পাঁচ বছরেও জমির মালিককে ফ্লোর বুঝিয়ে দেয়নি নাভানা

জমির মালিকপক্ষের অভিযোগ, চুক্তিভঙ্গের পাশাপাশি ‘নিয়মও ভেঙেছে’ নাভানা। আর ওই ভবনে নাভানার অংশের ফ্লোর কিনেছেন এমন ব্যক্তিরাও দলিল বুঝে পাননি বলে জানিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 March 2024, 04:32 AM
Updated : 18 March 2024, 04:32 AM

ঢাকার বিজয়নগরে একটি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পরও জমির মালিকদের অংশ বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে।

জমির মালিকপক্ষের অভিযোগ, চুক্তিভঙ্গের পাশাপাশি ‘নিয়মও ভেঙেছে’ নাভানা। আর ওই ভবনে নাভানার অংশের ফ্লোর কিনেছেন এমন ব্যক্তিরাও দলিল বুঝে পাননি বলে জানিয়েছেন।

ঢাকার ১৯৮ শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণিতে নাভানা এফএইচ সোলারিস নামের ওই বাণিজ্যিক ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ২০১৩ সালে। ২০১৯ সালে শেষ হয় নির্মাণ কাজ। ৬৬৮ দশমিক ৬৭ বর্গমিটার আয়তজনের জমির ওপর দুটি বেইজমেন্টসহ ১৪ তলা ভবন বানানো হয়।

ওই জমির মালিকদের একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আ ফ ম আ হ্যারিস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯৫৬ সালে তার বাবা এএফএমএ হালিম ওই জমি কেনেন। উত্তরাধিকারসূত্রে তারা চার ভাই কিউ এ হালিম, এএফএমএ হাই, এএফএমএ হ্যারিস এবং এএফএমএ হানিফ ওই জমির মালিকানা পান।

তাদের মধ্যে এএফএমএ হাই মারা গেছেন। হ্যারিসসহ দুজন যুক্তরাজ্যে, আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।

হ্যারিস বলেন, ওই জমিতে ভবন নির্মাণ করতে নাভানার সঙ্গে চুক্তি করেন তারা। কথা ছিল, ফ্লোর স্পেসের ৫০ শতাংশ তারা পাবেন, বাকিটা নাভানার। ২০১৬ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। চুক্তির সময় দুই কোটি টাকা ‘সাইনিং মানি’ হিসেবে পেয়েছিলেন তারা।

তার অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে ভবনটি তৈরি করে তাদের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার কথা; কিন্তু নাভানা কাজই শেষ করে ২০১৯ সালে। সময়মত কাজ শেষ করতে না পারায় সাড়ে চার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, তাও দেয়নি।

“ক্ষতিপূরণের সাড়ে চার কোটি টাকা এবং আমাদের অংশের ফ্লোর বিক্রির আড়াই কোটি টাকাও নাভানা দেয়নি। ভবনটি ব্যবহারের জন্য অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ফায়ার সেইফটি সার্টিফিকেট নেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় ওই ভবন ব্যবহার নিরাপদ নয়। সেজন্য আমরাও বুঝে নিইনি।”

হ্যারিস বলেন, তিনি বার বার বলার পর ২০২২ সালের মার্চে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে ভবনের ‘অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপন ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাদির কার্যকারিতার একটি সাময়িক সনদ বের করে তাকে দিয়েছিল নাভান, সেটির মেয়াদ ছিল এক বছর।

“তারা বিল্ডিং কোডের অনেক কিছু অমান্য করেছে। ফায়ারের জন্য ডিপ টিউবওয়েল করার কথা ছিল, তারা সেটা করেনি। তারা এই সনদ নিতে গিয়েও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে বলে আমি মনে করি। সেটা পরে আর নবায়ন করতে পারেনি।”

তিনি বলেন, ভবনের সম্পূরক চুক্তি করে তাদের অংশ বুঝে নিতে বলছে নাভানা। কিন্তু চুক্তির শর্ত নাভানার পক্ষে যাওয়ায় তারা সম্মত হচ্ছেন না।

“তারা নতুন করে সাপ্লিমেন্ট ডিড অব এগ্রিমেন্ট করতে বলে। তাহলে এটা নবায়ন হয়ে গেল। কিন্তু তাদের প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলো আইনসম্মত নয়। শর্তগুলো একতরফা,তাদের অনুকূলে থাকায় আমরা একমত হইনি। 

“তারপরও আমরা চেয়েছি বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক। আমরা বলেছিলাম বিলম্ব চার্জ হিসেবে তাদের কাছে যে টাকা পাই তার ১০ শতাংশ আমাদের অ্যাকাউন্টে জমা দিতে, তাহলে আমরা একটা এগ্রিমেন্টে আসতে পারি। প্রথমে তারা রাজি হয়েছে, কিন্তু পরে আবার চেপে গেছে।” 

কাকরাইলে নাভানা এফএইচ সোলারিসে ভবনে গিয়ে দেখা যায়, প্রথম থেকে ১৩ তলা পর্যন্ত বেজোড় সংখ্যার ফ্লোরগুলো নাভানা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির। জমির মালিকদের জন্য ২ থেকে ১৪ নম্বর ফ্লোর। দেখা গেছে, দুটি বেইজমেন্টের একটি নাভানার, একটি জমি মালিকদের। 

নাভানা তাদের অংশের ফ্লোর বিক্রি করে দিয়েছে। বেইজমেন্টসহ জমি মালিকদের অংশের ফ্লোর খালি।

নাভানার প্রাপ্য অংশের বিভিন্ন ফ্লোর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে ২০১৯ সালের আগেই। তবে এখনও ওইসব ফ্লোর মালিকদের নামে দলিল করে দেয়নি আবাসন নির্মাতা ওই কোম্পানি।

ওই ভবনের একটি অফিসের একজন কর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নাভানা রাজউক থেকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ফায়ার সার্টিফিকেট নেওয়া হয়েছে কিনা, তা তারা জানেন না। তবে সনদ নিলে সেটার কপি তাদের দেওয়ার কথা।

নাভানা এফএইচ সোলারিস অফিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ সরদার জাহেদ বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ২০১৮ সালে নাভানার কাছ থেকে অফিস স্পেস কিনেছেন। তবে এখনও দলিল বুঝে পাননি। পুরো ভবন ভাড়া না হওয়ায় ঝামেলায় আছেন তারাও।

“২০১৮ সালে অফিস স্পেস হ্যান্ডওভার করেছে কিন্তু এখনও দলিল করে দেয়নি। আজ দিব, কাল দিব করছে। বিল্ডিংয়ের অর্ধেক স্পেস খালি। ফলে আমরা যারা আছি, তাদেরকেই ভবনের সার্ভিস চার্জ দিতে হচ্ছে। এই টাকার অংকটা ভাড়ার প্রায় সমান আসে।”

নাভানা এফএইচ সোলারিস অফিস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মামুন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই ভবনে পজেশন কিনে তিনি ‘ঝামেলায়’ আছেন।

“কিনেও রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেছি না। বলে মালিকের সাথে সমস্যা। কি সমস্যা আমরা জানি না। আমরা ভুক্তভোগী, একটা হ্যাংগিং অবস্থায় আছি। আর ওই বিল্ডিংয়ের সব কাগজপত্র আছে কি না আমরা জানি না। আমাদের কাছে রাজউক, ফায়ারের লোক আসলে বলি নাভানার কাছে যেতে।”

নাভানা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা ভবনটি বুঝিয়ে দিতে ‘কাজ করছেন’। কিছু বিষয় ‘হালনাগাদ’ করা দরকার, সেটা নিয়েও কাজ হচ্ছে।

“আমরা তাদের অংশের ফ্লোর বুঝিয়ে দিইনি ঠিক আছে। কিন্তু ওটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য কিছু কাজ আছে। সেটা করে দিলেই তো বুঝিয়ে দেব। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, এটা ড্রাফটও হয়েছে।”

ইমারত বিধি ভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করে নাভানার এই কর্মকর্তা বলেন, “রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট, ফায়ার সার্টিফিকেট সবকিছু ক্লিয়ার করা আছে। আমাদের এখানে কোনো ফাঁকফোকর নেই।”

হ্যারিসরা এই ভবন নিয়ে ২০২১ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর কাছে একটি অভিযোগ করেছিলেন, তবে সুরাহা হয়নি।

রাজউকের অথোরাইজড অফিসার জোটন দেবনাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া আছে। অন্য বিষয়গুলো খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।”

ভবনের অগ্নিপ্রতিরোধ, নির্বাপন ও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাদির কার্যকারিতার সাময়িক সনদটি আসল কি না এবং সেটি হালনাগাদ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে মিডিয়া সেলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

যোগাযোগ করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপ সহকারী পরিচালক ও মিডিয়া সেলের ইনচার্জ মো. শাহাজাহান শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‍“ফায়ার সেইফটি প্ল্যান আমি দেখি না। সামগ্রিকভাবে কয়টি অনুমোদন দিয়েছেন সেই প্ল্যানের পরিসংখ্যান থাকে আমার কাছে। এইটা এক বছরের জন্য হয়েছে কি না, হলে বাতিল হয়েছে কি না ওইটা বলতে পারবেন পরিচালক অপারেশনের আন্ডারে একজন সহকারী পরিচালক। এটা একটা প্রশাসনিক বিষয়, জানতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে।”