কত কষ্ট আর সংগ্রাম করে মেয়ে বড় হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এল- বিলাপ করতে করতে বলছিলেন ঢাকায় বাসের ধাক্কায় নিহত এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর বাবা-মা।
Published : 22 Jan 2023, 11:42 PM
এক সপ্তাহ আগেই নারায়ণগঞ্জের বাসা ছেড়ে উত্তরায় হোস্টেলে উঠেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নাদিয়া আক্তার। উচ্চ শিক্ষায় বাড়ির মায়া কাটিয়ে ঢাকায় আসা সেই মেয়ে সপ্তাহ না ঘুরতেই একেবারেই চলে গেলেন; সড়ক দুর্ঘটনার এক স্বপ্নের সলিল সমাধি হল।
পোশাক কারখানার কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে মেয়েকে পড়াচ্ছিলেন। নাদিয়াকে ভর্তি করিয়েছিলেন বেসরকারি নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। মেয়ের স্বপ্ন ছিল ফার্মাসিস্ট হওয়ায়।
সেই স্বপ্ন ভেঙে গেল রোববার দুপুরে ঢাকায় প্রগতি সরণিতে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসের ধাক্কায়। সেখানে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার সময় বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন। পরে সেই বাসের তলায় পড়ে প্রাণ হারান তিনি।
এরপর নাদিয়ার মরদেহ আনা হয় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আনা হলে সেখানে জড়ো হন স্বজন ও বন্ধুরা। মর্গে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাদিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আালম ও মা পারভীন বেগম।
কত কষ্ট আর সংগ্রাম করে সেই মেয়ে বড় হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এল- এসব নানা কথা বিলাপ করতে করতে বলছিলেন তার বাবা-মা।
জাহাঙ্গীর বলছিলেন, একসময় পোশাক কারখানার কর্মী ছিলেন তিনি। এখন একটি পোশাক কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে কাজ করছেন। তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় নাদিয়া।
রোজগারের সিংহভাগই খরচ করেন তিন মেয়ের পড়াশোনার পেছনে। গত ডিসেম্বরেই লাখ টাকা খরচ করে বড় মেয়ে নাদিয়াকে ভর্তি করেছিলেন রাজধানীর আশকোনার নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে। স্বপ্ন ছিল মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করবে, ছোট বোনগুলোকেও পথ দেখাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যুতে বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ
মোটরসাইকেলে বাসের ধাক্কা, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু
জাহাঙ্গীর জানান, তারা নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় থাকেন। ক্লাস শুরু হবে বলে এক সপ্তাহ আগে উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের একটি হোস্টেলে এসে ওঠেন নাদিয়া। এরপর রোববার দুপুরে ফোন যায় জাহাঙ্গীরের ফোনে, “আপনার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করছে, তাড়াতাড়ি আসেন।” তখনই আত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল তার।
ফোনদাতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ও কোথায়, কেমন আছে”। যিনি ফোন করেছিলেন তিনি জানিয়েছিলেন, “যমুনা ফিউচার পার্কের ওখানে আছে, ভালো আছে।”
ছুটতে ছুটতে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে ঢাকার পথ ধরেন জাহাঙ্গীর ও তার স্ত্রী। তবে মাঝপথেই ঠিকানা বদলে যায়, তাদের আসতে বলা হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে এসে শুনলেন ততক্ষণে সব শেষ। দিশেহারা বাবা-মা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। তখন সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্য তৈরি হয়।
হাসপাতালের মর্গে জড়ো হয়েছিলেন নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হারুন উর রশীদসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
অধ্যাপক হারুন বলছিলেন, গত ১২ জানুয়ারি এ ব্যাচটার পরিচিতিমূলক (অরিয়েন্টেশন) ক্লাস হয়েছে। কথা ছিল দুই পর্বের ইজতেমা শেষ হলে পূর্ণাঙ্গ ক্লাস শুরু হবে। তার আগেই ছাত্রী নাদিয়ার নিহত হওয়ার খবর শুনলেন তারা।
এদিকে নাদিয়ার মৃত্যুর খবর নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের আশকোনা ক্যাম্পাসে পৌঁছানোর পর বিকালে কাওলা এলাকায় বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় দেড়ঘণ্টা সড়ক আটকে রাখেন তারা।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের (বিমানবন্দর) অতিরিক্ত উপ কমিশনার তাপস কুমার দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তারা কাওলা এলাকার বিমানবন্দর সড়কে অবস্থান নেয় এবং যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলে ময়মনসিংহ সড়কের দুইপাশ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীরা ভিক্টর পরিবহনের চালককে গ্রেপ্তার ও ওই পরিবহনের রুট পারমিট বাতিল, নাদিয়ার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, কাওলা এলাকায় বাস স্টপেজের দাবি করেন। তাদের দাবির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে সন্ধ্যায় তারা সড়ক থেকে সরে যান।