রামনাথের জীবনী পাঠ্যবইয়ে রাখার দাবি, দিবস ঘোষণা

“আমরা ভিনদেশি ইবনে বতুতাকে চিনি, স্বদেশি রামনাথকে জানি না,” বলেন আহসানুল কবীর।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2022, 03:43 PM
Updated : 1 Nov 2022, 03:43 PM

ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি, বসতভিটা পুনরুদ্ধারের দাবি জানানোর পাশাপাশি তার জন্মবার্ষিকী ১৩ জানুয়ারিকে ‘রামনাথ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি।

তার মৃত্যুবার্ষিকীতে মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা থেকে ওই বসতভিটায় ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের বিশেষায়িত পাঠাগার, বাইসাইকেল জাদুঘর ও অতিথিশালা নির্মাণের দাবি জানানো হয়।

কমিটির পক্ষে যুগ্ম আহ্বায়ক শাহেদ কায়েস বলেন, “রামনাথ শুধু দুই চাকায় ঘোরাঘুরি করেননি, জনপদের পর জনপদকে জানার চেষ্টা করেছেন গভীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। তাই ১৩ জানুয়ারি সারা দেশের সব সাইক্লিস্ট গ্রুপ রামনাথকে যেন স্মরণ করে, কীর্তিমানের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবিতে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা আয়োজন করবে বলে আমরা চাই।

“যারা পাহাড়ে চড়তে ভালোবাসেন তাদের অনুরোধ করব, রামনাথের নামে কোনো একটি পাহাড় চূড়ায় যান সেদিন। ভ্রমণপিপাসুদের বলব দেশটাকে জানতে বেরিয়ে পড়ুন; বিশ্বকে দেখুন। সেই সাথে সরকারের কাছে আহ্বান থাকবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে যেন রামনাথের জীবনী পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”

‘রামনাথ বিশ্বাস: বিশ্বজোড়া পাঠশালা তাঁর’ শীর্ষক ওই সেমিনারে মূল প্রবন্ধে ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “সর্বকালের সেরা বিশ্ব ভূপর্যটকদের নাম লিখলে রামনাথ বিশ্বাসের নাম আসবে- এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বাঙালি জাতি ঘরকুনো, তারা ভ্রমণ করতে জানে না বিশ্বদরবারে- এ অপবাদ ঘুচিয়েছেন রামনাথ।

“পৃথিবী বিখ্যাত ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস, যিনি সাইকেলে ৫৩ হাজার, পায়ে হেঁটে সাত হাজার, রেলগাড়িতে দুই হাজার, জাহাজে ২৫ হাজার- মোট ৮৭ হাজার মাইল বা ১ লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন। রামনাথকে পাঠ করতে হবে। তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”

রামনাথকে বিশ্বপাঠশালার একনিষ্ঠ ছাত্র আখ্যায়িত করে আহসানুল বলেন, “তিনি অর্জন করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা, দেখেছেন ভিন্নভিন্ন সমাজ ব্যবস্থা; পরিচিত হয়েছেন বিপরীত সব রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে। রামনাথ বিশ্বাস দুচোখ ভরে উপভোগ করেছেন পৃথিবীর নানা রং, রূপ, রস।

“নবীন শিক্ষার্থীর মতোই আগ্রহ ভরে শিক্ষার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন। সঞ্চয় করেছেন বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার ঝুলি। ফলে গোটা জগৎ জুড়েই সৃষ্টি হয়েছিল তার পাঠশালা।”

এ ইতিহাস গবেষক বলেন, “ভিনদেশি ইবনে বতুতাকে চিনি, স্বদেশি রামনাথকে জানি না; ভিনদেশি সিরাজউদ্দৌলার জন্য অশ্রুপাত করি, ভূমিপুত্র সমশের গাজীকে ডাকাত বলি; রবার্ট ব্রুসের অধ্যবসায় সম্পর্কে জানি, এই মাটির সন্তান ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সংগ্রামমুখর সাধনার কথা বলি না; হাজী মুহম্মদ মহসীনের দানশীলতার কথা বলি, মহেশ ভট্টাচার্য্যের নামও উচ্চারণ করি না।

 “এই দায় কার? রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা, আপনি-আমি-আমরা সবাই কমবেশি এর জন্য দায়ী।”

বানিয়াচংয়ে রামনাথের স্মৃতিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস যে মুছে ফেলা যায় না, সেটি রামনাথের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার স্পষ্ট হলো।
মফিদুল হক

প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও লেখক মফিদুল হক বলেন, “রামনাথ বিশ্বাসের বই যারা পাঠ করবেন, তারা কখনোই ভুলতে পারবেন না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্কুলে পড়ার সময় ষাটের দশকে প্রথম রামনাথকে পড়েছিলাম। আর ভুলিনি। মৌলভীবাজারেও লীলা নাগের স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

“বানিয়াচংয়ে রামনাথের স্মৃতিও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস যে মুছে ফেলা যায় না, সেটি রামনাথের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার স্পষ্ট হলো। মৌলভীবাজারে নীল রায়ের বসতভিটা, বানিয়াচংয়ে রামনাথের বসতভিটা এবং মানিকগঞ্জে বিদ্রোহী কবি নজরুলের স্ত্রী প্রমীলার বাড়িও পুনরুদ্ধার করা হোক।"

রামনাথকে উপনিবেশবাদবিরোধী উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রামনাথ বিশ্ব ঘুরেছেন এবং চেয়েছিলেন কালো মানুষেরা যেন জেগে উঠে। আফ্রিকায় গিয়ে একেবারে মানুষের ভেতরে থেকে জীবন দেখেছেন। সেই দেখার অভিজ্ঞতা থেকেই রামনাথ উপনিবেশবাদবিরোধী হয়ে উঠেছিলেন।”

ভূপর্যটক রামনাথের যে কৌতূহলের শেষ ছিল না তা তুলে ধরতে গিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “বাংলা সাহিত্যে অনেক ভ্রমণকাহিনী লেখককে আমরা চিনি, আমার নিজেরও বেশকিছু ভ্রমণবিষয়ক বই আছে। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাস যেখানে আলাদা- সেটি হলো তিনি ছিলেন একেবারেই সাধারণ একজন পর্যটক।

“যার কাছে ছিল না আড়ম্বরপূর্ণ উচ্চশিক্ষা, প্রয়োজনের চেয়ে খুব বেশি অর্থও তিনি ভ্রমণের সময় সাথে নিতেন না। তার যেটি ছিল সেটি হচ্ছে অসম্ভব সাহস আর অসীম কৌতূহল।”

রামনাথের লেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রামনাথ বিশ্বাসের ভ্রমণকাহিনী লেখার অসাধারণ হাতকে আমি আবিষ্কার করতে পারি- তার ‘তরুণ তুর্কী’ বইটি পড়ে। ততদিনে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে কামাল আতাতুর্ক সেখানে বিপ্লব করে ফেলেছেন। রামনাথ বিশ্বাসের ওই ভ্রমণকাহিনী পড়ে আমার মনে হয়েছে আমি যেন এক নতুন তুরস্ককে দেখছি।”

রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা আল বদর পরিবারের দখলে থাকা ‘লজ্জার’ মন্তব্য করে করে শাহরিয়ার কবির বলেন, “এই বসতভিটার পুরো জায়গাটিই পুনরুদ্ধার করার এই আন্দোলনে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পাশে থাকবে এবং যেখানে বলা লাগে, বলবে। রামনাথের জায়গা পুনরুদ্ধার করতেই হবে।”

Also Read: হবিগঞ্জে রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে সাংবাদিকদের উপর ‘দখলদারদের’ হামলা

Also Read: রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ির পথে বাইসাইকেল শোভাযাত্রা

সাবেক অতিরিক্ত সচিব জালাল আহমেদ বলেন, “বানিয়াচংকে কেন্দ্র করে পর্যটন পরিকল্পনা করার প্রতিশ্রুতি আছে সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। রামনাথের নামে সেখানে মিউজিয়াম করার উদ্যোগ নিতে পারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।”

রামনাথের বসতভিটা উদ্ধারে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও বানিয়াচংয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তৎপরতা নিয়ে সেমিনারে সন্তোষ প্রকাশ করেন ভূর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল।

সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেন, “স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের বেদখল হওয়া বসতভিটার ১ একর ১৬ শতাংশ ভূমি উদ্ধারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পাদিত হয়ে এসেছে।

“রামনাথ ছিলেন অকৃতদার। তার স্বজনদের কেউ আর নেই। তিনি বাংলাদেশের গৌরব। তাই তার স্মৃতি সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।”

বসতভিটা পুনরুদ্ধার কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রুমা মোদকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু ও ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু চৌধুরী।

অনুষ্ঠানে রামনাথ বিশ্বাসকে নিয়ে নিজের লেখা গান গেয়ে শোনান বাউল বশিরউদ্দিন সরকার।

রামনাথ বিশ্বাসের প্রয়াণ দিবস স্মরণে আয়োজিত সেমিনারের পাশেই অনুষ্ঠিত হয় একক বইমেলা, যার ব্যবস্থাপনায় ছিল অনলাইন বই বিপণন প্রতিষ্ঠান ‘জলপড়ে ডটকম’।