দুর্নীতির অভিযোগে বিভাগীয় মামলা, শাস্তি ‘তিরস্কার’

তদন্তে প্রমাণ হয়, ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্পে ৫৩ লাখ ৬২ হাজার টাকার অনিয়ম করা হয়েছে

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2023, 02:58 PM
Updated : 7 May 2023, 02:58 PM

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তত্ত্বাধায়ক প্রকৌশলী কার্যালয়ের একটি প্রকল্পে দুর্নীতি প্রমাণ হওয়ার পর পাঁচ প্রকৌশলীর চার জনকে শাস্তি হিসেবে তিরস্কার ও সতর্ক করা হয়েছে; একজনের ক্ষেত্রে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বেতন স্কেল।

এই কর্মকর্তারা হলেন- তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এ এইচ এম ডি নূর উদ্দীন চৌধুরী, শরীফুল ইসলাম, নাসিম আল ইসলাম, শহীদুজ্জামান ও সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম।

এদের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুজ্জামানের (বর্তমানে সহকারী প্রকৌশলী) ‘বেতন স্কেল নিম্নস্তরে অবনমিতকরণ’ শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

আর নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) শরীফুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী নাসিম আল ইসলাম ও সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলামকে ‘সতর্ক’ করা হয়েছে।

তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এ এইচ এম ডি নূর উদ্দীন চৌধুরীকেও শুধু তিরষ্কার করা হয়েছে।

‘দায়িত্বে অবহেলা’ ও ‘দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার’ দায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে অফিস আদেশে, সেখানে দুর্নীতির তথ্যের কোনো উল্লেখ করা হয়নি।

কী অভিযোগ

২০১৭ সালে বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (পি অ্যান্ড ডিকিউএস) কার্যালয়ের একটি ফটক ও ওয়েটিং রুম নির্মাণে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

ওই কাজে ‘ব্যাপক দুর্নীতি’র অভিযোগ ওঠায় বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে যুগ্মসচিব মোশাররফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কমিটি যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে ওই ফটক নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়।

তদন্ত কমিটির হিসাব অনুযায়ী ‘তুলনামূলক ছোট আকারের’ এই প্রকল্পে ৫৩ লাখ ৬২ হাজার টাকার অনিয়ম করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটি এই দুর্নীতিতে জড়িত ১০ জন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি গিয়ার টুলের মূল্য দেখানো হয়েছে দেড় লাখ টাকা। বাস্তবে সেখানে হুইল বুশ বিয়ারিং (গাড়ির চাকায় ব্যবহৃত বিয়ারিং) ব্যবহার করা হয়েছে যার একেকটির দাম দুই হাজার টাকা। এই হিসাবে দুটোর দাম চার হাজার টাকা।

প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ লেটারিং ও বিভিন্ন সাইজের বল স্থাপন কাজে ১ হাজার ৪৮৩টি বলের ব্যবহার করা হয়েছে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে ব্যবহৃত হয়েছে ৫২৮টি এবং এগুলোর দামও অত্যন্ত বেশি দেখানো হয়েছে, যা ‘সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সেখানে বলা হয়, প্রতি বর্গমিটার কাজের দর ৬৩ হাজার ৭৫৫ টাকার পরিবর্তে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা ‘অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়’।

প্রাক্কলন ও ব্যায় বিবরণী যাচাই করে তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, ব্যয়বহুল গেটটির জন্য কোনো স্থপতির মাধ্যমে নকশা প্রণয়ন করা হয়নি। তার ফলে ফটকটি দৃষ্টিনন্দন বলে দৃষ্টিগোচর হয় না। কাজটি বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিরাপত্তা বিধান। কিন্তু সেই বিবেচনাতেও ফটকটি উপযোগী বলে মনে হয়নি।

ফটকের ওপরে স্টেইনলেস স্টিলের বাংলা ও ইংরেজি হরফ বসানোর জন্য হরফপ্রতি খরচ দেখানো হয়েছে ৩ হাজার ৮৫০ টাকা। সেখানে এসএস পাত কাটা, ঝালাই, স্ক্রু লাগানোসহ বিভিন্ন চার্জ যুক্ত করা হয়েছে, যা কোনভাবেই ‘যুক্তিসঙ্গত নয়’ বলে তদন্ত কমিটি মনে করেছে।  

গণপূর্ত অধিদপ্তরের অনুমোদিত দর থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দর নির্ধারণে অযৌক্তিকভাবে উচ্চতর দর বিবেচনা করা হয়েছে। যেমন ৫০ মিলিমিটার ডায়া এসএস পাইপের গণপূর্ত কর্তৃক নির্ধারিত দর ২৫০ টাকা প্রতি ফুট। এর পরিবর্তে সেখানে ২৯৭ টাকা প্রতি ফুট দরে এই পাইপ কেনা হয়েছে।

বিভাগীয় মামলা ও লঘুদণ্ড

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচকের ওই পাঁচ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। ব্যক্তিগত শুনানি ও মামলার তদন্তের পর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এক অফিস আদেশে তাদের ওই ‘লঘুদণ্ড’ দিয়ে সতর্ক করে মামলার নিষ্পত্তি করা হয়।

এ বিষয়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বেবিচকের অফিস আদেশে বলা হয়, “ব্যক্তিগত শুনানি, তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতিবেদন ও নথি পর্যালোচনা করে বর্ণিত কাজের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ও সুচারু রূপে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে দায়িত্ব পালনে অবহেলার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে লঘুদণ্ড প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাকে ‘তিরষ্কার’ সূচক লঘুদণ্ড দিয়ে বিভাগীয় মামলাটির নিষ্পত্তি করা হল।”

নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে সহকারী প্রকৌশলী) শহীদুজ্জামনের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, “আলোচ্য কাজের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করে লঘুদণ্ড দিয়ে বিভাগীয় মামলাটি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে।

“সিদ্ধান্ত মোতাবেক তার বেতনস্কেল নিম্নস্তরে অবনমিতকরণ সূচক লঘুদণ্ড দেওয়া হল। অর্থাৎ তার বেতন স্কেল নবম গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে নামিয়ে মামলাটির নিষ্পত্তি করা হল।” 

নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) শরীফুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী নাসিম আল ইসলাম ও সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলামকে সতর্ক করে অফিস আদেশ দেওয়া হয়েছে, সেখানে দুর্নীতির কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটা এমন হয়নি যে তাদের আমরা নির্দোষ বলছি। চাকরিবিধি অনুযায়ী যে শাস্তি তাদের তাই দেওয়া হয়েছে।”

বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীও বলছেন, আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “যেভাবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইনে যতটুকু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে তার বেশি সাজা দেওয়া তো উচিৎ না। কারও দুই বছরের সাজা হওয়ার কথা যেখানে, সেখানে তো তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া যায় না। আমরা কাউকে ছাড় দিচ্ছি না কিন্তু।”

এই ধরনের লঘুদণ্ড দুর্নীতিকে আরও উৎসাহ দেবে কী না– তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর (অব.) এম ইকবাল হোসেন।

তিনি বলেন, “যেখানে একটা কেসের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে সেখানে দুর্নীতি হয়েছে, সেখানে আমার মনে হয় না লঘুদণ্ড বা তিরষ্কার কোন পানিশমেন্ট হতে পারে।

“দুর্নীতি ১০ টাকার হোক আর ১০০ টাকার হোক সেইম। নেক্সট টাইম সে এক কোটির জায়গায় পাঁচ কোটি টাকা মারবে, তারপর হবে ৫০ কোটি তারপর ১০০ কোটি।”