স্ত্রীর করা মামলায় নথিপত্র উদ্ধারে তমিজী হকের বাসায় গিয়ে ফিরে এসেছে র্যাব। গ্রেপ্তার এড়াতে ‘আত্মহত্যার হুমকিও’ দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
Published : 22 Nov 2023, 11:20 PM
তার নামে মামলা রয়েছে একাধিক; এক সপ্তাহ ধরেই জোর গুঞ্জন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন ব্যবসায়ী আদম তমিজী হক। কিন্তু তার গুলশানের বাসায় তল্লাশি চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে র্যাব।
বুধবার সন্ধ্যার পরও তমিজীর বাড়ির বাইরে সাধারণ পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। পাশের সড়কে গাড়ি নিয়ে টহল দিতে দেখা গেছে র্যাব সদস্যদের।
তবে বিস্কুট কোম্পানি এ টি হক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আদম তমিজী গ্রেপ্তার হননি, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতেই তিনি আছেন।
তাকে একজন ‘বিস্ময়কর’ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলছেন, ‘পরিস্থিতি বুঝে’ তাকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করবেন তারা।
গত কয়েক বছরে নানা কারণে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে আসা আদম তমিজী এবারের আলোচনার সূত্রপাত ঘটান গত সেপ্টেম্বরে, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের বিরুদ্ধে সম্পত্তি দখলের অভিযোগ তুলে।
এর জবাবে প্রতিমন্ত্রী রাসেল বলেছিলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এটা তার বিরুদ্ধে একটি ‘চক্রান্ত’।
সে সময় ফেইসবুক লাইভে এসে নানা কথায় ক্ষোভ ঝাড়েন আদম তমিজী; এমনকি তার বাংলাদেশি পাসপোর্টও পুড়িয়ে ফেলেন, যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আওয়ামী লীগ থেকে তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।
দেশে ফেরার পর গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি ফেইসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার হুমকি দেন। নিজেকে একজন ‘ইহুদি’ ঘোষণা করে তিনি আশ্রয় চান ইসরাইয়েলের কাছে, যা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।
কে এই আদম তমিজী
বিস্কুট কোম্পানি এ টি হক লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আদম তমিজীর বাবা ব্যারিস্টার তমিজী হক। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কোম্পানির নাম দেশের মানুষ জানে বিস্কুট ও ব্যাটারির জন্য।
১৯৭৬ সালে জন্ম নেওয়া আদম তমিজী পড়ালেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশে ফিরে তিনি পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন এবং বাবার মৃত্যুর পর কোম্পানির দায়িত্ব নেন।
তার রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টা শুরু হয় ‘মানবিক বাংলাদেশ’ নামে একটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্য দিয়ে। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন তাঁতী লীগের এক কমিটিতে পদ পান।
২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। সেই মনোনয়ন না পেলেও ২০২০ সালে দলটির ঢাকা উত্তর সিটি কমিটিতে জায়গা পান।
মামলা কেন?
গত সেপ্টেম্বরে নিজের পাসপোর্ট পুড়িয়ে ফেলার সময় এক ফেইসবুক লাইভে কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাতজোড় করে ক্ষমা চান আদম তমিজী। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনা আমার মা।” বাংলাদেশে আর আসবেন না বলেও ঘোষণা দেন।
“পার্ক সার্কাস কলিকাতা গিয়ে দেখো আমরা কেডা। দুই পাশে জমিদার বাড়ি কার? আমাদের হক পরিবারের। তুই আমাদের নাবাবো…” বলেও বুক চাপড়ে কাঁদতে দেখা যায় এই ব্যবসায়ীকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে তিনি নিজের দলে রোষের মুখে পড়েন।
দল থেকে বহিষ্কারের পর তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে গত ১৫ নভেম্বর দক্ষিণ খান থানায় মামলা করেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনিছুর রহমান নাঈম।
মামলায় বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে নানা রকম বিরূপ মন্তব্য করেছেন আদম তমিজী হক। তিনি জনশৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপ, মিথ্যা আক্রমণাত্মক তথ্য-উপাত্ত প্রচারের মাধ্যমে ‘প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি’ দিয়ে আসছেন।
ওই মামলার অগ্রগতি জানতে চাইলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় নতুন কোনো অগ্রগতি নেই।
“আমরা তদন্ত করছি, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার সঙ্গে এখনও কোনো যোগাযোগ করার সময় হয়নি।”
অবশ্য র্যাব আদম তমিজীর গুলশানের বাসায় অভিযানে গিয়েছিল তার স্ত্রীর করা এক মামলায় আদালতে নির্দেশে কিছু নথিপত্র উদ্ধারের জন্য। কিন্তু তমিজী তখন ফেইসবুক লাইভে এসে ‘নাটকীয়তার সৃষ্টি করেন’ বলেন র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈনের ভাষ্য।
তিনি বলেন, নিয়ম মেনেই তারা তল্লাশি করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তমিজী এক পর্যায়ে চাকু নিয়ে আত্মহত্যার হুমকির পাশপাশি জানালার কাচ ভেঙে এক পা বাইরে বের করে লাফ দেওয়ার হুমকি দেন।
“অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আমরা সেখান থেকে চলে আসি”, বলেন মঈন।
আদম তমিজীরর স্ত্রী সাইরা সিদ্দিকী তানহা আদালতে গিয়ে ওই মামলা করেন গত অক্টোবরে। তবে পুলিশ বলছে, তানহা যে অভিযোগ করেছেন, এখন আর তার কোনো যৌক্তিকতা দেখছে না তারা।
সেই মামলায় তানহা বলেন, ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তমিজীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরে জানতে পারেন তার স্বামীর একাধিক বিয়ে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তাকে শারীরিকভাবে আঘাত করা হয়। গত ২৯ সেপ্টেম্বর জোর করে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে ২ অক্টোবর তাকে তালাকের নোটিস পাঠান তমিজী।
এ মামলায় পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র, সকল শিক্ষা সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংকের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড উদ্ধারের আবেদন জানানো হয় আদালতের কাছে। পরে ৩০ অক্টোবর আদালত গুলশান থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়।
মামলায় তমিজী ছাড়াও তার বাড়ির ঠিকানায় মো. বাশার এবং হযরত আলী আহসান নামের দুইজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশনার অগ্রগতি জানতে চাইলে মঙ্গলবার গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ সাহানুর রহমান বলেন, “এ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে জানা যায়, যে বাসায় তল্লাশি চালানোর জন্য আদালত নির্দেশনা দিয়েছে, সেই বাসায় তমিজী তার স্ত্রীকে নিয়েই অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে মিটমাট হয়ে গেছে।”
শেখ সাহানুর রহমান জানান, তারা যে স্বামী-স্ত্রী মিলে গেছেন, তা ফেইসবুক লাইভে তমিজী দেখিয়েছেন। তাছাড়া যিনি অভিযোগকারী, তিনি আর পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এ ব্যাপারে আদালতকে পরবর্তী তারিখে অবহিত করা হবে।
আদালত থেকে পাওয়া নথিতে তানহার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোন বন্ধ করেন।
মামলায় বাড্ডার রাকিব হাসান নামের একজনকে সাক্ষী করেছিলেন তিনি। রাকিবের নম্বরে ফোন করলে তিনি বলেন, “সাংবাদিকের সঙ্গে কোনো কথা নেই, সরি ভাই।” এরপর তিনি ফোন কেটে দেন।
তবে পুরাে এ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আদম তমিজী হকের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।