ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে কেবল ঢাকার বনানী, বিমান বন্দর, উত্তরা পশ্চিমসহ হাতে গোনা কয়েকটি থানা অক্ষত রয়েছে।
Published : 07 Aug 2024, 09:48 PM
গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরপরই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা আক্রান্ত হয়; চলে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট। এর মধ্যে ঢাকার প্রায় সবগুলো থানায় লুটপাটের চিহ্ন স্পষ্ট; বেশ কয়েকটি থানা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
সোমবার বিকালে শুরু হওয়া তাণ্ডবের আগুন মঙ্গলবার দুপুরেও জ্বলছিল মিরপুর মডেল থানায়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া তিনতলা থানা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে বেলা সাড়ে ১২টায়।
যে থানা থেকে নির্ধারিত এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নজর রাখতো পুলিশ, সেই থানার সামনের বাউন্ডারি গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে উৎসুক মানুষ। পুলিশহীন থানার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বুলেট, পোড়া অস্ত্র, জ্যাকেট, হেলমেট ও বিভিন্ন আসবাব।
থানা ভবনের সামনে রাখা সাঁজোয়া যানসহ পুলিশের সব গাড়ি ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে থানা ভবন ও ভবনের পেছনে থাকা পুলিশের চারতলা সরকারি বাসভবনেও। আবাসিক ভবনের প্রায় সবকিছু লুট করা হয়েছে, আর নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভবনের সামনে থানা অনেক মোটরসাইকেল।
মঙ্গলবার সকাল থেকে লুটপাট ঠেকাতে থানা ভবনের অবস্থান নেন আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তারা আশপাশে ছড়িয়ে থাকা অস্ত্র, হেলমেট, জুতা- একসঙ্গে জড়ো করে রাখছিলেন। ‘থানা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ’ পোস্টার টানিয়ে ভেতরে সর্বসাধারণের প্রবেশে বাধা দিচ্ছেন। থানার প্রবেশপথে ও ভেঙে ফেলা দেয়ালে বাঁশ টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন তারা।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, কোনো ধরনের জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাটের সঙ্গে ছাত্ররা জড়িত নয়। যে পুলিশ ছাত্রদের বুকে গুলি করেছে, ছাত্রদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ছুঁড়েছে; সেই পুলিশের থানা ভবন রক্ষায় শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে এসেছেন।
ঢাকা কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুর রহমান অপু বলেন, “যখন সকালে আমরা এখানে এসেছি, তখন আমরা দেখি চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। পুরো এলাকায় বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর যখন সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের কথা হয়, সেনাবাহিনী আমাদেরকে এখানে নিরাপত্তা দিতে বলে গেছেন।
“থানা ভবনের পেছনের সরকারি কোয়ার্টারে লুট হয়েছে, এখানকার মসজিদের ঈমাম সাহেবের রুমও রক্ষা পায়নি। কিছু দুর্বৃত্ত ও দুষ্কৃতকারী সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। থানার ভেতরে আমরা আসার পর অনেককিছু রক্ষা করতে পেরেছি। আমরা মিরপুর এলাকার আশেপাশের কলেজের শিক্ষার্থীরা থানা রক্ষায় নিয়োজিত আছি।”
শিক্ষার্থীরা সকালে এসে থানায় কোনো মরদেহ দেখতে পায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এসে দেখি চারদিকে অস্ত্র ছড়ানো-ছিটানো। আমরা চেষ্টা করছি যাতে একটা সুতোও কেউ না নিয়ে যেতে পারে। আমাদের দায়িত্ব আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা করা।
“গতকাল গণভবনে আমরা দেখেছি যে মানুষ বিবেকহীনের মতো কাজ করেছে, যে যা পেরেছে নিয়ে গেছে। এটাতো আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এটা ধ্বংস করার কোনো মানে হয় না।”
কলেজ শিক্ষার্থী অপু বলেন, “আমরা বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর না করা পর্যন্ত এখানে আছি। ভেতরে অনেক অস্ত্র আছে, এগুলো রক্ষা করতে হবে।
“আমরা সরে গেলে ৫ মিনিটও লাগবে না থানা ফাঁকা করতে। থানায় আগুন জ্বলছিল- তাই থানার ভেতর থেকে তেমন কিছু লুট করতে পারেনি। কিন্তু পেছনের ভবন থেকে ফ্রিজ-টিভি সব নিয়ে গেছে।”
এদিন রূপনগর থানায় গিয়েও লুটপাটের চিহ্ন দেখা গেছে। ভেতরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা কক্ষের সবকিছু ছড়ানো ছিটানো দেখা গেছে। তবে স্থানীয়রা জানান, এলাকাবাসীর তৎপরতায় এখানে তেমন বেশি লুটপাট করতে পারেনি। কোনো পুলিশ সদস্যের উপর হামলা করা হয়নি।
থানা ভবনের সামনের একটি বাসার দারোয়ান হাসেম আলী জানান, এখানে পরিবেশ ভালো ছিল, রাত প্রায় সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এলাকার লোকজন এখানে পাহাড়ায় ছিলেন। সাড়ে ৩টার পর থেকে এলাকাবাসী সরে গেলে কিছু লোক এসে থানার সামনের সিসিটিভি ক্যামেরা, ভেতর থেকে ল্যাপটপ ও কিছু আসবাব নিয়ে যায়।
থানা পাহাড়ায় থাকা স্থানীয় শাহেদ বলেন, “সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আমরা এখানেই ছিলাম, কিন্তু আমরা সরে যাওয়ার পর কিছু মানুষ এসে লুটপাট শুরু করে। খবর পেয়ে আমরা আবার থানার সামনে আসি এবং ওসি সাহেবকে খবর দিয়ে আনি। তিনি এসে সেনাবাহিনীর একজনকে ফোন দেন।
“পরে সেনাবাহিনীর লোকজন আসলে তারা থানার অস্ত্রগুলো তাদের কাছে দিয়ে দিতে বলেন। পরে আমরা থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্রগুলো সেনাবাহিনীকে বুঝিয়ে দেই। আমরা থানার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছি, নিচতলা থেকে অল্পকিছু লুটপাট করা হলেও উপরে সবকিছু ঠিক আছে।”
মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে পল্লবী থানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, থানা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেছেন সেনা সদস্যরা। তারা থানা ভবন ঘেরাও করে ভেতরে অবস্থান করছিলেন। বাইরে থেকে পুরো ভবনটিতে ভাঙচুর চালানোর চিহ্ন দেখা গেলেও ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি। ভবনের সামনে থাকা পুলিশের গাড়ি ও মোটরসাইকেলেও ভাঙচুর চালানোর বিষয়টিও স্পষ্ট।
খিলক্ষেত থানায়ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সবকিছু। মালামাল লুটের পর অবশিষ্ট কিছু থাকলে সেসব পাহাড়ায় মঙ্গলবার সকালে এগিয়ে এসেছেন এলাকাবাসী।
এদের একজন বলেন, "থানায় যাতে আর হামলা-লুট করা না হয়, সেজন্য আমরা এগিয়ে এসেছি। সেনাবাহিনী না আসা পর্যন্ত আমরা এখানেই অবস্থান করব।"
থানার এসআই মোফাকখারুল ইসলাম বলেন, "থানায় আগুন দিলেও- আমাদের থানার সবাই সেফ আছে। বেশিরভাগ ফোর্সই যে যার মতো নিরাপদ স্থানে আছেন। দু-একজন সদস্য এখন থানায় আছেন।"
আদাবর থানায়ে লুট করা হয়েছে সবকিছু। সামনে থাকা পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আর লুট করা হয়েছে সামনে ডাম্পিংয়ে রাখা মোটরসাইকেল ও পুলিশের ব্যবহৃত সকল মোটরসাইকেল। থানার ভেতর থেকে প্রায় সবকিছু লুট করার পর একরকম ফাঁকা পড়ে আছে আদাবর থানা ভবন।
তবে বনানী থানা অক্ষত অবস্থায় দেখা গেছে। ভেতরে অবস্থান করছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তারা জানান, তাদের থানায় কোনো ধরনের হামলা করা হয়নি।
কনস্টেবল নুরুজ্জামান বলেন, “রাতেই বেশকিছু পুলিশ সদস্য থানা ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা এখনও আছি, আমাদের এখনও কোনো ধরনের সমস্যা হয়নি। আমাদের কোনো সদস্য কোনো হামলায় আহতের ঘটনাও ঘটেনি।”
সকালে বাড্ডা থানায় গিয়ে দেখা গেল, পুড়িয়ে দেওয়া থানা ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে তখনো। বাইরে জ্বলছে এক বস্তা নথিপত্র। ধোঁয়া উঠতে থাকা থানা ভবনের ভেতরে ঢুকে লুটপাট চালাচ্ছে কিছু মানুষ।
থানার এয়ার কন্ডিশন, পানির পাম্প, আসবাবপত্র, স্টেশনারি, পুলিশ সদস্যদের ট্রাংক, জানালার পর্দা, তোশকসহ যে যা পারছে নিয়ে যাচ্ছে। টানাটানি করে ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে ইলেকট্রিক সরঞ্জামগুলো। একদলকে দেখা গেল জানালার গ্রিলটাও ভেঙে রিকশায় তুলতে।
একজন জানান, স্থানীয় জনতা থানা আক্রমণের চেষ্টা করলে ভেতর থেকে পুলিশ সদস্যরা গুলি, টিয়ারশেল ছোঁড়ে। এভাবে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। স্থানীয়রা থানা ঘিরে ইট-পাটকেল ছুঁড়তেই থাকে। কিন্তু গুলির কারণে কেউ সামনে যাচ্ছিল না। এসময় গুলিতে অনেক মানুষ হতাহত হয়।
রাত ১২টার পর পুলিশ সদস্যদের উদ্ধারে সাঁজোয়া যান নিয়ে আসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। থেমে থেমে রাত ৩টা পর্যন্ত গোলাগুলি শেষে তারা পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরে লোকজন থানায় আগুন দেয়।
পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পল্টন, খিলক্ষেত, উত্তরা পূর্ব থানাও। ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে কেবল ঢাকার বনানী, বিমান বন্দর, উত্তরা পশ্চিমসহ হাতে গোনা কয়েকটি থানা অক্ষত রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগে উপ-কমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন বলেছেন, ঢাকার বেশিরভাগ থানায় জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করা হয়েছে।
মিন্টু রোডে বহুল আলোচিত ডিবি কার্যালয়। যেখানে চারজন পুলিশ সদস্যকে বসে থাকতে দেখা গেছে। নির্ঘুম রাতের ধকলে তাদের সবার চোখ লাল।
মঙ্গলবার সকালে একজন বললেন, "রাতে ঘুমামু কেমনে ভাই। স্যাররা কেউ নাই, সব পালাইছে। চারদিক থেকে সব খারাপ খারাপ খবর আসতেছে। থানায় থানায় হামলা হইছে। এই পর্যন্ত টিকা রইছি এইডাই অনেক।"
ডিএমপির সদর দপ্তরে একটি লোকও নেই। দু-একজন কৌতূহলী মানুষ উঁকিঝুঁকি মারছেন। প্রাঙ্গণেই পড়ে রয়েছে সারি সারি গাড়ি।
পুলিশ স্টাফ কলেজের অতিরিক্ত ডিআইজি সোহেল রানা বলেন, "পুলিশের স্থাপনা ও সম্পদ পুলিশ নয়, জনগণের। পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় সকল সম্পদ ধ্বংস বা নষ্ট না করার অনুরোধ রইলো।
“বাংলাদেশকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পুলিশি সেবা উপহার দেয়ার মেধা ও মানসিকতা সম্পন্ন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য বাংলাদেশ পুলিশেই রয়েছে। মেধা, যোগ্যতা, নৈতিকতা ও দেশপ্রেম মূল্যায়নে যোগ্য কর্মকর্তাদের উপযুক্ত পদে বসালেই জনগণ তাদের কাঙ্ক্ষিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ পাবে।"