বাড্ডায় সড়কে পিষ্ট আইরিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক শেষে নেক্সট ভেঞ্চার নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন হল চাকরি নিয়েছিলেন।
Published : 09 Oct 2024, 11:50 PM
চার বছরের বেশি সময় আগে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই, দুটি বাসের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের টগবগে দুই শিক্ষার্থীর জীবন যায়; এবার বাড্ডা দেখল দুই বাসের চালকের সেই অসুস্থ পাল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া এক স্বপ্নময় কন্যার চাকায় পিষ্ট হয়ে ছিন্নভিন্ন হওয়ার দৃশ্য।
ঢাকার প্রগতি স্মরণির মধ্যবাড্ডায় বুধবার সকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চব্বিশ বছরের তরুণী বেসরকারি চাকরিজীবী তাসনিম জাহান আইরিন। আহত হন তার বড় বোন নুসরাত জাহান জেরিন, বয়স ২৮ বছর।
আইরিন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে নেক্সট ভেঞ্চার নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু দিন হল চাকরি নিয়েছিলেন। পরে তিনি স্নাতকোত্তর করতে চেয়েছিলেন বলে তার পরিবার তথ্য দিয়েছে।
বাড্ডা থানা পুলিশ বলছে, দুই চালকের বাস নিয়ে আগে যাওয়ার পাল্লার মধ্যে পড়ে সড়কে পিষে যান আইরিন। একই কারণে আহত হন তার বোনও।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাইয়ের ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে ফুঁসে উঠে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনার দাবি করেছিলেন, আশ্বাসও মিলেছিল; তবু সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে এখনও জীবন দিতে হচ্ছে আইরিনদের।
বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক ফাতেমা সিদ্দিকা সোমা বলেন, বুধবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে দুই বোন মধ্য বাড্ডার সড়ক পার হচ্ছিলেন। তখন আকাশ পরিবহনের দুটি বাস পাল্লা দিয়ে ছুটছিল; আর বেপরোয়া দুই চালকের খামখেয়ালিতে হতাহত হন আইরিন ও জেরিন।
মধ্য বাড্ডায় সড়ক দুর্ঘটনার স্থানের বিষয়ে পুলিশ বলছে, সকালে মানুষ আর যানবাহনে ঠাসা ছিল সড়ক। তখন আকাশ পরিবহনের দুটি বাস নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন চালকরা। যে কারণে প্রাণ যায় আইরিনে। বাস দুটিকে আটক করা হয়েছে।
বাড্ডার পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আইরিন নেক্সট ভেঞ্চার নামে একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী ছিলেন। একই সংস্থায় তার বোন জেরিনও কাজ করতেন। দুই বোন অফিস যাওয়ার সময় পাল্লা দেওয়া দুই বেপরোয়া চালকের বাসের তলায় পড়েন।
ঘটনার পরপর পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার এইচ এম শফিকুর রহমান বলেছিলেন, রাস্তা পারপারের সময় আকাশ পরিবহনের একটি বাসের চাপায় আইরিন নামে একজন নিহত হয়েছেন ও তার বোন আহত হয়েছেন। আহত নারীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে আইরিনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ।
সেখানে থানার উপ-পরিদর্শক সোমা বলেন, বুধবার সকাল সোয়া ৯টার দিকে দুই বোন মধ্যবাড্ডার রাস্তা পার হওয়ার সময় আকাশ পরিবহনের একটি বাসের তলায় পড়ে ছিল আইরিনের পিষ্ট হওয়া দেহটি। ওই অবস্থায় চালক ও হেলপার বাস ফেলে পালিয়ে যান।
বাড্ডার স্থানীয় সাইফুল ইসলাম বলেন, লোকজন বাসটি ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে আইরিনের পিষ্ট দেহটি উদ্ধার করে। তার বোন জেরিনকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়।
এসআই সোমা বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালে জেরিনের চিকিৎসা চলছে।
ঘটনায় জড়িত বাস দুটি জব্দ করা হয়েছে এবং একজনকে আটক করা হয়েছে বলেও তথ্য দিয়েছেন সোমা।
দুর্ঘটনার খবর শুনে আইরিন ও জেরিনের স্বজন এবং সহকর্মীরা ছুটে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে।
আইরিন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার মানিকখালি গ্রামের এসএম সাইফুল আলমের মেয়ে। তারা ঢাকার মিরপুরে পল্লবীর পলাশ নগরে থাকতেন।
মর্গে আইরিনের বাবা সাইফুল আলমকে দেখা গেল কাঁদছেন আর ছোটাছুটি করছেন। একবার জানতে চাইছেন আইরিনের লাশ কখন পাবেন, আরেকবার খোঁজ নিচ্ছেন চিকিৎসাধীন জেরিনের কী অবস্থা।
সাইফুল আরম বলেন, তার তিন মেয়ে, এক ছেলে। এর মধ্যে দুই মেয়ে পড়াশোনো শেষে চাকরি করেন। তারা সকালে বাসা থেকে তাদের কর্মস্থলে উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল।
“পরে শুনতে পাই তারা দু'জনেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।”
ময়নাতদন্তের পর বিকালে আইরিনের মরদেহ নিয়ে যায় তার স্বজনরা।
বুধবার দুপুরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলাম বলেন, বাড্ডায় নিহত তাসনিম জাহান আইরিন তাদের বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। অনার্স শেষ করে মাস্টার্স না করেই চাকরিতে প্রবেশ করেন তিনি।
“আমরা ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ তার রুহের মাগফিরাত ও শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।”
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের পাল্লায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিল।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে সেই ফুঁসে ওঠা আন্দোলন দেখিয়ে দেয়, সড়কে কী কী অব্যবস্থাপনা রয়েছে। আইনের রক্ষক যে পুলিশ, তাদের চালকেরও লাইসেন্স নেই- তখন এমন ঘটনাও শিক্ষার্থী ধরে ফেলে। চলার অনুপযোগী গাড়ি নিয়ে পুলিশের রাস্তায় নামার দৃশ্যও উঠে আসে।
তখন লক্কড়ঝক্কড় অসংখ্য বাস নিয়ে চালকদের গতি বৃদ্ধি ও যাত্রী ধরার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কথাও আলোচনায় আসে। এখনও ঢাকার সড়কে নামলেই দেখা যায় সেই অসুস্থতা; যেমন ছিল আগে; আজও তেমন।
বাড্ডার দুর্ঘটনার দিনই ঢাকার কয়েকটি সড়ক ঘুরে বেশ কিছু স্থানে এক বাস নিয়ে আরেক বাসের চালকের টেক্কা দেওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। তবে তাদের নিবৃত্ত করার কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি কোথাও।