অসীম সাহসী ও দেশপ্রেমিক বাঙালিরা সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে, বলেন তিনি।
Published : 27 Dec 2023, 12:52 AM
বেলুচিস্তানের মতো আরেকটি নারকীয় হত্যাযজ্ঞে বাঙালিকে থমকে দিতেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ভয়াবহ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়েছিল পাক সেনারা বলে মনে করেন বীর প্রতীক কাজী সাজ্জাদ আলী জহির।
অবসরপ্রাপ্ত এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল দেশের টানে কীভাবে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ভারতের কাশ্মীর হয়ে বাংলাদেশের কুলাউড়ায় যুদ্ধের মাঠে উপস্থিত হন সেই কাহিনি তুলে ধরেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত এ কর্মকর্তা মঙ্গলবার ঢাকায় তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন এক আলোচনা সভায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: স্মৃতিতে ও ইতিহাসে’ শীর্ষক এ আলোচনায় বীর প্রতীক এই মুক্তিযোদ্ধা রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ করেন।
আগারগাঁওয়ে বিআইডিএসের সম্মেলন কক্ষে জহির বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দমন করতে পেরেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনে করেছিল বাংলাদেশেও একইভাবে একটা ভয়াবহ অপারেশন চালানো হলে বেলুচিস্তানের মতোই বাঙালিকে দমন করা যাবে।
অসীম সাহসী ও দেশপ্রেমিক বাঙালিরা সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও প্রশিক্ষণ শেষ না করেই বেশির ভাগ যুবককে যুদ্ধের মাঠে যেতে দেখেছি।
আলোচনায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “প্রথমবার আমি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেই। ১৯৭১ সালে কাকুল সামরিক একাডেমিতে সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণে ছিলাম।
“প্রথম থেকেই পাকিস্তানিরা আমরা যারা পূর্ব পাকিস্তানের অফিসার ছিলাম তাদেরকে সুযোগ পেলেই গালাগালি করতে। কিন্তু বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথম থেকেই পালানোর চেষ্টায় ছিলাম। প্রথমবার এপ্রিল মাসে শিয়ালকোট সেবা ব্যারাক থেকে পালানোর জন্য বের হয়ে ৪ কিলোমিটার পরে ধরা পড়লে ফিরিয়ে নেওয়া হয় ব্যারাকে।”
তিনি বলেন, “ব্যারাকে নিয়ে আমাকে অমানুষ অত্যচার করার পরও আমি কোনও স্টেটমেন্ট দেই নাই।”
মুক্তিযুদ্ধের এ বীর প্রতীক তার গৌরবগাঁথা তুলে ধরে বলেন, এরপর ১৯৭১ সালের অগাস্টে পাকিস্তানের কাশ্মীরে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। আমি সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম কখন পাকিস্তান থেকে পালাতে পারব।
পরে কৌশলে এক পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে এসে তিনি পালানোর পথ খুঁজে নেন। পাকিস্তানি সেনাদের গুলি এড়িয়ে, গভীর নালা ও নদী বেয়ে ভারতীয় কাশ্মীরের জঙ্গলে এসে ওঠেন। এরপর এক দিন দুই রাত হেঁটে ২৬ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে জুম্মু কাশ্মীরের প্রধান সড়কে আসেন। নানা ঘটনার পরে অবশেষে তিনি দিল্লি পৌছাঁন। দূতাবাসের মাধ্যমে তার কাছে থাকা চিরকুটের তথ্য ভারত সরকারকে দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, ওই চিরকুটের কারণে ভারতের অনেক সামরিক বেসামনির প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
মূলত এ জন্যই ২০২১ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করেছে বলে মনে করেন বীরপ্রতীক সাজ্জাদ আলী জহির।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জন্ম নেওয়া এই বীর অগাস্টের শেষের দিকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের কুলাউড়ায় এসে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে আর্টিলারি ব্যাটারি পরিচালনায় দক্ষতার জন্য ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে তানভির মোকাম্মেল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে সম্ভ্রম হারানো বাংলাদেশি নারীদের সাক্ষাৎকার প্রদর্শন করা হয়।
বিআইডিএস এর জুম ‘হ্যাক’
এ আলোচনা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই হ্যাকারদের কবলে পড়ে অনলাইনে লাইভ করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা লাইভ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান বিআইডিএস মহাপরিচালক।
শুরুতে তানভির মোকাম্মেল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন শুরু করলে তাতে হ্যাকাররা নানারকম অশোভন ছবি ও চিত্র এঁকে সমস্যা করছিল। যে কারণে শেষ পর্যন্ত লাইভ বাদ দিয়ে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করা হয়।
এজন্য হ্যাকারদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বিনায়ক সেন বলেন, “১৯৭১ সালে রাজাকার, আল বদর, আল শামস যেভাবে এদেশের মানুষের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে পাকিস্তানিদের দালালি করেছিল এখনও তাদের উত্তরাধিকাররা এসব কর্মকাণ্ড করছে।
“এখন ২০২৩ সালে এসেও যদি আল বদর আল শামসের উত্তরাধিকাররা যদি চ্যালেঞ্জ জানাতে চান আমরা এখনও মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। আড়ালে আবডালে না থেকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জে আসুন।”