হারিয়ে যাচ্ছেন হরিপদরা, প্রতিমা গড়বেন কারা?

যেভাবে সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে, এক সময় হয়ত মাটির বদলে ফাইবারের প্রতিমার প্রচলন শুরু হতে পারে, বলছেন পূজা উদযাপন কমিটির এক নেতা।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2023, 07:41 PM
Updated : 16 Oct 2023, 07:41 PM

পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারের সরু গলির ছোট্ট একটি দোকানে বসে দুর্গা পূজার প্রতিমা গড়ায় ব্যস্ত ষাটোর্ধ্ব ভাস্কর হরিপদ পাল। সুনিপুণ হাতে তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলছেন দুর্গার অবয়ব।

কথার ফাঁকে বলছিলেন, “বয়স হয়েছে, মাটির কাজ করতে গিয়ে ঠাণ্ডা লেগে যায়। শরীরে আগের মতো শক্তি পাই না।”

শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও কেন কাজ করছেন? হরিপদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই কাজটা ভালো লাগে, আমার জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। যতদিন বাঁচব, এই কাজটা ছাড়তে পারব না।”

হরিপদর সঙ্গে আলাপে উঠে এল মৃৎশিল্পের নানা প্রসঙ্গ। কয়েক দশক আগেও ঢাকায় প্রচুর মৃৎশিল্পী ছিল, এখন তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। এদের সবাই আবার প্রতিমা বানানোর কাজ করেন না। কেউ কেউ মাটির সরা, পাতিলসহ নানা রকম তৈজসপত্র তৈরি করেন। মাটির পুতুল, মূর্তিসহ অন্যান্য শিল্পকর্মও তৈরি করেন কেউ কেউ।

ঢাকার বেশিরভাগ মন্দিরে যারা প্রতিমা গড়ছেন, তাদের প্রায় সবাই আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন। কেউ এসেছেন দূরের শহর থেকে।

হরিপদ পাল জানান, এক সময় পুরান ঢাকার সূত্রাপুর, শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার এবং মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজারে অনেক মৃৎশিল্পীর বসবাস ছিল। ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমারপাড়ার অনেকে পরিবার দেশ ছেড়ে চলে যায়।

হরিপদ পালও ১৯৭১ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে। স্বাধীনতার পর ফিরে আসেন। তার ভাষ্য, “আমার দেশ তো এখানে। আমার এখানেই ভালো লাগে। অনেকে থাকতে বলল। আমার ওইখানে ভালো লাগে নাই। তাই চলে আসছি।“

এই শিল্পের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়েছেন? হরিপদ পাল বলেন, “ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কাজ করতে করতেই শুরু। এরপর আর কিছু করিনি।”

ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা কেন্দ্র’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিম বখশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যতটুকু জানি, এখন ঢাকায় যারা প্রতিমা নির্মাণের কাজ করেন, তাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। তাদের বড় অংশ আসেন বিক্রমপুর ও সিরাজদিখান থেকে। যেহেতু ঢাকার কাছাকাছি, তাই তারা এসে কাজ করে আবার নিজ লোকালয়ে ফিরে যান।”

তিনি জানান, একটি প্রতিমার কাজ শেষ করতে অনেক বিষয়ে দক্ষ লোকের প্রয়োজন হয়।

“প্রতিমা তৈরির কাজটি যারা করেন, তারা কিন্তু অলঙ্কারের কাজ করেন না। এই কাজটি করেন আরেক ধরনের শিল্পীরা। রঙের কাজও করেন বিশেষভাবে দক্ষ যারা, তাদের একটি অংশ।”

প্রাণবল্লভ জিঁউ মন্দিরের পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মতিলাল দাশ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা নিখুঁতভাবে কাজটি পারে, তাদের চাহিদা বেশি। যেমন টাঙ্গাইলের একজন শিল্পী আছেন, তিনি এবার বরিশালে কয়েকটা প্রতিমা তৈরি করছেন। উনার কাজ দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। শাঁখারিবাজারের সবচেয়ে প্রবীণ শিল্পী হরিপদ পাল। উনার বয়স হয়েছে, কিন্তু কাজ অনেক নিখুঁত।”

মৃৎশিল্প যে বিলুপ্তির পথে, সে কথা তুলে ধরে মতিলাল বলেন, এ শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

“এক সময় কিন্তু মাটি দিয়েই প্রতিমার শরীরের অলঙ্কার বানানো হত। এখন তো সরাসরি অলঙ্কার ব্যবহার করা হয় প্রতিমার শরীরে।

“কারণ, নিখুঁত হাতে প্রতিমার জন্য মাটির অলঙ্কার তৈরির শিল্পী খুব বেশি নেই। সবাই এই কাজ পারেন না। প্রতিমার শেষ ফিনিশিং কিন্তু সবাই দিতে পারেন না। আবার প্রতিমা যারা তৈরি করেন, তারা কিন্তু রঙের কাজ করেন না। রঙের কাজের মধ্যেও নান্দনিকতা আছে। এটা করার জন্য আলাদা দক্ষতা লাগে। বিক্রমপুরের শিল্পীদের রঙের কাজ ভালো।”

হরিপদ পালের ভাই বলাই চন্দ্র পাল এবারের পূজায় বাংলাবাজারের বিউটি বোর্ডিংয়ের পাশের শ্রী শ্রী প্রাণবল্লভ জিঁউ মন্দিরে কাজ করছেন। তবে সেখানে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার সহকর্মীরা জানান, অন্য একটি মন্দিরে গেছেন কাজে। ফিরতে দেরি হবে।

বলাইচন্দ্র পালের কাজে সহযোগিতা করছেন টাঙ্গাইলের নিতাইচন্দ্র পাল ও সিরাজগঞ্জের প্রতিমা শিল্পী সাধন চন্দ্র পাল।

বিকেল তখন ৪টা বাজে, কথা বলতে চাইলে নিতাইচন্দ্র পাল জানান, দুপুরের খাবার খেতে পারেননি কাজের চাপে। কথা বলতে আগ্রহী নন।

সাধন চন্দ্র পাল বলেন, “এখন ঢাকায় যত মন্দির আছে, তার বেশিরভাগ প্রতিমা তৈরি করেন ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিল্পীরা। ঢাকায় বসবাস করলে তো অনেক খরচ, এজন্য অনেকে গ্রামের দিকেই থাকে। আর মাটির কাজ করার জন্য একটু জায়গাও তো দরকার হয়।”

তিনি জানালেন, ঢাকার অনেক মন্দিরের প্রতিমা এখন পাশের অন্য কোনো একটি জায়গা থেকে বানিয়ে আনা হয়। কারণ, “জায়গার সংকট।”

প্রাণবল্লভ জিঁউ মন্দিরে বলাইচন্দ্র পালের সহকর্মীরা যে প্রতিমাগুলো তৈরি করছেন তার মধ্যে একটি প্রতিমা যাবে ফরাসগঞ্জ রোডের মণ্ডপে।

সময়ের বিবর্তনে এক সময় মাটির প্রতিমার জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার চলে আসবে বলেও মনে করেন প্রাণবল্লভ জিঁউ মন্দিরের পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মতিলাল। তিনি বলেন, “যেভাবে সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে, এক সময় হয়ত ফাইবারের প্রতিমার প্রচলন শুরু হতে পারে। কিন্তু মাটির শিল্পটার প্রতি আমার অন্যরকম ভালো লাগা আছে। মাটির প্রতিমা শিল্প রক্ষার জন্য তরুণদের মধ্যে শিল্পী তৈরি করতে হবে।”

তরুণদের মধ্যে এখন কেউ মৃৎশিল্পে আগ্রহী হচ্ছেন না জানিয়ে হরিপদ পাল বলেন, “এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগ আছে। আমাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যায়। আবার চারুকলার ছাত্রছাত্রীরাও আসে আমার কাছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র মাঝে মাঝে আমার এখানে আসে কাজ শিখতে।”

শাঁখারিবাজারের জগন্নাথ শিল্পালয়ে গিয়ে দেখা যায়, মুকুট, শাঁখা, শাড়িসহ প্রতিমার বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরি করছেন শিল্পীরা।

প্রতিষ্ঠানটির স্বত্তাধিকারী রিংকু সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সাধারণত পূজার ২/৩ মাস আগে থেকে প্রতিমার অলঙ্কার তৈরির কাজ শুরু করি। আমাদের এখান থেকেই সারা দেশে পাইকারি মূল্যে অনেকে নিয়ে যান, তারা সেখানে বিক্রি করেন।”

ঢাকায় প্রতিমা শিল্পী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে রিংকু সরকার বলেন, “এখন তো মাটির কাজ বা মৃৎশিল্পের মূল্যায়ন কমে গেছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। এজন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছে। দুর্গা পূজার প্রতিমা তো সারা বছরের কাজ না। এজন্য নানামুখি কারুশিল্পের কাজ করতে হয় শিল্পীদের।”

রমনা কালী মন্দিরে রতন পালের নেতৃত্বে গোপালগঞ্জের শিল্পীরা প্রতিমা তৈরি করছেন। শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত তারা। ঢাকেশ্বরী মন্দিরেও প্রতিমার কাজ করছেন ঢাকার বাইরে থেকে আসা শিল্পীরা।