দিনভর অকারণে বাজতে থাকে হর্ন। গবেষণায় নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার দ্বিগুণ শব্দ পাওয়া গেছে। হাইড্রলিক হর্ন নিষিদ্ধ হলেও উচ্চ শব্দের অন্য হর্ন নিয়ে নেই কোনো সিদ্ধান্ত।
Published : 15 Oct 2023, 08:23 AM
মহাখালীর কাকলী এলাকায় সড়কে শনিবার বিকেলে গাড়ির চাপ বেশ কম। মোটামুটি ফাঁকা সড়কে চলছে নির্বিঘ্নে যাতায়াত। এই অবস্থাতেও বনানী থেকে মহাখালী আমতলী পর্যন্ত এক কিলোমিটারের কম সড়কে একটি প্রাইভেট কারের চালক হর্ন বাজালেন ছয় বার।
আমতলী সিগন্যালে থামল গাড়িটি।
‘রাস্তা তো ফাঁকাই ছিল, কেন এতবার হর্ন দিলেন?’- প্রশ্ন শুনে চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে সেই চালক বললেন, “ডানে-বামে থেকে গাড়ি সামনে চলে আসে, এজন্য দিছি। আপনার সমস্যা কী?”
উচ্চ শব্দের হর্ন যে অন্যের সমস্যা করে, আর এই চালকের মত অন্যরাও যে তা পাত্তা দেয় না, তা চোখে পড়ে নিত্যদিনই।
দিন রাত সব সময় হর্নের অবিরাম শব্দে কান ঝালাপালা মানুষের। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি শব্দে জীবন ওষ্ঠাগত, মেজাজ হচ্ছে তিরিক্ষি। ক্ষতি হচ্ছে শ্রবণশক্তির।
এই সমস্যা জানে সরকার। কিন্তু ‘সবাই দূষণকারী’ বলে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন, বলছেন খোদ পরিবেশ সচিব।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় জানতে পেরেছে, শব্দ দূষণে দেশে প্রধানত দায়ী যানবাহন ও হর্ন। কিন্তু পুলিশের হাতে হর্নের মাত্রা মাপার কোনো যন্ত্র দেওয়া হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়া সাজার সুযোগ নেই। কিন্তু এই আদালত বসালে সড়কে বাঁধে যানজট।
এ নিয়ে চালকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব যে স্পষ্ট, তা ধরা পড়ে অহরহ। তাই সরকার এবার চালকদের সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে।
এই লক্ষ্যে রোববার সকাল ১০টায় ঢাকার ১১টি স্থানে ‘এক মিনিট শব্দহীন’ কর্মসূচি পালন হবে। পরিবেশ সচিব ফারহিনা আহমেদ আশা করছেন, এভাবে সচেতনতা বাড়বে।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হর্ন নিয়ে গণ অসচেতনতায় হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যদি আমরা বিধিমালা প্রয়োগ করি, আমাদের জেলখানায় ঠাঁই হবে না, একেবারে প্রত্যেকেই ভায়োলেটর।“
২০১৮ সালে করা সড়ক পরিবহন আইনের ৪৫ ধারায় বলা আছে, নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত উচ্চমাত্রার শব্দ বা হর্ন বাজালে তিনি সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এতে চালকের এক পয়েন্ট কাটা হবে।
কিন্তু এ আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বললেই চলে।
হর্ন দিলে কী লাভ?
এই কর্মসূচির আগের দিন বেশ কয়েক চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগই হর্ন দেন অপ্রয়োজনে। পেছন থেকে যে যানবাহনের চালক হর্ন দিচ্ছে সামনের যানবাহনের চালক তা আমলেই নিচ্ছেন না।
গাবতলী থেকে আবদুল্লাহপুর রুটের প্রজাপতি বাসের চালক জয়নাল আবেদীন বলেন, “পিছন থাইক্যা হুদাই হরেন দেয়।
“অনেক সময় যাওয়ার লাইগ্যা উত্তেজিত হয়্যা যায়। কিন্তু আমার ডাইনেবামে রিকশা, মোটরসাইকেল আর মানুষ থাহে। গাড়ি সরানোর জায়গা থাহে না, সাইড দিমু ক্যামনে?”
“বিশেষ করে মোটরসাইকেল আর ভিআইপি গাড়িগুলো। হর্ন বাজাইয়া পাগল কইরা ফ্যালে”, জয়নাল আবেদীনের কণ্ঠে ধরা পড়ে আরেকটি প্রবণতা।
ট্রাস্ট পরিবহনের চালক আমজাদ হোসেন বলেন, “পেছন থাইক্যা হর্ন বাজাইলে কিছু সময় শোনা যায়, কিছু সময় যায় না। আবার শোনা গেলেও করার কী আছে? হর্ন তো আর একটা গাড়ি বাজায় না। কিন্তু পেছন থেইক্যা সমানে বাজাইতেই থাকে।”
পেছন থেকে কেন হর্ন দিতে হয়- এই প্রশ্নে শাওন আহমেদ নামে এক চালক বলেন, “সামনের চালক কোনো কারণে গাড়ি আগে নিচ্ছে না, কিন্তু তার সামনে ফাঁকা। এই সময় তারে সিগন্যাল দেওয়ার লাইগ্গা হর্ন দিতেই হয়।
“তারে অ্যালার্ট করা যে পেছনে গাড়ি আছে। আর জায়গা থাকলে আমাকে সাইড দিয়া দিবে। আর তার সরার জায়গা না থাকলে পিছন দিক থেকে হর্ন বাজানোর কোনো প্রয়োজনই নাই।”
নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার দ্বিগুণ শব্দের হর্ন বাজারে
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে করা শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় ঢাকায় গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা সময় ও এলাকাভেদে আলাদা করে দেওয়া আছে।
বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকায় রাতে সর্বোচ্চ মাত্রা ৪০ ডেসিবেল আর দিনে ৫০। আবাসিক এলাকায় রাতে ৪৫ ও দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবেল শব্দ করা যাবে। মিশ্র এলাকায় যথাক্রমে ৫০ ও ৬০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল শব্দ গ্রহণযোগ্য। শিল্প এলাকায় তা রাতে ৭০ এবং দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবেল শব্দ করা যাবে।
একটি গাড়িতে যেহেতু একটিই হর্ন থাকে, তাই তা ৪০ ডেসিবলের নিচে থাকার কথা। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে এবং কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ঘুরে দেখা গেছে, বিক্রি হওয়া বেশিরভাগই ১০০ ডেসিবেল মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ তৈরি করে।
পরিবেশ অধিদপ্তর হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ করলেও প্রায় সমান শব্দ উৎপন্নকারী এসব হর্ন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়া এভিনিউয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ অভিযানে পাঁচটি গাড়ি পরীক্ষা করে একটিতে শব্দের মাত্রা পাওয়া যায় ১১০ ডেসিবল। অন্য চারটি ছিল যথাক্রমে ১০১, ৯৯, ৯৮ ও ৯৭।
বাংলাদেশের ঢাকার এফএনএম অটোমোটিভ নামে একটি কোম্পানি তিনটি মডেলের হর্ন বিক্রি করে। এরমধ্যে প্রথম দুটি স্নেইল ক্যাটাগরির এবং পরেরটি ডিস্ক হর্ন। এগুলোর মাত্রা ১০৫ থেকে ১১৮ ডেসিবেল।
মোটরকেয়ার বিডি নামে আরেকটি কোম্পানি বিক্রি করে ডেনসো ব্র্যান্ডের হর্ন। এটি ১১৫ ডেসিবেল মাত্রায় শব্দ তৈরি করে।
জাপান কারস নামে আরেকটি কোম্পানির ওয়েবসাইটে ডেনসোর হর্নের বিজ্ঞাপনে শব্দের মাত্রার উল্লেখ নেই, সেখানে বলা আছে, ‘লাউড সাউন্ড।’
অনলাইন মার্কেটপ্লেস দারাজে প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেলের কয়েক ধরনের হর্ন বিক্রি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
একটি পপ হাইড্রোলিক হর্নের গায়ে লেখা আছে ‘টাইপআর’। সেটি ১১৫ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। আরেকটি স্লেন্ডার হর্নের বিজ্ঞাপন রয়েছে। এটি উৎপন্ন করে ১১২ ডেসিবেল শব্দ।
কায়ার নামে একটি কোম্পানি হর্ন বিক্রি করে শপজ কমবিডি নাম একটি প্ল্যাটফর্মে। তাদের স্নেইলশেপড হর্ন মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার এবং থ্রি-হুইলারে ব্যবহার করা যায়। এটি ১১৫ ডেসিবেল শব্দ উৎপন্ন করতে পারে।
কিন্তু নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ উৎপাদনকারী হর্ন আমদানির বিষয়ে আমদানি নীতিতে কিছু বলার নেই।
গাড়ি আমদানিকারক ‘ইউ কারস’ এর স্বত্ত্বাধিকারী বেনজীর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গাড়ি আমদানির শর্তে বলা আছে হাইড্রোলিক হর্ন থাকা যাবে না। কিন্তু অন্য হর্নের মাত্রার বিষয়ে কিছু বলা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর বা সরকারের কোনো সংস্থাই দেশে গাড়ি সংযোজনের সময় হর্নের মাত্রার বিষয়ে কোনো শর্ত বেঁধে দেয় না।
শহরে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা কত
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস একটি গবেষণায় ২০২২ সালে ঢাকার দুই সিটির করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থানের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। তাতে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।
এতে উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া যায় ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবল । সবচেয়ে বেশি ৯৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবল মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, ৯৩ দশমিক ০৫ ডেসিবেল শিয়া মসজিদ মোড়ে, মাসকাট প্লাজা মোড়ে ৯০ দশমিক ২৭ ডেসিবল পাওয়া গেছে।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার গড় মাত্রা ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবেল। এর মধ্যে নিউমার্কেট মোড়ে ১০০ দশমিক ৬৫ ডেসিবেল, প্রেসক্লাব মোড়ে ৯২ দশমিক ২২ ডেসিবেল এবং পল্টন মোড়ে সবচেয়ে ৯০ দশমিক ০৩ ডেসিবেল শব্দ পাওয়া গেছে।
ঢাকার ১৭টি হাসপাতালের সামনে আরেকটি গবেষণা করে ক্যাপস। যেখানে শব্দদূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয় ৮৯.৯ ডেসিবল যা দিনের বেলায় নীরব এলাকার জন্য আদর্শ মান ৫০ ডেসিবলের চেয়ে অনেক বেশি।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হর্নের শব্দের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটা ফাঁক রাখা হয়েছে।
“শিল্প এলাকায় যন্ত্রের কাছে গিয়ে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা যাবে। কিন্তু যানবাহনের ক্ষেত্রে মাপতে হবে ২১ বা ২২ ফুট দূরে গিয়ে। তার মানে মোটরযানের হর্ন কী মাত্রায় শব্দ তৈরি করে, সেটি আসলে উঠে আসে না।”
ঢাকায় ‘প্রতি পাঁচ জনে একজনের’ শ্রবণ শক্তি ক্ষতিগ্রস্ত
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বিভাগের চিকিৎসক সাইকা নিজাম ২০২০ সালে শব্দ দূষণ নিয়ে রাজধানীতে একটি গবেষণা করেন।
সেই গবেষণায় যাদের পরীক্ষা করা হয়, তাদের মধ্যে ৭ শতাংশের শ্রবণশক্তি এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে, এখনই তাদের শ্রবণযন্ত্র লাগবে। ১৪ শতাংশের শ্রবণ শক্তিও নষ্ট হয়েছে ব্যাপকভাবে। তাদেরও যে কোনো সময় শ্রবণ যন্ত্র লাগতে পারে।
এই উচ্চশব্দ মানুষের জন্য কতটা ক্ষতিকর- জানতে চাইলে এই চিকিৎসক বলে, “কেবল শ্রবণশক্তি নষ্ট হচ্ছে, এমন নয়। এর কারণে হাইপারটেনশন হয়, ঘুমের সমস্যা হতে পারে। মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যেতে পারে। আরও নানা ক্ষতি হয়।”
‘শব্দহীন এক মিনিটে’ কী করবে সরকার
রোববার সকাল ১০টায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালন করি’ স্লোগানে এক মিনিট হর্ন না বাজানোর এই কর্মসূচি পালন করা হবে ঢাকার ১১টি স্থানে।
এলাকাগুলো হলো: ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনের রাস্তা, শাহবাগ মোড়, উত্তরা, বিজয় সরণী মোড়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, গাবতলী, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান-১, কমলাপুর, বৌদ্ধমন্দির ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা।
সেদিন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজের স্কাউট সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ উপস্থিত থেকে মানববন্ধন করবেন। এরপর গাড়ি চালকদের মধ্যে শব্দ সচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণ করা হবে। তাদেরকে হর্ন না বাজানোর অনুরোধ করা হবে।