অবরোধে ভয় নিয়েই ‘পেটের টানে’ রাস্তায়

২৮ অক্টোবর ঘিরে ডামাডোল থেকেই কমেছে আয়; হরতাল-অবরোধের তিন দিনে পকেটের স্বাস্থ্যের অবনতি। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে চলবে কীভাবে, দুশ্চিন্তায় শ্রমজীবীরা।

পাভেল রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2023, 07:44 PM
Updated : 1 Nov 2023, 07:44 PM

“যে দলই ক্ষমতায় যাক, আমরা শান্তি মতো চলাফেরা করতাম চাই, চাইট্টা ভাত খাইতাম চাই- এটাই হইল আমাগো কথা। আমরা শান্তি চাই, নিরাপদে থাকতাম চাই”- টানা তিন দিনের অবরোধের দ্বিতীয় দিন বলছিলেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার কুদ্দুছ মিয়া।

অবরোধে সহিংসতার কারণে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে তার। নিজের নয়, তার ভয়ের কারণ ছেলের জীবনের নিরাপত্তা। গুলিস্তানের একটি কম্বলের দোকানে কাজ করেন তার ছেলে।

অবরোধের মতো কর্মসূচিতে কর্মজীবী মানুষকে যাওয়া আসা করতে হয় বাসে, আর যখন তখন বাসে আগুনের খবর আসে। এসব আগুনে কত মানুষের কত স্বপ্ন মুখে গিয়ে জীবনের রঙ মুছে গেছে, তা অজানা নয় কুদ্দুছ মিয়ার। তাই ছেলে ঝুঁকি নিতে চাননি।

তিনি বলেন, “গাড়ি চলব কি না, এটা চিন্তা কইরা অবরোধ শুরুর আগের দিনই আমার পোলা গুলিস্তান চইল্যা গেছে। ওইখানেই আছে, দোকানের মধ্যেই থাকে। কী অবস্থায় আছে, এটা নিয়া তো চিন্তা লাগেই।”

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে চড়তে থাকা দ্রব্যমূল্যের পারদ রাজনৈতিক এই হানাহানিতে আরও ওপরে উঠে কি না, সেই দুশ্চিন্তাও পেয়ে বসেছে কুদ্দুসের মতো মানুষদের।

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে বিএনপির ডাকা তিন দিনের অবরোধের দ্বিতীয় দিন মোহাম্মদপুর যান চলাচল আগের দিনের চেয়ে ছিল বেশি। তবে মানুষের চোখে মুখে ছিল উৎকণ্ঠা।

২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত আর ২০১৫ সালের কয়েক মাসেও এই ধরনের কর্মসূচি দেখেছে মানুষ। সে সময় সহিংসতা ছিল আরও বেশি। এবার তা তুলনামূলক কম হলেও দুশ্চিন্তা কম নয়। তখন বিপুল সংখ্যক মানুষ যেমন পেট্রোল বোমায় ঝলসে গেছে, তেমনি অর্থনীতি স্তব্ধ থাকায় লাখ লাখ শ্রমজীবীর জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কৃষকের ফসল মাঠেই পচেছে, ওদিকে শহরে সরবরাহের অভাবে বেড়ে যায় দর।

এবারও প্রতিদিন আয় করে চলতে হয়, এমন মানুষদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। গত ২৮ অক্টোবরের আগে থেকেই আয়ে ভাটা, হাতে জমানো টাকায় টান পড়েছে, অর্থনীতির টানের মধ্যে ধার দেনা করার মতো লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এর মধ্যে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা স্তব্ধ হয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

একটি হরতাল, দুদিনের অবরোধে কমে গেছে আয়, সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে সমঝোতার ন্যূনতম আভাসও নেই। এভাবে চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে কী হবে, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে খাওয়া পরা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কি না, বছরের শেষে স্কুলে পরীক্ষা শেষ হবে কি না, এসব নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগ বন্ধ, আন্তঃজেলা বাস চলাচল নেই বললেই চলে, ফলে রাজধানীতে যাত্রী আসছে না। তাই অভ্যন্তরীণ রুটেও যাত্রী কম। তাই নগর পরিবহনে বাস, অটোরিকশা, অ্যাপে বা এমনিতে ভাড়ায় চলা মোটর সাইকেল চালকদের এখন দুঃসময়।

আবার যাত্রীরাও যে সময় মতো বাসে চড়তে পারছেন তাও নয়। কারণ, বাস এলেও সময় নিচ্ছে অনেকক্ষণ।

ইন্দিরা রোডের বাসিন্দা মাহফুজ সুমনের সঙ্গে কথা হয় খামারবাড়ী খেঁজুরবাগানের সামনে। তিনি তখন বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মাহফুজ বলেন, “মৌচাক থেকে গতকাল হেঁটে বাসায় আসছি। আজকে অবরোধের অবস্থা কী তো জানি না। বাসা থেকে বের হইলেই একটা টেনশন কাজ করে।“

অবরোধের দ্বিতীয় আসাদ গেট, টাউন হল, খামারবাড়ী, ফার্মগেটে ঘুরে যান চলাচল তুলনামূলক কম দেখা গেলেও তা ছিল আগের দিনের চেয়ে বেশি।

দ্রব্যমূল্য আরো ভোগাবে?

রাস্তার পাশের চায়ের দোকানের আড্ডা, বাসে অফিসগামী যাত্রীদের আলোচনা, সব জায়গায় এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যর্থতার পাশাপাশি তুমুল আলোচনা রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে। সংঘাত আর হরতাল অবরোধ পণ্যমূল্যের দাম আবার বেড়ে যায় কি না, এই দুশ্চিন্তা বড় হয়ে উঠছে।

মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৮ নম্বর সড়কের পানির পাম্পের পাশে বারেকের চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল অনিক রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, “চাপে আছি জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে। পেঁয়াজ, আলু, ডিম, সবজি- সব কিছুই দাম বেশি। মানুষ টিকে থাকব ক্যামনে?”

ফার্মগেটের মণিপুরি পাড়ার ৪ নম্বর গেটের পাশের একটি চায়ের দোকানে বসে কথা বলছিলেন কয়েকজন। তাদের আলোচনার বিষয় ছিল দ্রব্যমূল্য এবং অবরোধ কর্মসূচি।

তাদের একজন শাহীন আলম। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকার, বিরোধীদল কেউই তো আমাগো নিয়া ভাবে না। তারা তো এসি রুমে বইসা বইসা হরতাল-অবরোধ দেয়। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। আমরা সাধারণ মানুষ তো টিকতে পারতেছি না।”

মণিপুরি পাড়ার মসজিদ মার্কেটের দেয়ালে টাঙানো দৈনিক পত্রিকায় খবর পড়ছিলেন কয়েকজন শ্রমিক।

তাদের মাঝে আক্কাছ হোসেন বলেন, “দেশে যে কি শুরু হইল, এসব মারামারি তো আমরা সাধারণ মানুষ চাই না। যে দলই ক্ষমতায় যাক, আমাদের তো লাভ নাই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম দেখলে মাথা নষ্ট হয়ে যায়।”

শ্রমজীবীদের নাভিশ্বাস

অবরোধে স্কুলগুলোর বেশিরভাগই বন্ধ, কোথাও কোথাও ক্লাস চলছে অনলাইনে। কোথায় কী হয়, এই দুশ্চিন্তায় প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না অনেকেই।

ফুটপাতের দোকানি, ছোটখাটো ব্যবসায়ী, হকারদের দুশ্চিন্তা হল, রাস্তায় মানুষ কম, পণ্য কিনবে কে?

মোহাম্মদপুরের চায়ের দোকানি বারেক মিয়া বলেন, “দোকান খুলতে তো ভয় লাগে। কিন্তু গরিব মানুষের তো পেটের ধান্দা করতেই অইব। রিস্ক থাকলেও আল্লাহর উপরে ভরসা কইরা দোকান খুলি।"

বাংলামোটরের ফুটপাতে ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলেন মো. আসাদ। তিনি বলেন, “মাঝে মাঝে পুলিশ আইসা ফুটপাত থেইক্ক্যা সরাইয়া দেয়, আবার মারামারির অবস্থা দেখলে নিজেরাও বন্ধ কইরা দৌড় দেই। গরিব মানুষের জীবন। রাস্তায় না আইলে তো পেটে ভাত আইব না, এজন্য রিস্ক থাকলেও পেটের দায়ে রাস্তায় বাইর হই।”

ঘোষণা থাকলেও আন্তঃজেলা বাস চলছে না বললেই চলে। দুপুরের দিকে মহাখালী টার্মিনালে দূরপাল্লার বাসগুলোকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সবগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। টার্মিনালে যাত্রীর কোলাহল নেই। যে কারণে বাস ছাড়ার কোনো প্রস্তুতিও দেখা যায়নি। শ্রমিকরা জানালেন মঙ্গলবার থেকেই এই অবস্থা।

ঢাকার আশেপাশের জেলা গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে কিছু বাস এলেও সেই সংখ্যাও বেশ কম।

মগবাজার মোড়ে বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দুপুরে বলাকা পরিবহনের বাস পেলেন নিলয় রহমান, যেটি চলে সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুর রুটে। বাসে ওঠার পর আসনও পেয়ে গেলেন। এখান থেকে উঠা কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল না।

ভাড়া কাটতে থাকা ইলিয়াস হোসেন বলেন, “যাত্রী কম মামা। তবে যানজট নাই। চালাইতে কষ্ট কম।”

তিনি জানালেন, তাদের রুটে চলা অনেক বাস এখন বসে আছে। ভাঙচুর ও আগুনের ভয় যেমন কাজ করে, তেমনি যাত্রী কম, এটাও এক কারণ। বসে থাকলে আয় নেই, কিন্তু পথে নামলে যে কয়টা টাকা নিয়ে ঘরে ফেরা যাবে, নেই সেই নিশ্চয়তা। বেশিরভাগ সময়ই যাত্রী ফাঁকা রেখেই চলতে হচ্ছে দুদিন ধরে।

“এইভাবে চলতে থাকলে পথে বসতে হইব”, বললেন ইলিয়াস।

সাভার থেকে চিটাগং রোডের সাইনবোর্ড পর্যন্ত চলাচল করা লাব্বাইক পরিবহনের একটি বাসে চালকের সহকারী জসিম উদ্দিন বলেন, “সকাল থেইক্যা কোনো ঝামেলায় পড়ি নাই। তয় যাত্রী কম।”

কম কেন? জসিম বলেন, “বাসে আগুন দেওয়ার কারণে লোকজন ভয় পাইত্যাছে মনে হয়। আর অফিসের কাজ ছাড়া কেউ তেমন বাইর হইত্যছে না।”

বাংলামোটরে বিকেল ৫টায় দেখা যায়, সব রুটের বাসেই যাত্রী কম। পুলিশ বক্সের পাশে সতর্ক অবস্থায় পুলিশ সদস্যরা।

সকাল ৭টায় বেরিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ৭০০ টাকার ভাড়াও তুলতে পারেননি সিএনজি অটোরিকশার চালক আব্দুস সালাম। তেজগাঁও চ্যানেল আই ভবনের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, “কাল অবরোধের পয়লা দিন কোনো রকমে ১২০০ ট্যাকা ভাড়া মারতে পারছিলাম, আজকে তো অহনও মহাজনরে দেওয়ার মতো ট্যাকাই তুলতে পারি নাই।

“সকালে বাইর হইলে নাশতা, দুপুরের খাওনের খরচ আছে। মহাজনরে ট্যাকা দেওন লাগে। দুপুরে এক প্লেট ভাত আর একটা মাছ খাইছি, ১০০ ট্যাকা লাগছে।”

এই সময়ে সড়কে নামার ঝুঁকি আছে জানিয়ে সালাম বলেন, "গতকাল মিরপুর মারামারির মাঝখানে পইড়া গেছিলাম, এরপর একটা গলিতে ঢুকে কোনোমতে বাঁচছি। আজকে ঘর থেকে না করছিল, বাইর হইতে। কিন্তু আমরা তো দিন আনি, দিন খাই। ঘরে বইস্যা থাকলে চলুম ক্যামনে?”

আন্তঃজেলা বাস কম থাকায় যাত্রী কমেছে জানিয়ে তিনি, “ঢাকার বাইরে থেইক্যা তো লোকজন আসতেছে না। ঢাকায় যারা আছে, ভয়ে তারাও কাজ ছাড়া বাইর হইত্যাছে না। সকালে আড়াই ঘণ্টা গুলিস্তানে বইস্যা ছিলাম, একটা যাত্রীও পাই নাই।”

অবরোধের কারণে রিকশা চালকের চলার ‘স্বাধীনতা’ বেড়েছে। প্রধান সড়কে উঠে গেলেও এখন তেড়ে আসে না পুলিশ।

তাই বলে স্বস্তিতে নেই রিকশা শ্রমিক ওমর ফারুক। বাংলামোটর মোড়ে কথা হয় তার সঙ্গে। যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন মিরপুরে, যে সুযোগ এমনিতে আসে না।

ওমর ফারুক বলেন, “এমনিতে তো ঢাকার অনেক সড়কে রিকশা চলতে দেয় না। অবরোধের কারণে অহন সব সড়কেই রিকশা নিয়া যাইতেছি। বাংলাবাজার থেইক্যা মিরপুরে যাইত্যাছি সাড়ে ৩শ টাকা ভাড়া লইয়্যা। সকাল থেইক্যা টাকা ভালোয় পাইছি। কিন্তু ভয় লাগে। কোনখানে আবার গিয়া মারামারির মাঝে পইড়্যা যাই।”

ফারুকের ভাগ্য ভালো, তিনি বেশ ‘বড় অঙ্কের’ একটি ভাড়া পেয়েছেন। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছার পর ফিরতি যাত্রায় তার সেই হাসি কি থাকবে? আবার এভাবে কি যাত্রী মিলবে?

বাংলামোটর, মগবাজার মোড়, শাহবাগে অলস বসে থাকা বহু রিকশা চালকের অসহায় দৃষ্টি আর যাত্রীর জন্য হাপিত্যেস কিন্তু ফারুকের ফেরার পথে যাত্রী পাওয়ার নিশ্চয়তার কথা বলে না।

“তিনশ ট্যাকাই মারতে পারি নাই কাইলকা, আইজ দুপুর পর্যন্ত ১২০ ট্যাকাও হয় নাই”, মগবাজারে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা মো. সেলিম বললেন তার অভিজ্ঞতা।

মোটর সাইকেলে যাত্রী তুলে সংসার চালানো রাসেল আহমেদের দুশ্চিন্তার কারণ বহুবিধ। তিনি বলেন, “রাস্তায় এখন ভয় লাগে। বিএনপি, আওয়ামী লীগের লোকজন তো বিনা কারণে মারতেছে। পুলিশও তো বিনা কারণে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

“২৮ তারিখ আমার এক ভাগিনারে পুলিশ ধরে নিয়া গেছে, সে পাঠাও চালাইত। বাইক রাইখ্যা রাস্তার পাশে দাঁড়াইছিল। পরে রাতে থানায় গিয়া বুঝাইয়া ছাড়াই আনছি। সাংবাদিকের কাছে কিছু বলতেও তো ভয় লাগে। আমরা সাধারণ মানুষ, ঘর থেকে বাইর না হইয়েও চলতে পারি না। আর বাইর হইলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, পুলিশ সবাইরে দেখলেই ভয় লাগে।”