‘একজন নারী হয়েও ….শুনে হেসেছিলেন এই প্রধানমন্ত্রী’

শেখ হাসিনাকে যেভাবে দেখলেন ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2022, 06:06 PM
Updated : 4 Oct 2022, 06:06 PM
যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ওয়াশিংটন পোস্টকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন পত্রিকাটির কলামনিস্ট পেটুলা ডিভোরাক। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ভার্জিনিয়ার টাইসনস কর্নারে রিটজ-কার্লটন হোটেলে অবস্থান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ হয়। সেই সাক্ষাৎকার ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে পত্রিকাটিতে একটি কলাম লিখেছেন পেটুলা। সোমবার প্রকাশিত হয় সেই লেখাটি।

নিজের ৬ বছরের মেয়েকে দুই হাতে উঁচুতে ধরে রেখেছিলেন আবদুল্লাহ নিয়ামি। রিটজ-কার্লটনের বলরুমে কালো-কোটের পুরুষদের ভিড়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটেছিল ছোট্ট মেয়েটির গোলাপি জামা।

নিয়ামি বলছিলেন, “আমি তাকে নিয়ে এসেছি প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে।”

আবদুল্লাহ নিয়ামির মেয়ের নাম জয়া। যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্কুলের ফার্স্ট-গ্রেডে পড়ে সে। গত সপ্তাহে মেয়েকে নিয়ে নর্দার্ন ভার্জিনিয়া এসেছেন নিয়ামি।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার রিটজ-কার্লটন হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তার এবারের বিদেশ সফরে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে শান্তির আহ্বান জানিয়ে ভাষণ এবং লন্ডনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শেষকৃত্যে অংশ নেওয়ার মতো ব্যস্ত সূচির মধ্যে এই হোটেলে অবস্থানের ঘটনাটি উল্লেখ করার মতো নয়।

এই নারী শক্তির প্রতীক।

নারী হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সরকার প্রধানের দায়িত্বে থাকার রেকর্ড গড়া, রাশিয়ার চেয়ে বেশি জনসংখ্যার একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং কমপক্ষে ২০টি প্রাণঘাতী হামলা, যার মধ্যে তাকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলাও রয়েছে। বেঁচে যাওয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনা একজন মাতামহী।

তাই নিজের ৭৬তম জন্মদিনটি তিনি উদযাপন করেছেন ছেলে ও তার ১৬ বছরের নাতনীর সঙ্গে, যাদের বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীর অদূরেই।

যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও একজন সাধারণ মাতামহীর মতো ভূমিকা পালনের সময় পান, তিনি আমাকে বললেন, “আমি তাদের জন্য রান্নাও করেছি। চিকেন বিরিয়ানি ... আমার ছেলের বাসায়, শুধু আমার জন্যই একখানা রান্নাঘর আছে।”

এসব ঘটনা আমরা জানতে পেরেছি কারণ শেখ হাসিনার এই সফরসূচিতে তার একটি একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছে।

সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য একটি সুদৃশ্য কক্ষে তার অনুবাদক ও একান্ত সচিবকে সঙ্গে নিয়ে আমরা বসেছিলাম। সেখানে শেখ হাসিনার বাবার একটি বিশাল ছবি রাখা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী, যাকে তার পরিবারের ১৭ জন সদস্যসহ হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালে। দুই মেয়াদে সবমিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৮ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের মধ্যদিয়ে বাবার পরম্পরাই বহন করে চলেছেন মেয়ে।

তিনি একটি জটিল, অস্থির জাতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি নিজেও একজন কঠিন নেতা। জাতিসংঘে ভাষণে শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য সাহায্য চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আশ্রয় শিবিরের জীবন মানবেতর, তারা তাদের দেশে ফিরতে চায়।”

আমার এক প্রশ্নের জবাবে হাসিনা বলেছেন, তার দেশের অভিবাসী সঙ্কটকে আমেরিকার অভিবাসী সঙ্কটের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।

উত্তর থেকে দক্ষিণে দুহাত প্রসারিত করে তিনি বলেন, “আমেরিকা ... একটি অনেক বড় দেশ। অনেক জমি, অনেক জায়গা, কাজ করার সুযোগ আছে এখানে।”

কেন যুক্তরাষ্ট্রকে এসব অভিবাসীদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে? পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি।

বিশ্বে জনসংখ্যার হিসাবে ১৭ কোটির বেশি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম।

“কিন্তু আমরা ছোট একটি দেশ,” তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন। পাশ থেকে তার একান্ত সচিব আরেকটু জুড়ে দিলেন, “আমাদের দেশের আয়তন বড় জোর উইসকনসিনের (যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য) সমান।”

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আছে সেদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি নিয়ে, একইসঙ্গে নানা বিধি-নিষেধের অভিযোগ এবং আক্রমণাত্মক পুলিশ বাহিনী নিয়েও, যার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকার স্থানীয় জঙ্গিদের দমন করেছে।

এটা ছিল সেই দমন অভিযান, যার ভিত্তিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৫ সালে শেখ হাসিনার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার অনমনীয় মনোভাবের জন্য, বলেছিলেন, “ডেসপাইট বিয়িং আ ওম্যান (নারী হওয়া সত্ত্বেও)”।

কী দারুণ!

নরেন্দ্র মোদীর ওই বক্তব্য থেকে একটি মিম নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং হাসিনার গৌরবের একটি সূচক হিসেবে তা চিহ্নিত হয়েছে।

যখন এই বিষয়টি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম, তিনি আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে একটু ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলেন, “নারীরা পুরুষের চেয়ে ভালো” এবং হেসে উঠলেন।

অবশ্য পরক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, যেহেতু তিনি নারী, তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবের সঙ্গে লড়াইয়ের বাস্তবতা আরও নিবিড়ভাবে বুঝতে পারেন এবং বুঝতে পারেন, কী কী বাধা বেশিরভাগ নারীকে মোকাবেলা করতে হয় এবং কীভাবে তাদের পশ্চাদপদতা দেশের অগ্রগতিকে ধীর করে দিচ্ছে।

গত এক দশকে দেশের দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনতে, শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে এবং আবাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনে কাজ করেছেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “এগুলো আর নেই, আপনারা কী বলেন সেগুলোকে, কুঁড়েঘর।”

হতে পারে খুবই সাদামাটা কাঠামো, হতে পারে ইটের দেয়াল, টিনের ছাদ, তবে বাংলাদেশ বাসস্থানকে একটি অধিকারে পরিণত করতে পেরেছে।

তিনি জোর দিয়ে বললেন, “এবং এটার মালিকানা নারী ও পুরুষ দুজনের নামেই হবে।” এরপর বললেন, “যদি তাদের বিচ্ছেদ হয়, বাড়িটি নারীর অধিকারেই থাকবে। পুরুষের নয়।”

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে ভালোভাবেই মূল্যায়ন করেছে বিশ্ব ব্যাংক। ১৯৭১ সালে অভ্যুদয়ের সময় অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে ২০১৫ সালে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে তারা।

শেখ হাসিনা জানালেন, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থান নিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের নারীদের উপর বিনিয়োগ দেশকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। এর সবই গত সপ্তাহে জাতিসংঘে তুলে ধরেছেন তিনি।

শেখ হাসিনা ভাবছিলেন, সফরের শেষভাগ একটু তুলনামূলক নিরিবিলিভাবে পার করবেন।

কিন্তু ওই এলাকার স্থানীয় বাংলাদেশিদের কাছে হোটেলে তার অবস্থানের খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। এবং যখন তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দেওয়া শেষ করলেন, বিলাসবহুল হোটেলটির লবি তার ভক্ত-সমর্থকদের দিয়ে পরিপূর্ণ, যাদের মধ্যে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ইউসুফ চৌধুরীও (৬৬)।

ইউসুফ বললেন, “ভোর ৬টায় বস্টন থেকে আমি প্লেনে উঠেছি।” একটি কার্ড বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, ১৯৭১ সালে যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দেখা করতে এসেছেন এটুকু জানাতে যে যদি আবারও দেশের কোনো সাহায্য করতে পারেন তিনি।

হোটেলের কর্মীরা ব্যতিব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা রক্ষীরাও বোধগম্যভাবেই-২০ বার প্রাণঘাতী হামলার কথা মনে আছে? - উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভিড়ের মধ্য থেকে স্লোগান ওঠে এবং তারা এমনভাবে জোয়ার সৃষ্টি করে যেন সময়টি ১৯৬৬ সাল এবং হাসিনা ‘বিটলস’ ব্যান্ডের একজন সদস্য।

অবশ্য এক ঘণ্টার মধ্যেই একটি পরিকল্পনা দাঁড়ায়। শেখ হাসিনা সমবেত জনতার সামনে বক্তব্য দিতে রাজি হন। রিটজ কর্তৃপক্ষ তাদের ওল্ড ডমিনিয়ন রুমটির চেয়ার-টেবিল সরিয়ে সভা আয়োজনের ব্যবস্থা করে এবং নিরাপত্তারক্ষীরা একটি লাইনে দাঁড় করিয়ে তল্লাশির মাধ্যমে কমপক্ষে ২০০ লোককে বলরুমে প্রবেশ করতে দেয়।

বেশিরভাগ সমর্থকই ছিলেন পুরুষ। ব্যতিক্রম ছিলো জয়া, তার গোলাপি জামায় এবং রঙ মেলানো জুতোয়। আর ছিলেন মালিহা জামান (২৪), সেদিন তার ছুটি ছিল।

মালিহা বললেন, “নিশ্চয়ই আমি এমন একজন নারীকেই দেখতে এসেছি। তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।”

দেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শেষ করে মালিহা দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। এখন তিনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, ভার্জিনিয়াতে থাকেন।

মালিহা কূটনীতিকের সুরে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরলেন যে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র এখনও একজন নারী প্রেসিডেন্ট পায়নি।

শেখ হাসিনাকে দেখার জন্য পুরুষরা যখন আরেকটু ভালো জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করছে, ওই মুহূর্তে আরেকজন নারী ব্যাখ্যা করলেন এই প্রধানমন্ত্রী কেন ‘বিশেষ’ একজন।

শাহেদা পারভীন বললেন, “তিনি বয়স্কদের নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে ভাবেন। তিনি পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করেছেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ করেছেন। তিনি শিশুদের নিয়ে ভাবেন, তিনি নারীদের জন্য ভাবেন, যারা সন্তানসম্ভবা। আমরাও সবাই এগুলো নিয়েই চিন্তা করি।”