কারা কেন সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, সত্য বেরিয়ে আসুক: কর্নেল নাজমুল হুদার মেয়ে

“সন্তানের কাছে এরকম দিন যেন না আসে, যে তার বাবার হত্যার বিচার চাইতে হয়,” বলেন সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 May 2023, 03:57 PM
Updated : 11 May 2023, 03:57 PM

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রমকে যখন হত্যা করা হয়, তার মেয়ে নাহিদ ইজাহার খানের বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর।

কঠিন সেই সময়ে বৈরী পরিবেশে বেড়ে ওঠা নাহিদ এখন বাংলাদেশের একজন আইনপ্রণেতা। বাবার হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ৪৮ বছর পর একটি মামলা করেছেন তিনি।

তার প্রত্যাশা, এখন অন্তত ভালো করে অনুসন্ধান হোক; কারা কেন সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল, সেই সত্য বেরিয়ে আসুক। 

বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নাহিদ ইজাহার খান বলেন, “চিন্তা করেছিলাম, জীবনে কোনো একটা সময়, যখন আমি মনে করব যে, আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাইতে পারব, আমি নিজে গিয়ে মামলা করব। গতকাল সেটাই আমি করে এসেছি।”

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতায় বসলেও চলছিল অস্থিরতা। এর মধ্যেই ৩ নভেম্বর সেনা কর্মকর্তা খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়, গৃহবন্দি করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।

৭ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান হয় জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে। তখন মুক্ত হন জিয়া; নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তম এবং সাব সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদা বীর বিক্রম।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে খালেদ মোশাররফসহ তিন সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা নিয়ে তাদের পরিবারের আক্ষেপ ছিল।

সেই আক্ষেপ ঘোচাতে বুধবার ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেছেন নাজমুল হুদার মেয়ে নাহিদ ইজাহার খান।

এজাহারে তিনি লিখেছেন, সেই সময়ের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা তাহেরের নির্দেশে ২০-২৫ জন সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকের একটি দল নাজমুল হুদাসহ তিন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে।

ওই ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে কেবল ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক মেজর আব্দুল জলিল জীবিত আছেন জানিয়ে তাকেই মামলার এজাহারে আসামি করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকার মহানগর হাকিম রশিদুল আলম আগামী ১২ জুনের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন পুলিশকে।

নাহিদ ইজাহার খান বলেন, “এটা একটা ডিফিকাল্ট বিষয় ছিল বাবার হত্যার বিচারের জন্য মামলাটা করা। সন্তানের কাছে এরকম দিন যেন না আসে, যে তার বাবার হত্যার বিচার চাইতে হয়।”

সেই দিনগুলোর স্মৃতি স্মরণ করে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন সংরক্ষিত আসনের এই সংসদ সদস্য। বলেন, “বাবা যখন চলে যান, তখন আমার বয়স ৫ বছর, আমার ভাইয়ের ছিল ৮ বছর। আপনি জানেন যে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি… সব কিছু পুরো লাইফ স্টাইল আমাদের চেঞ্জ হযে যায়।

“আমরা স্কুলে যেতে পারতাম না, একেক দিন একক বাসায় থাকা, আমাদের ছোট বেলা এবং পরবর্তীতে কী গেছে আমাদের ওপরে…।”

কঠিন ওই সময়ে মায়ের কাছ থেকে লড়াই করার শক্তি পাওয়ার কথা জানিয়ে নাহিদ ইজাহার খান বলেন, “যখন আমরা মাকে বলতাম যে, বাবার নামে কি সব বলে, আমার বাবা নাকি দেশদ্রোহী, স্কুলে পড়তে পারতাম না সে ভাবে। তখন মা সব কিছু বাদ দিয়ে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলতেন।”

বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা ষড়ন্ত্র মামলার ২৭ নম্বর আসামী নাজমুল হুদা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন যশোর ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের কমান্ডার। তার নেতৃত্বে পরিচালিত গরিবপুরের ট্যাংক যুদ্ধ এবং চৌগাছা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাভূত হয়েছিল।

৬ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম জেলা হিসাবে যশোর মুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব দেয়। 

নাহিদ ইজাহার খান বলেন, তার বাবা যখন আগরতলা ষড়ন্ত্র মামলার আসামি হন, তখন তার বয়স ছিল ২৭ বছর। আর মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৩৭ বছর।

মামলা করতে এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই এমপি বলেন, “আমার মনে হয়েছে, দিস ইস দ্য রাইট টাইম। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আছে আমাদের সাথে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আছে।”

Also Read: খালেদ মোশাররফসহ তিন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা হত্যায় ৪৮ বছর পর মামলা

নিজেকে এখন আর একা মনে করেন না জানিয়ে তিনি বলেন, টিভি খুললেই এখন তার মত অনেক সন্তানকে তিনি দেখেন, যারা বাবার হত্যার বিচার চায়।

দেরিতে হলেও ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা জানিয়ে নাহিদ ইজাহার খান বলেন, “আমি মানুষের মুখে শুনেছি মেজর আসাদ এবং মেজর জলিল আমার বাবাকে হত্যা করেছে। তারা নরমালভাবে হত্যা করেনি, ভাল করে অনুসন্ধান হোক। তথ্য আরো বের হয়ে আসুক। সব কিছু আসুক, কারা কারা জড়িত ছিল, কেন তাদের হত্যা করা হল।”

ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর মো. আসাদুজ্জামান মারা গেলেও মেজর মো. আব্দুল জলিল (অব.) এখনও জীবিত জানিয়ে মামলার বাদী বলেন, তিনি এখন কোথায় আছেন, তদন্ত করে সেটা বের করা হোক।