দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যু 'দুর্ঘটনায়': পিবিআই

কাছাকাছি সময়ে ফারদিন ও দুরন্ত বিপ্লব নিখোঁজের পর নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার আলোচনা তৈরি করে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2022, 05:57 PM
Updated : 19 Nov 2022, 05:57 PM

বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় নৌকা থেকে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতা দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ‘হত্যার’ কথা বললেও এ মামলার ছায়া তদন্তে নেমে পিবিআই বৃহস্পতিবার জানায়, ‘খুন নয়, তার মৃত্যু দুর্ঘটনায়’।

পিবিআইর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাফিন মাহমুদ জানান, বিপ্লব খুন হননি, লঞ্চের ধাক্কায় মারা গেছেন। পিবিআই এর প্রাথমিক (ছায়া) তদন্তে এমনটাই পাওয়া গেছে।

পুলিশের বিশেষ এ ইউনিট তদন্তে নেমে জানতে পারে কেরানীগঞ্জ থেকে মোহাম্মদপুরে আসার পথে বুড়িগঙ্গার যে অংশ নিখোঁজ হন দুরন্ত বিপ্লব সেখানে একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ছোট নৌকার মাঝি শামসুকে খুঁজে পাওয়ার পর তারা সেখানে নৌকা ডুবির বিষয়ে আরও তথ্য পান।

পিআইবির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সালেহ ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, শামসু মাঝি তাদের জানিয়েছেন একটি লঞ্চের ধাক্কায় তার নৌকাটি ডুবে যায়। ওই নৌকায় পাঁচজন যাত্রী ছিলেন। এদের মধ্যে সাঁতরে এক ঘাটে দুইজন এবং অপর ঘাটে তিনজন উঠতে পারেন। ডুবে যাওয়া একজনের বিষয়ে ওই নৌকার মাঝি কাউকে কিছু বলেননি।

এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ডুবে যাওয়া ব্যক্তি দুরন্ত বিপ্লব বলে শামসু মাঝি তাদের জানিয়েছেন।

Also Read: দুরন্ত বিপ্লবের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

Also Read: নিখোঁজ দুরন্ত বিপ্লবের লাশ মিললো বুড়িগঙ্গায়

Also Read: দুরন্ত বিপ্লবকে হত্যা করা হয়েছে: ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক

একই সঙ্গে পিবিআই কেরানীগঞ্জে তার খামার থেকে ঘাট পর্যন্ত সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও সেখানে তার উপস্থিতি দেখতে পেয়েছে।

পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, যে নৌকার যাত্রী ছিলেন দুরন্ত বিপ্লব সেটিতে দুই যাত্রীর একটি করে দুইটি জুতা পাওয়া যায়। এরমধ্যে দুরন্তের খামারের ব্যবস্থাপক ও তার স্বজনরা জুতা দেখে সেটি তার বলে চিহ্নিত করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দুরন্ত বিপ্লব গত কয়েকবছর ধরে কেরানীগঞ্জের বাস্তা এলাকায় সোনামাটি এগ্রো ফার্ম নামে একটি কৃষি খামার চালাচ্ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ কমিটিরও সদস্য ছিলেন।

গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জ থেকে মোহাম্মদপুরে মায়ের বাড়িতে আসার পথে তিনি নিখোঁজ হন। এ বিষয়ে ৯ নভেম্বর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে পরিবার।

পরে গত ১২ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগলা ঘাট এলাকার বুড়িগঙ্গা থেকে ভাসমান অবস্থায় একটি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনরা ওই মরদেহ দুরন্ত বিপ্লবের বলে শনাক্ত করেন।

এরপর ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশও দুর্ঘটনায় বিপ্লবের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল।

যেভাবে খামার থেকে ঘাট পর্যন্ত গেলেন দূরন্ত বিপ্লব

পিবিআই’র এসআই সালেহ ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঘটনার চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলে ছায়া তদন্ত শুরু করা হয় তার খামার থেকে। সেজন্য বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় ‘নৌকা ডুবিতেই তিনি মারা গেছেন’।

তার ভাষ্য, “দুরন্ত সেদিন খামার থেকে ওই দিন ৪টা ৪৭ মিনিটে বের হয় মেইন রোডে নূর পেট্রোল পাম্পের সামনে দিয়ে হেঁটে কোনাখোলা সিএনজি স্টেশন পৌঁছে ৪টা ৫৫মিনিটে। সেখানে সে একটি সিএনজিতে উঠে। পরে সেই সিএনজিচালক বেলালকে শনাক্ত করা হয়। বেলাল জানায় তার সিএনজিতে করে দুরন্ত বিপ্লব জিনজিরা ফেরিঘাটে পৌঁছে ৫টা ১৩ মিনিটে।”

এরপরই সেখনকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহের কথা জানিয়ে পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা জানান, বেশ কয়েকটি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা যায় দুরন্ত বিপ্লব ওই ফেরিঘাট থেকে প্রায় দেড় মিনিট হেঁটে বটতলা ঘাটের দিকে যান। এই ঘাটে থাকা শামছু মাঝির (৫৫) নৌকায় তিনি ওঠেন।

তিনি জানান, এরপরই শামছু মাঝিকে খুঁজে বের করা হয়। বটতলা ঘাট থেকে সোয়ারীঘাটগামী এ নৌকায় ৫-৬ জন যাত্রী ছিল বলে জানান মাঝি।

তদন্ত কর্মকর্তা মাঝির সেদিনের বর্ণনা তুলে ধরেন। মাঝির ভাষ্য, “নৌকাটি নদীর তিন থেকে দুইভাগ পার হতেই ঢাকা থেকে বরিশালগামী মর্নিং সান ৫ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লাগে।

“এসময় নৌকাটি উল্টে গেলে সকল যাত্রী নদীতে পড়ে যায়। আশেপাশে নৌকা নিয়ে অনেকে ছুটে আসেন তদের উদ্ধারে। এসময় আমাকে নজরুল নামে অপর এক মাঝি উদ্ধার করেন। পরে বেলাল নামে অপর মাঝি নৌকাটি উদ্ধার করে।”

পুলিশ কর্মকর্তা ইমরান বলেন, আর যারা যাত্রী ছিল তাদের দুইজনকে আলেক নামে অপর এক মাঝি উদ্ধার করে। একজন যে নিখোঁজ বিষয়টি শামছু মাঝি কাউকে বলেননি। সে মনে করেছিল সবাই উদ্ধার হয়েছে। তাছাড়া যাচাই না করেই সে একটা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে নিজ এলাকায় চলে যায় এবং ঘটনার পর ওই ঘাটে আসেনি।

“শামছু মাঝিকে শনাক্ত করে তাকে পিবিআিই হেফাজতে আনার পর এই বিস্তারিত ঘটনা তার মুখ থেকে জানা যায়।”

খামার থেকে ঘাট পর্যন্ত দুরন্ত বিপ্লবের পথচলার তথ্যপ্রমাণ পিবিআইর কাছে আছে বলে জানান তিনি।

নৌকা উদ্ধারের পর সেখানে পাটাতনে আটকে যাওয়া দুইটি ভিন্ন ভিন্ন জুতা পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এই জুতাগুলো ওই নৌকার যাত্রীদের ছিল। এই দুই জুতার একটি দুরন্ত বিপ্লবের এবং সেটা তার স্বজন নিশ্চিত করেছে।

“আমরা নৌকায় পাওয়া জুতার ছবি তুলে বাদীর কাছে পাঠাই। তিনি দুই জুতার একটি দুরন্ত বিপ্লবের বলে শনাক্ত করেন। এছাড়া ম্যানেজারকে দেখানো হলে তিনিও শনাক্ত করেন।”

এর আগে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি শাহজামান গত ১২ নভেম্বর বলেছিলেন, ৭ নভেম্বর ঢাকার সোয়ারিঘাটের দিকে বুড়িগঙ্গায় নৌকা থেকে একজন পড়ে যাওযার কথা শুনেছেন তারা। বুড়িগঙ্গার এই অংশটা দিয়ে ঘাট পারপারের খেয়া নৌকাগুলো চলাচল করে।

তার ভাষ্য, “ওনার মোবাইল ফোন লোকেশন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যেই জায়গায় দুর্ঘটনাটির কথা বলা হয়েছে ৭ নভেম্বর দুরন্ত বিপ্লবের সর্বশেষ অবস্থান সেখানে ছিল। তবে নৌকা থেকে পড়ে যাওয়া ব্যক্তিই যে দুরন্ত বিপ্লব আমরা এখনো সে কথা বলছি না। আমাদের তদন্ত চলছে।”

দুরন্তের ভগ্নিপতি ইমরুল খান সেদিন বলেছিলেন, “৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জ (খামার) থেকে মোহাম্মদপুরে মায়ের বাসায় যাওয়ার পথে ও নিখোঁজ হয়। ওর মোবাইল ফোনের সর্বশেষ লোকেশন পাওয়া যায় কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ এলাকায়।”

কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ এলাকাটি বুড়িগঙ্গা নদীর জিঞ্জিরা ও সোয়ারীঘাটের মাঝ বরাবর খানিকটা দূরের স্থলভূমি, যে স্থানে নদী ভাগ হয়ে দুই পাশ দিয়ে বয়েছে। বুড়িগঙ্গার এই অংশটা দিয়ে ঘাট পারপারের খেয়া নৌকাগুলো চলাচল করে।

নদীর মাঝখানে দুর্ঘটনা ঘটলে মুসলিমবাগের মোবাইল টাওয়ারই শনাক্ত হওয়ার কথা বলে ধারণা পুলিশের।

দুরন্ত বিপ্লবের লাশ উদ্ধারের পর নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া জেনারেল হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত হয়।

চিকিৎসক মফিজ উদ্দিন নিপুণ বলছিলেন, “নিহতের মাথার পেছনে ও বুকে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এটা ধাতব কোনো বস্তুর আঘাতের চিহ্ন বলে মনে হচ্ছে। লাশটি ৩-৪ দিন আগের, গলে গিয়েছিল। দুরন্ত বিপ্লবকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ভিসেরা রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।”

দুরন্তের বোন শাশ্বতী বিপ্লবও বলছেন, তার ভাইকে পিটিয়ে মারা হয়েছে বলেই তারা মনে করেন।

“ভাইয়ার মতো একজন নির্বিবাদী মানুষের প্রতি কে এতটা হিংস্র হতে পারে জানি না,” ফেইসবুকে লিখেছিলেন তিনি।