উৎসবের উদ্বোধনের পর উপস্থিত বইপ্রেমীরা বই বিনিময় করেন এবং আড্ডায় মেতে ওঠেন। বৃষ্টিও দমাতে পারেনি তাদের।
Published : 17 Nov 2023, 03:28 PM
সকাল থেকেই বৃষ্টি, এমন বৃষ্টিমুখর দিনেই কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছেন দিনমজুর জয়নাল আবেদিন। একটি উৎসবের উদ্বোধন করবেন তিনি। সাধারণত অনুষ্ঠান মঞ্চে উদ্বোধক বা অতিথি হয়ে যারা বসেন, জয়নাল তাদের মতো তেমন নামধারী কেউ নন।
জয়নালের পেশা দিনমজুরি; আর নেশা বই পড়া। বই পড়তে পড়তেই নিজের গ্রামে গড়ে তুলেছেন পাঠাগার। যে পাঠাগারে আছে সাড়ে তিন হাজারের বেশি বই। এমন একজন বইপ্রেমী মানুষকেই উৎসবের উদ্বোধক হিসেবে বেছে নেন আয়োজকরা।
শুক্রবার শহীদ মিনারে আয়োজিত হয় বইয়ের ফেরিওয়ালা পলান সরকার স্মরণে ‘বই বিনিময় উৎসব’, যার আয়োজক ‘মেঘের ধাক্কা’। এই উৎসব উদ্বোধন করতেই সারা রাত ভ্রমণ করে সকালে এসে ঢাকায় পৌছান জয়নাল।
উৎসবের আয়োজক জহির রায়হান যখন তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান, তখনও বৈরি পরিবেশের কারণে উৎসবটি করা যাবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। সাউন্ড, ব্যানার সবই প্রস্তুত, তবুও যেন অনিশ্চিত হয়ে পড়ল উৎসবটি।
এদিকে বেশ কিছু বইপ্রেমী ছাতা হাতে এসে হাজির উৎসব প্রাঙ্গণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে পোস্ট লিখে ব্যতিক্রমী এই উৎসবটিতে আসতে না পারার জন্য আফসোস প্রকাশ করেন। আবার কেউ কেউ পরামর্শ দেন উৎসবটি অন্য কোনো দিন করার জন্য।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৃষ্টি কিছুটা কমলে অনুষ্ঠান শুরু করেন আয়োজকরা। মুহূর্তেই শুরু হয় দমকা বাতাস। উড়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠানের ব্যাকড্রপ; ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, সবকিছু ভিজে যাচ্ছে। তবুও সেই বৃষ্টি মাথায় করে পনের-কুড়িজন মানুষ ছাতা হাতে অনুষ্ঠানস্থলে দাঁড়িয়ে আছেন।
তখন ঘোষণা দেওয়া হল- অনুষ্ঠান হবে। এই পনের-কুড়িজন মানুষ নিয়েই হবে বই বিনিময় উৎসব। মঞ্চে ডাকা হলো অনুষ্ঠানের উদ্বোধক জয়নাল আবেদিনকে। তাকে প্রথমে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হলো। তখনও অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে।
আয়োজক জহির রায়হান নিজেই অতিথির মাথার ওপর ছাতা ধরে আছেন। উৎসবের উদ্বোধনের পর উপস্থিত বইপ্রেমীরা বই বিনিময় করেন এবং আড্ডায় মেতে ওঠেন। বৃষ্টিও দমাতে পারেনি তাদের।
আয়োজক প্রতিষ্ঠান ‘মেঘের ধাক্কা’র পরিচালক কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জহির রায়হান স্বাগত বক্তব্যে বলেন, “আমরা যে বার্তা নিয়ে এই আয়োজন করেছি সেটা যদি শতশত মানুষের পরিবর্তে দু্ই-চারজন মানুষের কাছেও পৌঁছায়, তাতেও আমি মনে করি আমাদের উদ্দেশ্য সফল।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের সমাজে যখন পচন ধরে, মানবিক অবক্ষয় ঘটে, অন্ধকার নেমে আসে। তখন প্রয়োজন হয় আলোর। আর বই হলো সেই আলো। এই আলোর পথের যাত্রী ছিলেন সাদা মনের মানুষ পলান সরকার। তিনি জীবনের সমস্ত বিকিয়ে দিয়ে প্রতিদিন দশ-বারো কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বিনামূল্যে বই বিতরণ করেছেন। বিনে পয়সায় বই পড়িয়েছেন। তাই পলান সরকার স্মরণে এই আয়োজন এবং এই আলোর যাত্রা প্রতি বছর নিরন্তরভাবে চলতে থাকবে।”
তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মলয়বালা পবিত্র শিল্প গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে উপস্থিত সবার হাতে বই তুলে দেন। অতিথি জয়নাল আবেদিনের হাতেও তিনি অনেকগুলো বই তুলে দিয়েছেন তার লাইব্রেরির জন্য।
অনুষ্ঠানের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় জয়নাল আবেদিনের। তিনি বলেন, “এমন একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারা তো আসলেই আনন্দের। আয়োজকদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।”
কুড়িগ্রামে যে পাঠাগারটি গড়েছেন তিনি, সেই পাঠাগার থেকে যদি শিক্ষার আলো নিয়ে আলোকিত মানুষ তৈরি হয় তবে তার পাঠাগারের উদ্দেশ্য সার্থক বলে মনে করেন তিনি।
পাঠাগার পরিচালনা করতে গিয়ে কোনো সংকটে পড়তে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের এলাকার লোকজন এখনো বুঝে উঠতে পারে না, পাঠাগার কি, এটাই বড় সংকট। এখন অনেক ছেলেমেয়ে পাঠাগারে আসে, বই পড়ে। এক সময় পাঠাগারটি আরও বড় হবে। অনেক লোক বই পড়বে এবং ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সাধনা করবে। তবেই পাঠাগারের উদ্দেশ্য সফল হবে।”
বই বিনিময় উৎসবে এসেছিলেন বইপ্রেমী ও নাট্যশিল্পী হুমায়ূন আজম রেওয়াজ।
তিনি বলেন, “আয়োজনটি দারুণ। সবাই আসবে, একে অপরের সঙ্গে বই নিয়ে কথা বলবে এবং বই বিনিময় করবে, আড্ডা দেবে। এটি প্রতি বছর হবে বলেই প্রত্যাশা করি। আজকে বৃষ্টি না হলে হয়তো আরও অনেক লোক থাকত। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই এমন ব্যতিক্রমী একটি আয়োজন করার জন্য।”