সলিম উল্লাহর মতো শহীদদের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাবে কে?
Published : 25 Mar 2023, 06:16 PM
ঢাকার আসাদ গেইট দিয়ে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার আগে একটি সড়কের মুখে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্দেশিকা; যেখানে ভুল বানান লিখে, সেটি কেটে দিয়ে লেখা রয়েছে ‘শহীদ সলিমউল্লাহ্ সড়ক’।
এই সড়কের শেষ মাথায় একটি চায়ের দোকানে বসে আলাপ হচ্ছিল তাজমহল রোডের বাসিন্দা ব্যাংকার আবু জাফরের সঙ্গে। নামকরণ নিয়ে কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, “এটা জানতাম না তো। আমি তো জানতাম এটা স্যার সলিমুল্লাহর নামে সড়ক।”
মোহাম্মদপুরে বেশিরভাগ সড়কের নামই মুঘল কিংবা সুলতানী আমলের রাজা-বাদশার নামে। এর মাঝে দুটি সড়কের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস। তবে সেই গৌরবময় ইতিহাসও নতুন প্রজন্মের কাছে যেন অনেকটাই চাপা পড়ে আছে।
অনেকেই শহীদ সলিম উল্লাহ সড়ককে ভুল ভেবে ঢাকার নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নামে ভেবে থাকেন।
তাজমহল রোডে থাকেন মোহাম্মদপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আরিফ আবদুল্লাহ। শহীদ সলিম উল্লাহর কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রথম দিকে আমিও স্যার সলিমুল্লাহর নামে এই সড়ক ভেবেছিলাম। পরে আমার মামা বলেছিলেন, একাত্তরে শহীদ সলিম উল্লাহর নামে এই সড়ক।”
এই বিভ্রান্তি এড়াতে আরিফের পরামর্শ- “আমি মনে করি, এই সড়কের দুই পাশে বড় ফলক থাকা দরকার, যেখানে সংক্ষিপ্তভাবে শহীদ সলিম উল্লাহসহ যারা একাত্তরে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন, তাদের সম্পর্কে লেখা থাকবে।”
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিনই মোহাম্মদপুরের নিজ বাড়িতে অবাঙালিদের হাতে খুন হন মোহাম্মদ সলিম উল্লাহসহ তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য। ১৯২৪ সালে চাঁদপুরের কচুয়ায় জন্ম সলিম উল্লাহর। তার বাবা হাছান আলী সরকার, মা ওমর জান। তারা তিন ভাই ও দুই বোন ছিলেন। ১৯৭১ সালে ঢাকায় তার ঠিকানা ছিল মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটি।
সলিম উল্লাহর ছেলে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদ কিংবা নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদ বাংলাদেশে সংস্কৃতি অঙ্গনে খুবই চেনা মুখ।
সেদিনের কিশোর সাদি মহম্মদ বলেন, সেদিন অবাঙালিদের হাতে অন্তত ২৫ জন খুন হন। তাদেরকে কবরও দেওয়া হয়নি। একটা কুয়ার মতো জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়েছিল।
“বাবাকে নিয়ে বলতে গেলে আবেগ ধরে রাখতে পারি না। আমার চোখের সামনেই তো বাবাকে মেরে ফেলা হল,” চোখের পানি মুছে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ সলিম উল্লাহ’র ছেলে সাদি।
স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্যার সলিমুল্লাহ এবং শহীদ সলিম উল্লাহ নিয়ে তাদের মাঝে বিভ্রান্তি রয়েছে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে বর্তমান শহীদ সলিম উল্লাহ রোডের নাম ছিল ‘কায়েদে আজম’ রোড। ১৯৭২ সালে ওই নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মদপুর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ শহীদ সলিমউল্লাহ নামকরণ করে। পরে এটি সরকারিভাবে স্বীকৃতিও পায়। তবুও কেউ কেউ এখনও এটাকে স্যার সলিমুল্লাহ সড়ক বলে ভুল করেন।
শহীদ সলিম উল্লাহর ছেলে সাদি বলেন, “বেশ কয়েক বছর আগে এই সড়কের মুখে একটা নামফলক ছিল, সেখানেও লেখা ছিল ‘স্যার সলিমুল্লাহ সড়ক’। এ নিয়ে আমি আর আমার ভাই শিবলী মহম্মদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেও বলেছি, এটা স্যার সলিমুল্লাহ সড়ক নয়, এটা আমার বাবা শহীদ সলিম উল্লাহ সড়ক। কিন্তু তখন তিনি তেমন পাত্তা দেননি। এরপর আমরা দুজনই টেলিভিশন-মিডিয়াতে এটা নিয়ে যখন বলা শুরু করেছি, তখন সেটি পরিবর্তন করে শহীদ সলিম উল্লাহ সড়ক করা হয়েছে।”
এই ঘটনার সূত্র ধরে গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। এছাড়া স্কুল-কলেজ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে হবে।”
সেদিন কী ঘটেছিল?
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। বাড়ির সামনেই মসজিদ, জুম্মার নামাজ থেকে কেবল ঘরে ফিরেছেন সলিম উল্লাহ। মসজিদে জড়ো হওয়া অবাঙালিরা গুজব ছড়ায়, সলিম উল্লাহর বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে গুলি ছোড়া হয়েছে।
সাদি মহম্মদ বলেন, “মোহাম্মদপুরে সামাজিক নানা কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমার বাবা। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ছিল সখ্য। শেখ কামাল ছিলেন শানু ভাইয়ের (আমার বড় ভাই) বন্ধু, তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে এসে থাকতেন। সাতই মার্চে বাবার সাথে আমিও গিয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানে। আমি তখন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
“২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ২২ মার্চ রাতে আমাদের বাড়ির ছাদে বড় একটা বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলাম। ২৩ মার্চ সকাল থেকেই দেখলাম, একটা হেলিকপ্টার আমাদের বাড়ির উপরে কয়েকবার ঘুরছিল। তখন শানু ভাই বলছিল, ‘বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর জন্য আমাদেরকে ফলো করছে’।”
সলিম উল্লাহ তখন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা এবং মোহাম্মদপুর এলাকায় বাঙালি ও অবাঙালি সমন্বয় গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ তিনি তার বাসার ছাদে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের নানা পর্যায়েরও সভাও হত তার ওই বাড়িতে।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায়ও সে বাড়িতে গিয়েছিলেন তৎকালীর ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নুরে আলম জিকু, শেখ কামালসহ অনেকে। সেদিন রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে অনেকে তখন সলিম উল্লাহকে এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি।
সাদি মহম্মদ বলেন, “২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। এজন্য আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেখ কামালসহ আরও অনেকে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখন মাখন ভাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, সলিম উল্লাহ সাহেবের বাড়িতে মোহাম্মদপুরের অবাঙালিদের নিয়ে এই বৈঠকটি করার জন্য, এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা তাদেরকে বোঝাতে। সেই বৈঠকে আমাদের বাড়ির আশেপাশের অবাঙালিদের আসতে বলা হলেও তারা কেউই আসে নি। বরং তারা সেই বৈঠকের খবর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে জানিয়েছিল।”
২৬ মার্চ জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন সলিম উল্লাহ। সেখানে গিয়েই টের পান পরিস্থিতি ‘ভালো নয়’। মসজিদ থেকে সলিম উল্লাহ কেবল ঘরে ফিরেছেন। তার কিছুক্ষণ পরই তাদের বাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া শুরু হয়।
সাদি মোহাম্মদ বলেন, “বিকালের দিকে একটা বোমা মারা হল আমাদের বাড়ির ছাদে, তারপর একে একে কয়েকটা বোমা মারা হল। তখন তো এত শক্তিশালী বোমা ছিল না, কাচের বোতলের যে ককটেল- সেরকম। আমাদের বাড়িটা ছিল তখন মোহাম্মদপুরের একমাত্র চারতলা বাড়ি। উপর থেকে আমরা সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। তারপর নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। তখন আর ঘরের ভেতরে থাকার সুযোগ ছিল না।”
চোখের সামনে বাবার উপর আক্রমণের সেই ভয়াল স্মৃতি হাতড়ে সাদি মহম্মদ বলেন, “আমি আর আব্বা একটা রুমের জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। এমন সময় এয়ারফোর্সের এক অফিসার এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আব্বাকে পেছন থেকে ছোরা বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি তখন আব্বাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাইরে এলাম।
“তখন দেখলাম একসঙ্গে অনেকগুলো অবাঙালি দৌড়ে আসছে। আব্বা আমাকে বললেন- ‘তুই পালা, আমাকে মেরে ফেলুক’। আমি বলছিলাম, আমি যাব না। আব্বা তখন একটা ধাক্কা দিয়ে আমাকে সরিয়ে দিলেন। আমি দৌড়ে একটা বাঙালি বাড়িতে গিয়ে ঢুকতে চাইলাম, তারা ভয়ে ঢুকতে দিতে চাইছিল না। পরে আমি ধাক্কা দিয়েই ভেতরে গিয়ে কলের কাছে বসে থাকলাম। পানি দিয়ে রক্তটা ধুয়ে নিলাম।”
“পরে জেনেছিলাম, রাত ৯টা পর্যন্ত আব্বা বেঁচেছিলেন। সেদিন আমার চাচা সুরুজ, খালাত ভাই চিনুকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। চিনুকে ওরা বেঁধে পুরো মোহাম্মদপুরে টেনে-হেঁচড়ে ঘুরিয়ে এনে আমাদের বাড়ির সামনের মাঠে জবাই করেছিল। তাদের মরদেহ মোহাম্মদপুর কবরস্থানের পাশে কুয়ার মতো একটা জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়,” বলেন সাদি।
শহীদ সলিম উল্লাহর স্ত্রীর আরেক যুদ্ধ
২৬ মার্চে বাড়িতে আক্রমণের পর সন্তানদের নিয়ে দোতলা থেকে লাফ দিতে গিয়ে দুটো পা ভেঙে গিয়েছিল শহীদ সলিম উল্লাহর স্ত্রী জেবুন্নেছার। এরপর সেই ভাঙা পা নিয়েই সন্তানদের বাঁচাতে ছুটে বেড়িয়েছেন।
সাদি বলেন, “(আক্রমণের পর) আমাদের ভাই-বোনেরা দোতলা থেকে লাফ দিয়ে পাশের বাড়িতে চলে গেল। লাফ দিতে গিয়ে আম্মার দুটো পা ভেঙে যায়। সেই ভাঙা পা নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস সন্তানদের নিয়ে আরেক লড়াই করেছেন আমার মা।
“সবাই কেবল আমার বাবার কথা জানতে চায়। কিন্তু আমার মায়ের কথা কেউ জানতে চায় না। ৯৬ বছর বয়সে এখনও আমার মা বেঁচে আছেন সেই ভয়াল স্মৃতি বুকে নিয়ে।”
সাদির ভাষ্যে, “আমরা ১০ ভাই-বোন ছিলাম। বাবাকে ও ভাইকে যখন মেরে ফেলা হল, পরিবারের বাকি সদস্যদের নিয়ে মা বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারের একটি গ্রামে চলে গেলেন। সেখান থেকে চাঁদপুরে। তখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হয়েছে।
“দেশ স্বাধীনের পর যখন ঢাকায় ফিরে এলেন তখন মাকে আরেক যুদ্ধ করতে হয়েছে আমাদের বড় করার জন্য। আমি তখন গানের টিউশনি করেছি। আমার ভাই শিবলী নাচের টিউশনি করেছে। মা তখন সেলাইয়ের কাজ করেছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের মত স্বাধীন বাংলাদেশে ৫২ বছরে শহীদজায়াদের যে সংগ্রামী জীবন, সেটা আরেক যুদ্ধ, বলেন শহীদ সলিম উল্লাহর ছেলে।
তিনি বলেন, শহীদজায়াদের যে অবদান মুক্তিযুদ্ধে। সরকারের উচিত আড়ালে থাকা শহীদজায়াদের খুঁজে বের করে তাদের সম্মান দেওয়া, পুরস্কৃত করা।