায়নি। সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে যিনি সিনিয়র ছিলেন তাকেও জাকির সাহবে জোর করে পদত্যাগ করিয়েছেন।”

তবে এ অভিযোগের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, “মাউশি আখলাক সাহেব, ফরহাদ সাহেব, সভাপতি (এডহক কমিটি) সবাইকে বিভিন্ন সময় বেঁধে দিয়ে চিঠি দিয়েছে সিনিয়রিটির লিস্ট দেওয়ার জন্য। তারা সেগুলো দেন নাই। এখানে আমার কোনো হাত নেই। কারণ আমি কোনো সরকারি কর্মকর্তা না। আমি সেগুলো গায়েব করতে যাব কেন?"

কামাল মজুমদার বলেন, “দায়িত্ব পাওয়ার পর আমি জাকির সাহেবকে বললাম, আমাদের ১২ জন সহকারী শিক্ষক আছেন, তাদের সাথে মিলেমিশে স্কুল চালানোর জন্য। তিনি কিন্তু তার ব্যতিক্রম শুরু করছেন। তিনি তার পাশে একটা বলয় তৈরি করেছেন, নানান ব্রাঞ্চে সেই দল নিয়ে যাচ্ছেন, স্কুলের লেখাপড়া গোল্লায়। এগুলো নিয়ে আমি তাকে ডাকছি। তো জামাতিদের যে চরিত্র সে আমার একেবারে পা ধরে জড়িয়ে ধরে বলে আপনি যেভাবে বলেন, সেভাবে যাবে আপনার স্কুল।”

তিনি বলেন, “মনিপুর স্কুল পুরোপুরি ব্যাংকিং চ্যানেলে চলে, যার যা টাকা তা চেকের মাধ্যমে দেওয়া হবে। এখানে ক্যাশের কোনো লেনদেন নেই। উনি (জাকির) এসেই ৪০ শতাংশ বেতন বাড়িয়েছে শিক্ষকদের।

“এই কারণে স্কুলের তহবিল থেকে এক কোটি ৩৯ লাখ টাকা চলে গেছে। শিক্ষকদের পক্ষে রাখার জন্য আরও ২৫ শতাংশ বেতন বাড়াবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। লেখাপড়া কিছু নাই শিক্ষকরাও তার পেছনে দৌড়াচ্ছে।”

তবে জাকির হোসেনের ভাষ্য, “হাতে পায়ে ধরার পোলা জাকির না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সচিবালয় যেখানেই হোক তিনি (কামাল মজুমদার) যদি এইসব অভিযোগ করেন, তাহলে তা আমার দেখার বিষয় না, আমি মোটেই বিচলিত না।

“আমার জীবনে এসব ঘটেনি। আর বেতন ৪০ শতাংশ বাড়িয়েছি, বেতন ১০০ শতাংশ বাড়াব। শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধাদি বাড়ানোর দিক দেখার দায়িত্ব আমার। আমি ম্যানেজিং কমিটির সাথে বার্গেনিং করব, তারা যদি আমার যুক্তির কাছে পরাস্ত হন- তাহলে তো আমি এটা করবই।”

এমপিও নাকি ট্রাস্ট?

অনুসন্ধানে জানা যায়, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ১৯৮৩ সালে এমপিওভুক্ত হয়। ওই সময়ে ৪৫ জন শিক্ষক কর্মচারী এমপিওভুক্ত হন। এরপরে এই সংখ্যা বাড়ে।

স্কুলের মূল বালিকা শাখায় এক ডজনেরও বেশি শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তারা বলেছেন, মনিপুর স্কুল একটি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এডহক কমিটি স্থানীর এমপির ভয় দেখিয়ে জোর করে তাদের কাছ থেকে এমপিওভুক্ত না থাকার ব্যাপারে স্বাক্ষর নিয়েছে।

ওই শিক্ষকদের ভাষ্য, সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্কুলটিকে দূরে রেখে স্কুলটিকে নিজেদের কব্জায় রাখতে একটি পক্ষ শিক্ষকদের চাপ দিয়ে স্বেচ্ছায় এমপিও প্রত্যাহারের আবেদন করিয়েছেন। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের এক তদন্তেও মিলেছে সেই তথ্য।

ঢাকা বোর্ডের তদন্তেও দেখা গেছে, শিক্ষকদের ‘জোরপূর্বক’ এমপিও প্রত্যাহারে সই নেওয়া হয়েছে। স্বাক্ষর নেওয়ার সময় জোর করার পাশাপাশি নানা কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে নানা প্রলোভনও। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভয়ে শিক্ষকরা প্রতিবাদ না করে স্বেচ্ছায় স্বাক্ষর করেছেন। আর এই আবেদনের কপি জমা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তরে।

তদন্তে উঠে আসে, শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০১৫ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত নিয়মিত এমপিওর অংশ পান। এরপর ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এমপিওর অংশ পান না। এরপর শুধু এপ্রিল মাসে এই ভাতা পান। এরপর থেকে এই এমপিওর অংশ আর পাননি শিক্ষকরা।

স্কুলকে ট্রাস্টের অধীনে পরিচালনার বিষয়ে সম্মত না হওয়ায় জাকির হোসেন স্থানীয় এমপি ও বিদায়ী এডহক কমিটির চক্ষুশূল হন বলে মনে করেন অনেক শিক্ষকই।

প্রায় চার দশক ধরে বিদ্যালয়টিতে কর্মরত এক শিক্ষক বলেন, “যে কোনো ঘটনায় এমপি ও তার কর্মীরা এসে হস্তক্ষেপ করেন। তারা চান এই স্কুল এমপিও না থাকুক, ট্রাস্ট হোক। এ ব্যাপারে আপস না করায় জাকির স্যারকে তারা সরাতে চায়।”

স্কুলের ইতিহাস টেনে তিনি বলেন, “১৯৬৯ সালের স্কুল এটি। এর জমি দিয়েছেন নূর মোহাম্মদ সাহেব। এই স্কুল অন্য কেউ প্রতিষ্ঠা করেনি। প্রতিমন্ত্রী সাহেবের আশপাশে থাকা কিছু লোক এই স্কুল থেকে ফায়দা নেয়, তারা তাকে তোষামোদ করে স্কুলের নানা বিষয়ে জড়ান।”

মনিপুর স্কুলের প্রশাসনিক সমন্বয়ক মো. রাশেদ কাঞ্চন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাকির স্যার প্রথম মাসেই এমপিও বিল সাইন করতে কমিটির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে আহ্বান জানিয়েছিলে। কিন্তু তিনি এমপিও বিল সাইন করেননি। এটা প্রতিমন্ত্রী মহোদয় এবং দেলোয়ার ভাই- তারা চাচ্ছেন এটাকে ট্রাস্ট বানাবেন। ট্রাস্টের রেজিস্ট্রেশনও করেছেন।

“এটা নিয়ে আদালতে রিট আছে, রিটের বিরুদ্ধে বোর্ডের চেয়ারম্যান আপত্তি জানিয়েছেন। এটা ট্রাস্ট হওয়া সম্ভব না। ডিআইএ রিপোর্টেও আছে যে, এটা এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান, পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠান, এটা মাঝপথে কেউ ট্রাস্ট বানাতে পারেন না। এটা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে।”

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন বলেন, “মার্চের ৬ তারিখ আমি যখন দায়িত্ব নিই, তখন প্রথম সভায় ম্যাক্সিমাম বিল আমি বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের ক্লিনার-সুইপারদের একটা বিল আছে। যেখানে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ লাখ আসার কথা, কিন্তু সেখানে নিত ১৬ লাখ টাকা। এই বিলগুলো আমি অধিক যাচাইয়ের জন্য অর্থ কমিটিতে দিয়েছি।

“আমার ধারণা, আমি এই যে তাদের অনৈতিক বা বিধিবহির্ভূত বিল আমি অনুমোদন করিনি, কমিয়ে পরিশোধ করেছি- সেজন্য হয়তো কোনো মহলের আতে ঘাঁ লেগেছে যে, জাকির থাকলে তাদের কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য সফল নাও হতে পারে।”

‘কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্যের’ ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটাকে ট্রাস্ট করা, প্রাইভেট করা। আমরা ২০১৬ সাল থেকে যে এমপিও পাচ্ছি না। আমি বলেছি, বাংলাদেশ পরিবর্তন না হলে মনিপুর স্কুল এমপিওভুক্তই থাকবে।

“এমপি নিজেই গত মার্চে বলেছেন ৯০০ শিক্ষককে এমপিও করা হোক, সরকারি করা হোক, আরও বলেছে ‘জাকির একটা চমক, দক্ষ লোক’। তাহলে এই দুই মাসে আমি কী এমন অদক্ষ হয়ে গেলাম, কী অনৈতিক কাজ করলাম?”

এমপিও নাকি ট্রাস্ট- এই বিতর্ক কেন উঠছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য কামাল মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কথা বলে ভয় দেখিয়ে এমপিও সারেন্ডারের কথা ডাহা মিথ্যা, ভিত্তিহীন। মনিপুর স্কুলে টোটাল এমপিও টিচার ছিল ১০১ জন। এখান থেকে অবসরে যেতে যেতে তা ৩৯ এ নেমেছে। আপনি ৩৯ জনের স্বার্থ দেখবেন, নাকি সাড়ে নয়শ শিক্ষকের স্বার্থ দেখেবেন?”

মনিপুর স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক এ সভাপতি বলেন, “ট্রাস্ট তো এটা ২০১৬ সালেই হয়েছে।…এটা হাই কোর্টে গেছে, কোর্ট জবাব চেয়েছে তারা তার জবাব এ পর্যন্ত দেয়নি, ডেইটের পর ডেইট নিচ্ছে।…শিক্ষকরা অনেক কথাই বলে। এদেরকে তো আমি চাকরি দিছি, আমি চিনি।

“যেহেতু আমি স্কুল করেছি। আমার দুঃখ লাগছে, স্কুলটা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমি ডিও লেটার লিখেছি, সেনাবাহিনীর এডুকেশন কোর বা বিসিএস এডুকেশন কোরের কাউকে এখানে প্রিন্সিপাল হিসেবে দেওয়ার জন্য।”

আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনেকে অভিযোগ করছেন, এমপি কামাল মজুমদারের ইশারাতে এডহক কমিটির সভাপতি (বিদায়ী) দেলোয়ার ও স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী স্কুলে বিশৃঙ্খলা করে আসছে।

তবে এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন কামাল মজুমদার। তিনি বলেছেন, “আমি নিজ হাতে এই স্কুল করেছি। আমি ব্যবসা করে যে অর্থ কামাই করেছি, তা এই স্কুলের পেছনে ঢেলেছি। এই স্কুলের শিক্ষার্থী যখন ভালো করে, ভালো ফলাফল হয়, শিক্ষার্থী যখন দেখি ভালো জায়গায় চাকরি করছে, আমার তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। আমি কেন এই স্কুলে বিশৃঙ্খলা চাইব?”

তিনি বলেন, “আমার লোকেরা অনেকে বলেছে- ‘ভাই এদের স্কুল থেকে বের করে দিই’; আমি বলেছি- নো, কেউ স্কুলের আশপাশে যাবে না। স্কুলে যেন শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে। আমরা যা করার আইনিভাবে করব।”

দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কামাল মজুমদার বলেন, “দেলোয়ার সহজ-সরল লোক। সে এমনিতেই ভীতু। তাকে ভয় দেখিয়ে রাখছে। তার সাইন ছাড়াই জাকির নতুন কমিটি বানাইয়া নানান জায়গায় পাঠাইছে, এইটা তো সে করতে পারে না।”

শিক্ষার কর্তা-ব্যক্তিরা যা বলছেন

এডহক কমিটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অব্যাহতি দিয়ে আরেকজনকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার রাখে কি না, এমন প্রশ্নে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার বলেন, “এটা আমরা মাউশিকে চিঠিতে লিখেছি, মাউশি এই ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। এটা বিধির মধ্যে পড়ে না বলে আমরা মাউশিকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।

“মাউশি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছে, মাউশি চাইলে তাকে প্রত্যাহার করতে পারে, এডহক কমিটি পারে না।”

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (মাউশি) সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-২) এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরী বলেন, “মাউশি আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। মাউশি কাউকে বসায়নি, মাউশি তাদের পত্র দিয়েছে, সিনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য।

“তারা নিজেরা এখন আইন-কানুন ঘেঁটে দেখুক, যিনি আছেন তাকে অব্যাহতি দিয়ে আরেকজনকে বসানো ঠিক হচ্ছে কি না।”