তার এই রাজনীতি-সচেতন প্রবন্ধগুলো কোনও আপ্তবাক্য হয়ে ওঠেনি, বরং সেগুলো পরম নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তিবাদের ওপরে।
Published : 16 Apr 2024, 09:53 PM
বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদের দ্বিতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ বেরুলো। এর আগে, ২০২০ সালে, নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘টিকিটাকা’ নামে তার প্রথম প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও বৈদেশিক বাণিজ্য-ভাবনা নিয়ে তার প্রবন্ধ সময় সময়ে পত্রিকাতে ছাপা হয়ে থাকে। সেগুলোর সব ‘প্রগতিশীলতার ইচ্ছাপূরণ’ শীর্ষক বইতে ঠাঁই পায়নি। বইটাতে মাত্র বারখানা প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সমাজমনস্ক প্রবন্ধগুলোর বিষয় খুবই সমসাময়িক যার মূল সুর-- ব্যক্তি বনাম ব্যক্তির সম্পর্ক, রাষ্ট্র বনাম ব্যক্তির সম্পর্ক, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের সম্পর্ক--এসব মূলতই রাজনৈতিক। আর রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রকৃতি খুঁজে দেখা ছাড়া কোনও সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনা এগুতেই পারে না!
প্রথম প্রবন্ধ ‘প্রগতিশীলতার ইচ্ছাপূরণ’-এ ওয়াসি আহমেদ বলছেন, প্রগতিভাবনা ও ইচ্ছাপূরণের মাঝে সাংঘর্ষিক সম্পর্ক বিরাজ করতে পারে। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, প্রগতিভাবনা যুক্তিসঙ্গত উপায় খুঁজে থাকে বটে, তবে ইচ্ছাপূরণের প্রকল্পগুলো আসলে যুক্তিসম্মতভাবে তৈরি হয় না-- এর পেছনে লুকিয়ে থাকে রাষ্ট্রের নানান গূঢ় উদ্দেশ্য। একই বক্তব্য আমরা পাই ফ্রয়েডের কাছে থেকে। ইচ্ছপূরণকে ফ্রয়েড ব্যক্তির দুর্বল ইচ্ছাশক্তি ও আত্মপ্রতারণার সমতুল্য বলেই মনে করেন। ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে আরও জানাচ্ছেন, দার্শনিক কিয়ের্কেগার্ড ও নিৎশে তাই ইচ্ছাপূরণকে পরিহার করতেই বলেছেন। কার্যত তবে উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে-- ইচ্ছাপূরণকে প্রশ্রয় দিচ্ছে প্রগতিশীলতা যেখানে মুখ্য হয়ে উঠছে জনতুষ্টিবাদ। লেখক তাই মন্তব্য করতে ছাড়ছেন না, ‘...আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা নানা প্রকল্প-শাসিত (জাতীয়তাবাদী প্রকল্প, উন্নয়ন প্রকল্প, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকল্প ইত্যাদি)। রাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণ যখন দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন গণতন্ত্রচর্চাও একসময় প্রকল্পের ছাঁচ নিয়ে নেয়। নির্বাচন, গণপ্রতিনিধিত্বের মতো বিষয়ও প্রকল্পের আওতায় চলে আসে।’
ইচ্ছাপূরণের বেলাতে লেখক যুক্তি দিচ্ছেন যে ইচ্ছাপূরণই যখন সরকারি কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে তখন রাষ্ট্র কোনও কোনও বিষয়কে রাষ্ট্রীয় বা জাতিগত ভাবাদর্শের প্রকল্প হিসেবে রং চড়ায়। এ ব্যাপারটা বেশির ভাগ সময়েই জনগণের মাঝে ধন্ধ তৈরি করে ফেলে। এ কারণেই ওয়াসি আহমেদ বলছেন, ‘মতাদর্শের পার্থক্য সত্তে¡ও বিশ্বব্যাপী যে জায়গাটিতে মতভিন্নতা পাওয়া যাবে না তা হলো বাস্তবতা ও যুক্তির নিরিখে আকাক্সক্ষাকে চিহ্নিত করা। তা যদি না করা যায়, আকাক্সক্ষা আর ইচ্ছাপূরণে তফাত থাকবে না, আকাক্সক্ষা ইচ্ছাপূরণে ঠাঁই নেবে।’ তিনি যথার্থই উপসংহার টানছেন-- “আমরা আসলে একটা সর্বৈব ‘ইচ্ছাপূরণের সংস্কৃতি’-তেই বাস করছি যার সাথে প্রগতির কোনোই সম্পর্ক নেই-- ইচ্ছাপূরণ যেহেতু যুক্তি, দায়িত্ববোধ ও কার্যকারণের ধার ধারে না, বরং সর্বতোভাবে বাস্তবতাবিমুখ চিত্তবিনোদনের নিয়ামক, এর লাগামহীন প্রয়োগের পরিণতি হচ্ছে বিবেক-বুদ্ধিহীন আত্মপ্রসাদ।” ওয়াসি আহমেদের যুক্তিমতো আমরা একটা ‘পোস্ট ট্রুথের জামানা’-য় আটকে গেছি যেখানে সত্যকথার বদলে মুখ্য হয়েছে ভাবালুতা আর আবেগ। এই ভাবালুতা, এই আবগের উপজাত ইচ্ছাপূরণই এখন আমাদের সমুখে সত্য বলেই প্রতিভাত হচ্ছে।
‘জাতীয়তাবাদের নিকষ ও কল্পিত দিগন্ত’-এ ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে ন্যাশনালিজম বক্তৃতামালা (১৯১৬)-তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, জাতীয়তাবাদ হলো গিয়ে সামাজিক জীব মানুষের জন্য হুমকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮), ভারতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার সহিংস আন্দোলন-- মূলত এ দু’টো বড় ঘটনার সংকীর্ণতা লক্ষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, ওয়াসি আহমেদের ভাষায়-- “জাতীয়তাবাদ কখনোই সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং রাজনৈতিক ও বেনিয়া গোষ্ঠীর আঁতাতে সংগঠিত ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধির উপায়। যে কারণে এটি least human and least spiritual. সেই সাথে এও তিনি যোগ করেছেন, এটি সাম্রাজ্যবাদের সূতিকাগার; যুদ্ধ, ঘৃণা ও পারস্পরিক সন্দেহকে উসকে দিতে তৎপর।” এভাবে জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ একটা গোষ্ঠী সমাজের অপরাপর, বিশেষত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপরে নিষ্পেশন চালাবার বিবিধ প্রকল্প গ্রহণের যুক্তি খুঁজে নেয় বলে ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, দেশের উন্নয়ন ও ব্যক্তির স্বাধীনতা বিধানের জন্য জাতীয়তাবাদ নিয়ে সমস্যা নয়, সমস্যা হলো যখন জাতীয়তাবাদ উগ্র মূর্তি ধারণ করে বসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসলে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের হুমকিকেই নির্দেশ করেছেন।
মজার ব্যাপার এই যে ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই যুগান্তকারী বক্তব্যের পরে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখেছি, জার্মান জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদি জনগোষ্ঠীকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তাদেরকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে নেমেছে জার্মানরা, তা করেছেও অনেকাংশেই। এমন গণহত্যার উদাহরণ আমরা এর আগে তুরস্কের উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রদর্শনের কালে দেখেছি যেখানে অটোম্যানরা খুন করেছিল লক্ষ লক্ষ আর্মেনীয়কে।
জাতীয়তাবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের মাঝে ওয়াসি আহমেদ পার্থক্য করেছেন এভাবে-- “...পরাধীন দেশের জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীন দেশের জাতীয়তাবোধের তফাত রয়েছে। পরাধীন অবস্থায় মুক্তিকামী জনগণের একাত্মতা যখন দেশপ্রেমে রূপ নেয়, তা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চার করে। অন্যদিকে স্বাধীন দেশে বিশেষ অবস্থায় তা চরম উগ্র চেহারা নিতে পারে।” ওয়াসি আহমেদ নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ করেন যে অগণতান্ত্রিক বা স্বল্পগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাবার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে থাকে। এসব পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে ফাঁপা বুলি ঝারা, জনমত ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা করা, লোকরঞ্জনের জন্য উঠেপড়ে লাগা ইত্যাদি। এমন একটা অবস্থাতে সংখ্যালঘুদের অধিকার অস্বীকার করবার মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে থাকে বলে তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার মন্তব্য করেছেন-- কোনও গোষ্টীর জাতীয়তাবাদ যদি ভাষা, ধর্ম ও জাতিয় পরিচয়ের মাধ্যমে সঙ্গায়িত হয়, তবে সেখানে বহুত্ববাদই কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এই সংকীর্ণ বহুত্ববাদ নিশ্চয় জাতীয়তার পরিচায়ক নয়। বরঞ্চ তা সংখ্যালঘিষ্টের ওপরে সংখ্যাগরিষ্টের নিষ্পেশনেরই উপায় তৈরি করে দেয় বলেই আমরা লক্ষ করি।
ওয়াসি আহমেদ লক্ষ করছেন, ইন্টারনেটের অভাবনীয় বিস্তৃতির কারণে জাতীয়তাবাদ আর সম্প্রদায়ভিত্তিক বা স্থানিক পর্যায়ে থাকছে না-- হয়ে যাচ্ছে বিশ্বায়িত। সেটা নিশ্চয় ব্যক্তির একটা মুক্তি। প্রবন্ধখানা তিনি শেষ করছেন এভাবে-- “জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ বিষয় হিসেবে যেমন আলাদা, তেমনি এ দুইয়ের মধ্যে কোনো গুঢ় আত্মিক সম্পর্ক নেই। নিজেকে একটা জাতীয় পরিচয়ে চিহ্নিত করার মানে এই নয় যে, একজন মানুষ জাতীয়তাবাদী হয়ে পড়বে, বিশেষত যেখানে জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটা সাংগঠনিকভাবে রাজনৈতিক লক্ষ্যে গড়ে ওঠে-- এর নিকষ বা কল্পিত অবয়ব যেমনই হোক।”
‘সুস্থতার মুখোমুখি’-তে মনস্তত্ত্ববিদ সালমান আখতারের সূত্রে ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে জানাচ্ছেন, “যারা নিজেদের তৈরি নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বাস করে অনিশ্চয়তা থেকে নিজেদের নিরাপদ ভাবে তারা এক অর্থে মৌলবাদী, অপরদিকে নিরাপত্তাবেষ্টনীতে থেকে বা না থেকে যাদের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে হয় (কারণ তারা জানে নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তা বিষয়টা, খুবই ভঙ্গুর ও আপেক্ষিক), তারা প্রকৃত সুস্থ।” কাজেই মানুষকে আমরা দু’টো শ্রেণীতে ভাগ করতে পারছি-- সুস্থ ও মৌলবাদী। ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে মৌলবাদের ধারণা আসলে ব্যাপক-- ধর্মীয় মৌলবাদের বাইরেও মানুষের নানান মৌলবাদী চিন্তার অবকাশ রয়ে যায়, যেমন, সেকুলার মৌলবাদ, অন্ধ দেশপ্রেম বা উৎকট স্বাদেশিকতা, কট্টর চিন্তাভাবনা ইত্যাদি।
ওয়াসি আহমেদ বলছেন, মৌলবাদ আসলে একটা সামগ্রিক মানসিক অবস্থা যেখানে রাজত্ব করবে আধিপত্যবাদ, যে আধিপত্যবাদ কেবল বিশ্বাসের ভিতের ওপরেই নির্ভর করে না, গড়ে ওঠে কল্পনা, ফান্টাসি ও মিথ্যাচারকে ঘিরে। কেবল ব্যাক্তিই নয়, একটা গোষ্ঠীর বেলাতেও এই মৌলবাদ প্রযোজ্য। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে মৌলবাদের একটা রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। এরপর ওয়াসি আহমেদ যুক্তি দিচ্ছেন, নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তার বিধানই মানুষ চায়। কিন্তু নানা অনিশ্চয়তার মুখে মানুষ খাবি খেতে থাকে। এমন অনিশ্চয়তা সম্পর্কে সচেতন থাকাটাই মানুষের কতর্ব্য। তাই ওয়াসি আহমেদ যুক্তি দিচ্ছেন, “...কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়, কোনো কিছুরই স্থিরতা নেই এ বিশ্বাসই সুস্থতাকে মুহুর্মুহু প্ররোচিত করে ও সচল রাখে। অন্যদিকে নিরাপত্তার আশ্বাসে আশ্বস্ত বলে মৌলবাদ স্থবির ও পরমুখাপেক্ষি। এই যে স্থিরহীনতা বা নিরাপত্তহীনতা যা সুস্থতাকে সচল রাখে, এটাই মূল কথা, যার নাম হতে পারে মুক্তি। অনিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের মুক্তি (freedom), অন্যদিকে মৌলবাদীদের মধ্যে রয়েছে মুক্তিভীতি (fear of freedom), যে কারণে তারা নিরাপত্তাবলয়ের বন্দিত্বে আশ্রয় খোঁজে।” এবাদে সালমান আখতারের সুত্রে ওয়াসি আহমেদ মৌলবাদের ঝুঁকি সম্পর্কে আমাদেরকে সচেতন করতে ভুলছেন না, মৌলবাদ যেহেতু সামষ্টিক ও যৌথবিশ্বাস তাড়িত তাই একজন মৌলবাদী ব্যক্তিপর্যায়ে তার কাজের কোনো দায়ভার গ্রহণ করে না। দ্বিতীয়ত, একজন মৌলবাদী বা মৌলবাদী গোষ্ঠীর জাড্যতা এ পর্যায়ে উঠে যায় যে সে বা তারা কোনো সমন্বয়বাদী চিন্তাভাবনার ধার ধারে না।
‘সভ্যতার সংঘাতের আড়ালে’ প্রবন্ধে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রশাসনের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ‘The Clash of Civilizations and the Remaking of World Order’ শীর্ষক বই নিয়ে আলোচনা করেছেন ওয়াসি আহমেদ। বইটার মূল কথা হলো এই যে স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হবার পরের সময়গুলোতে বিভিন্ন সভ্যতা(ওয়াসি আহমেদ যাকে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী বলতে চান)-র মাঝে সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংস্কৃতি ও কৃষ্টিগত বিভিন্নতা যেখানে কোনো মানুষের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ই প্রধান হয়ে ওঠে (যেমন, কেউ মুসলিম, কেউ খ্রিষ্টান, কেউ হিজাব পরে, কেউ তা পরে না ইত্যাদি)। হান্টিংটন আরও বলছেন, ধর্মবিশ্বাস, ইতিহাস, ভাষা ও ঐতিহ্যগত বৈরিতা ও সংঘাতের মাত্রা এমন এক জায়গাতে পৌঁছেছে যেখানে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের মাঝের সম্পর্ক বিষাক্ত বানিয়ে ফেলা হয়েছে এবং এই বৈরিতা শীতলযুদ্ধচলাকালীন বৈরিতার চাইতেও ভয়ঙ্কর! তবে হান্টিংটন ইসলামিক সভ্যতা বলতে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গোষ্টীকেই নির্দেশ করেছেন যে সংজ্ঞায়নটাকে সীমাবদ্ধ বলেই মনে করেন ওয়াসি আহমেদ। ওয়াসি আহমেদের ভাষাতে হান্টিংটন যা বলছেন, “...আরববিশ্বের লোকেরা পশ্চিমা ধারণা ও বিশ্বাসে অনাগ্রহী, তাদের প্রাথমিক আনুগত্য ধর্মের প্রতি, জাতিরাষ্ট্রও তাদের কাছ গৌণ। তাদের সংস্কৃতিতে বহুত্ববাদ, ব্যাক্তিবাদ ও গণতন্ত্রের স্থান নেই। ফলে তারা কখনোই পশ্চিমা উদার আধুনিকতা থেকে শিক্ষা নেবে না, নিজেদের পথেই তারা চলবে।” এ থেকে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সভ্যতার সংঘাত অবধারিত! হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষের এই ধারণা ও ভবিষ্যদবাণীকে নানানভাবে সমালোচনা করেছেন ওয়াসি আহমেদ। তার মাঝে অন্যতম সমালোচনা হলো এই যে হান্টিংটন সভ্যতাকে ধর্ম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে ঠিক কাজ করেননি। ওয়াসি আহমেদ বলছেন, “...সভ্যতা বলতে কেবল ধর্ম নয়, বরং একটি গোটা সমাজব্যবস্থার (ভৌগলিক বা অঞ্চলভিত্তিক) সার্বিক চিত্র, তাকে তিনি তার মতো ব্যাখ্যা করেছেন, অর্থাৎ ধর্মকে মাঝখানে রেখে সভ্যতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নিজের কথাবার্তার একপেশে গোঁ থেকে বেরোনোর পথ খোলা রাখেননি।” সমস্যা এই যে তিনি গবেষকের চাইতেও একজন নীতিনির্ধারকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়েছেন বেশি। তার ফলাফল যে ভাল হয়নি তার ইঙ্গিত দিতে ভুলছেন না ওয়াসি আহমেদ--“... হান্টিংটনের লেন্সে ৯/১১-র পক্ষে একটা সুবিধাজনক ব্যাখ্যা হিসেবে কাজ করেছিল।” এ কারণে আমরা ইরাকে মার্কিন সামরিক অভিযান প্রত্যক্ষ করেছি। হান্টিংটনের এই থিসিস ইরাকে মার্কিন সামরিক অনুপ্রবেশ ও সশস্ত্র হামলাকে বৈধতা দিয়েছে এবং ইরাককে সবদিক থেকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। তবে মাস ডেস্ট্রাকশনের কোনও অস্ত্র আর সেখানে কিন্তু মেলেনি!
‘প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মপরিচয়-- শাহবাগ বনাম শাপলা’ প্রবন্ধে ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে জানাচ্ছেন, যুদ্ধরাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে পয়লাতে শাহবাগে তরুণরা জমায়েত হয়েছিল, পরে তাদের সাথে ‘গণজোয়ারের টানে’ একাত্ম হয়েছিল আমজনতা। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকারীরা সরকারযন্ত্রের অনুমোদনও পেয়ে গিয়েছিল। ওয়াসি আহমেদ বলছেন, ‘...১৭ সেপ্টেম্বর কাদের মোল্লার আগের রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসি ও এ জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আইন পরিবর্তনকে শাহবাগের সরাসরি অবদান বা সাফল্য বিবেচনা করা যেইে পারে।” তারপরই গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবি জানানো হয়। তখনই ঘোলাটে হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। তা’তে করে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হেফাজতে ইসলাম। তারা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের কপালে নাস্তিক খেতাব লাগিয়ে দিতে সমর্থ হয় এবং এ ঘোলাটে পরিস্থিতিতে কে বা কারা একজন ব্লগারকে খুনও করে বসে। এর মাঝে আরও দু’টো ঘটনা ঘটে-- কথিত ক’জন নাস্তিক ব্লগারকে আটক করে সরকার এবং শাহবাগের আন্দোলনকে যে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছিল তা তুলে নেয়া হয়। এমন একটা ঢিলেঢালা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিশাল গণজমায়েতের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। অবশ্য তাদেরকেও বাড়তে দেয়নি সরকার-- রাতারাতি দমন করেছে। এ পর্যন্ত ওয়াসি আহমেদ সরকারের নীতির বেলাতে মোটামুটি একটা সাম্যাবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু তারপরেই আমরা দেখি, ১৩ দফা দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে হেফাজতে ইসলাম যেগুলো, ওয়াসি আহমেদের ভাষাতে-- মূলতই জামায়াতে ইসলামের মেনিফেস্টোরই প্রতিধ্বনী। সেসব দাবির অনেকগুলোই বাস্তবায়ন করেছিল সরকার, যেমন, পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন, সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গন থেকে নারীমূর্তি অপসারণ, কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে স্নাতোকত্তোর সম্মান প্রদান করা ইত্যাদি। এ ব্যাপারটাকে ওয়াসি আহমেদ সরকারের ‘দ্বিমুখী নীতি’ বলে অবিহিত করতে ভুলছেন না। এভাবেই দেশে ‘ধর্মময়তার আবহ’ বেড়ে যেতে দেখছেন তিনি যেখানে ধর্মকে রাজনীতিকায়ন করা হয়েছে সুচিন্তিতভাবে। রাজনীতির এই নয়া মেরুকরণে লাভক্ষতিরও একটা হিসেব হাজির করেছেন ওয়াসি আহমেদ-- “...ক্ষতিটা হয়েছে দেশের সংখ্যালঘু ধর্মনিরপেক্ষ সুশীল সমাজের; তাদের নড়বড়ে ও সঙ্কুচিত অবস্থান আরও সঙ্কুচিত হয়েছে। লাভ হয়েছে হেফাজতের ও সহযোগী ধর্মীয় সংগঠনের।” এটাকেই তিনি ভবিষ্যতে উত্তোরত্তর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবণতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বলে শঙ্কিত হয়েছেন।
পোস্ট ট্রুথ কাকে বলে? ‘পোস্ট ট্রুথ: তামাদি সত্যের ঘেরাটোপ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ওয়াসি আহমেদ মনে করেন, পোস্ট ট্রুথকে সোজাসাপটা মিথ্যে বলে সংজ্ঞায়িত করা যাবে না। যুক্তি দিয়ে তিনি বলছেন, “...মানুষ যে জীবনযাপন করে তাতে সে অহরহই সত্যকে এড়িয়ে, এমনকি মিথ্যাকে মিথ্যা জেনেও আঁকড়ে থাকতে আপত্তি করে না। দৈনন্দিন জীবনে সে সীমাহীন মিথ্যা নিয়ে টিকে থাকে।...সত্য পক্ষপাত মানে না, সত্য খোলামেলা, কখনো কখনো নির্মম। এ কারণে সাধারণভাবে এসব সত্যকেই মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যা তার নিরাপত্তাকে আঘাত করবে না।” তাই রাজনীতিবিদেরা নিরেট সত্যের বদলে ‘মিথ্যা বা কল্পকাহিনি বা প্রেরণাউদ্দীপক গল্পগাথা’ জনগণের সামনে হাজির করে একটা সুবিধেজনক, আরামদায়ক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে থাকে। উদাহরণ হিসেবে ওয়াসি আহমেদ দেখাচ্ছেন-- ইরাক দখলের সময় মার্কিন প্রশাসন প্রচার করেছিল যে ইরাকে উইপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন লুকিয়ে রাখা হয়েছে; এদিকে ব্রেক্সিট হলে ইংল্যান্ডের লাভ হবে-- এমনটা প্রচার করেছিল ব্রিটিশ প্রশাসন ইত্যাদি। অর্থাৎ পোস্ট ট্রুথ স্রেফ মিথ্যে বা গুজব নয়-- এর সাথে জড়িয়ে আছে প্রশাসন ও জনগণের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আবেগের রাজনৈতিক অনুমোদন। এখান থেকেই পোস্ট ট্রুথ সরকারি লোকরঞ্জনের প্রচারণা ও ভয়ঙ্কর সব প্রকল্প বাস্তবায়নের বাহন হয়ে উঠতে পারে বলে ওয়াসি আহমেদ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।
পোস্ট ট্রুথ সত্যকে অস্বীকার করে না, আবার স্বীকারও করে না-- পোস্ট ট্রুথ সত্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করে থাকে। আর পোস্ট ট্রুথ তৈরির ক্ষেত্রে কাজ করে রাজনীতিবিদ, প্রশাসন এবং তা জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেয় মিডিয়া। প্রশ্ন এসে যায়, পোস্ট ট্রুথ এত দ্রুত ছড়িয়ে যায় কীভাবে? ওয়াসি আহমেদ জানাচ্ছেন, এর জন্য দায়ী-- “বর্তমান সময়ের তথ্য বিস্ফোরণ, প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবন, প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা, উত্তরাধুনিকতার ধারণার বিকৃত ব্যাখ্যা এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিদ্বেষ।”
‘রেবেল: কাম্যুর অ্যাবসার্ড নায়ক স্রেফ মানতাবাদী মিতচারী’ প্রবন্ধে আলবেয়ার কাম্যুর সূত্রে ওয়াসি আহমেদ জানাচ্ছেন, একজন রেবেল বা বিদ্রোহীর লক্ষণ হলো-- সে, প্রথমত, অযৌক্তিক পৃথিবীর মুখোমুখি হবে এবং তারপর সে সত্য খুঁজবে ও পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য নিজেকে তৈরি করবে; এবং দ্বিতীয়ত, সে একাধারে যোদ্ধা ও শিল্পী হয়ে উঠবে। তিনি আরও বলছেন-- “যোদ্ধা হিসেবে সে তার সামর্থ্যের মধ্যে মানবজীবনের মর্যাদা রক্ষার্থে মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে। আর শিল্পী হিসেবে তার লক্ষ্য হবে মানুষের মর্যাদার সৌন্দর্যকে ঐক্য ও সংহতি দিয়ে এমন এক ক্যানভাসে চিত্রিত করা যা তার গ্রহণযোগ্যতা ও সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে।” তার মানে কাম্যুর রেবেল মোটেই নিৎশের নিহিলিস্ট নয়। কাম্যুর রেবেলের এই ধারণার সমালোচনা করেছেন ওয়াসি আহমেদ-- প্রথমত, তিনি বলছেন, কাম্যু যে ন্যায্য ও ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থার কল্পনা করেছেন তা ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না; দ্বিতীয়ত, অযৌক্তিকতার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের কথা কাম্যু বলছেন তা খুবই নিয়ন্ত্রিত কর্মকাণ্ডকেই বোঝায়--“...বিদ্রোহের চেতনা থাকা অতি অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার প্রকাশ হবে সংযত, যা তার ভাষায় moderation-প্রবণ হওয়াই যৌক্তিক। এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক-- অযৌক্তিক ও উদ্ভট পরিস্থিতির মোকাবেলায় এই moderation কি আদৌ কোনো যুক্তি?” কাম্যুর রেবেলের বিদ্রোহ তাই ওয়াসি আহমেদের চোখে-- “আশাবাদের স্বেচ্ছাচারিতা বললে অত্যুক্তি হবে না।” মেটাফিজিকাল রেবেলিয়নের ব্যাখ্যাটা এমন-- পরিস্থিতি যতই উদ্ভট আর অযৌক্তিক হোক না কেন কাম্যুর রেবেল বিশ্বাস করবে যে সে একা নয়-- তার অভিজ্ঞতার সাথে মিল রয়েছে সমাজের সম্মিলিত অভিজ্ঞতার। এ ধারণাই কাম্যু প্রয়োগ করেছেন তার দু’টো উপন্যাসে-- দ্য আউটসাইডার ও দ্য প্লেগে। এমন সংযমী বিদ্রোহী ও সমন্বয়বাদী মিতাচারি বিদ্রোহীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্যাঁ পল সার্ত্রসহ কাম্যুর সমসাময়িক অনেকেই। জ্যাঁ পল সার্ত্র বলছেন-- চূড়ান্ত মুক্তি নিশ্চয় সম্ভব, কাম্যুর সীমাবদ্ধ রেবেল হয়ত তা পারবে না! প্রয়োজনে তো রেবেল সহিংসতাতেও জড়িয়ে পড়তে পারে! সেটা হওয়াই তো যৌক্তিক! হত্যাও সেখানে একটা স্বাভাবিক পরিণতি। ওয়াসি আহমেদ যুক্তি দিচ্ছেন, সার্ত্রের এ ভাবনার সাথে কার্ল মার্কসের বিদ্রোহের ধারণার মিল রয়েছে।
‘সংখ্যাগরিষ্ঠ বনাম চিরস্থায়ী সংখ্যালঘু’ প্রবন্ধে ওয়াসি আহমেদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে নির্ধারিত হয় কে সংখ্যাগরিষ্ঠ আর কে সংখ্যালঘু। সংখ্যাগরিষ্ঠরা তাদের ন্যায্য অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে বলেই বাস্তবে দেখা যায়। এরপরে তিনি প্রশ্ন তোলেন যে চিরস্থায়ী সংখ্যালঘু তবে কাদেরকে বলা হবে। মাহমুদ মামদানির যুক্তি মতো, ওয়াসি আহেমেদের ভাষায়-- “...উপনিবেশায়ন ও জাতীয়তাবাদ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, এবং উপনিবেশিকতা-উত্তর জাতিরাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুদের চাপে ও প্রভাবে সংখ্যালঘুদের চিরস্থায়ীভাবে সংখ্যলঘুত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয়।” আমরা দেখি, ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর একটা দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠরা নয়া উপনিবেশ স্থাপন করেছে। এই অভ্যন্তরীন উপনিবেশে ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক থেকে সংখ্যালঘুরা হয়ে উঠছে তাদের শত্রু, তাদের সহিংসতার শিকার। মামদানির ভাষ্যমতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে চিরস্থায়ী সংখ্যালঘুরা তখন মূলত তিনটা কাজ করতে পারে-- বৃহত্তর সমাজে অঙ্গীভূত হয়ে যাওয়া, দেশত্যাগ করা অথবা মৃত্যু বা আত্মহত্যাকে মেনে নেয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠদের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের বাস্তবায়নের মুখে আর কীইবা করবার থাকতে পারে তাদের! এর উদাহরণ হিসেবে মামদানি জানাচ্ছেন-- মিশরের জলবিদ্যুৎ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ-প্রকল্পের অংশ হিসেবে নীলনদে বাঁধ দেয়া হলে ভেসে যায় মিশর ও সুদানের সীমান্তে বসবাসকারী নুবিয়ানদের বসতবাড়ি ও জমিজিরাত। তারপর নুবিয়ানরা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছে। এ ব্যাপারটার সাথে আমাদের কাপ্তাই বাঁধ তৈরির সাথে জড়িত সংখ্যালঘু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্থানচ্যুতির ঘটনার মিল রয়েছে বলে ওয়াসি আহমেদ লক্ষ করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পয়লাতে সেখানকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যে স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন ঘটেছিল তারপরে দ্বিতীয়বারের মতো তাদের স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন ঘটে যায় যখন আশির দশকের গোড়াতে আদিবাসী অধ্যুষিত পাবর্ত্য অঞ্চলে সমতলের বাঙালিদের বসতি স্থাপনের প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। সহিংসতা প্রয়োগেরও নজির আছে সে সময়টাতে। এছাড়া ওয়াসি আহমেদ লক্ষ করছেন, পাহাড়ি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছাড়াও এ দেশের সমতলে আদিবাসীদের অস্তিত্ব রয়েছে-- মূলতই তারা গারো, সাওতাল ও ত্রিপুরা-- যারা দিনের পর দিন জমি বেদখল ও নানান অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীও নানান নিষ্পেশনের শিকার হয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরেই। এভাবেই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডের চাপে চিরস্থায়ী সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে যায় বলে আমাদেরকে সাবধান করছেন ওয়াসি আহমেদ। কাজেই তিনি মনে করেন, একটা রাষ্ট্রকে বহুত্ববাদের নীতি গ্রহণ করতে হয় যেখানে কেউই নিষ্পেশনের শিকার হবে না। সরকার বাদেও সুশীল সমাজ ও মিডিয়া সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
‘উনিশশ সাতচল্লিশ’ প্রবন্ধে ওয়াসি আহমেদ মনে করেন, ১৯৪৭ সালের মধ্য-অগাস্টের সহিংসতা ও দেশভাগের পাঠ মোটেই সহজ-সরল কিছু নয়। বাস্তুচ্যুত সাধারণ মানুষদের দুঃখের বিস্মরণ ঘটেছে এখানে, মুখ্য হয়েছে ভারতবর্ষ স্বাধীন করবার জন্য রাজনীতিবিদরা কী ভূমিকা নিয়েছেলেন, তা। এভাবে ইতিহাসের অনেক জরুরি অংশ কালে কালে আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেছে। ওয়াসি আহমেদ আমাদরেকে এও স্মরণ করিয়ে দেন যে ১৯৪৭-এ যেসব মুসলিম ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত হয়নি তাদেরকে নিজদেশে নতুন করে আত্মীকৃত হতে হয়েছে। সেই বেদনার কথা ভুলে গেছে আমাদের প্রথাগত ইতিহাস। দ্বিজাতীতত্ত্বের সারকথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-- “হিন্দু মধ্যবিত্তের সাম্প্রদায়িক শ্রেণীস্বার্থ উদ্ধারের জন্য অপেক্ষাকৃত অগ্রসর ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসেবে পৃথক রাষ্ট্রের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মুসলমান মধ্যবিত্তের সে প্রয়োজন ছিল।” এর ফলে দেশবিভাগকে ঘিরে নানান সম্প্র্রদায়গত উত্তেজনা ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়।
ওয়াসি আহমেদ আরও জানাচ্ছেন-- “...জিন্নাহ বা নেহেরু দু’জনের কারোই পূর্ববাংলা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না।” তাই ধর্মীয় হমোজেনিটির সূত্র ধরে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান নামের একটা দেশের সাথে সহজেই জুড়ে দেয়া হয়েছিল। লাভ হয়নি কেননা আমরা দেখি, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান নামের জাতিরাষ্ট্র থেকে পূর্ববাংলা পৃথক হয়ে যায়। তখন কথা উঠেছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দ্বিজাতিত্ত্বের অসারতাকেই প্রমাণ করেছে। তবে ওয়াসি আহমেদ বলছেন, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব যে এক ভ্রান্তির নাম তা প্রমাণ করতে একাত্তরের বাংলাদেশ পর্যন্ত আসার দরকার পড়ে না। বস্তুতপক্ষে, একাত্তরের বহু আগে সাতচল্লিশের পরপরই যখন মুসলমানদের গরিষ্ঠ অংশ ভারতে থেকে গেল, তখনই এই তত্ত্বের ভিত্তিহীনতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল।” সবশেষে তাই ওয়াসি আহমেদ যথার্থই মন্তব্য করছেন, দেশভাগ একটা বহুমাত্রিক ঘটনার ফল, ঐতিহাসিক বা তথ্যভিত্তিক বয়ান এখানে সাতচল্লিশের পরিণতিকে সঠিকভাবে ব্যাখা করতে ব্যর্থই হবে।
ইউফিমিজম বা সুভাষণকে ভাষাগত কপটতা হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে বলে ওয়াসি আহমেদ মনে করেন। তার ‘সুভাষণের আড়াল-আবডাল’ প্রবন্ধে তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন যে আমরা চুরিকে সোজাসুজি চুরি না বলে দুর্নীতি বলে থাকি। এটা একটা সুভাষণ। এর পেছনে একই সামাজিক আবহের মানুষের জ্ঞাতিত্ববোধ কাজ করে বলে তিনি মনে করেন--“...চোর বলে যার আবছা মুখ আপনার কল্পনায় উঁকি দেয়, তার সাথে এই তথাকথিত দুর্নীতিবাজের মুখের মিল নেই। অবচেতনে আপনি মুখটাকেই তালাশ করেন।” ওয়াসি আহমেদ বলতে ভুলছেন না যে দুর্বল একজন চোরের মুখ আমাদের মাথায় গেঁথে থাকবার ফলে আমরা সুবেশী, গাড়ি হাঁকানো, ক্ষমতাধর চোরকে আমরা সুভাষণের ছলনাতে দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যা দিয়ে থাকি।
‘দারিদ্র্যের রসায়ন ও পশ্চিমা সন্দর্ভ’ প্রবন্ধে ওয়াসি আহমেদ লক্ষ করছেন যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দারিদ্র্য আসলে পশ্চিমা বিশ্বের এজেন্ডা পূরণের জন্যই দরকার। তিনি বলছেন, “পুবে দারিদ্র্য চিরস্থায়ী আসন গেড়েছে বলেই পশ্চিমের বৈভব-সমৃদ্ধি চোখে পড়ে। কট্টর ভাষায়, দারিদ্র্যের কারণেই সমৃদ্ধি বা সমৃদ্ধির কারণেই দারিদ্র্য।” এখানেই এসে এক হয়ে যায় অরবিন্দ আদিগার উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট টাইগার’ আর ড্যানি বয়েলের চলচ্চিত্র ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’-এর উপসংহার-- দারিদ্র্য থেকে মুক্তিই বড় কথা যাতে রয়েছে খুন, রাহাজানি বা লুটপাটের ঘটনা; রয়েছে ইচ্ছাপূরণের শক্তি। ব্যাপারটা দেখে মনে হয় যেন এমন অন্যায়ভাবেই দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং তা তখন পশ্চিমাদের উন্নয়ন-এজেন্ডার অংশ হয়ে দাঁড়ায় যা কিনা পশ্চিমারা চাপিয়ে দেয় তৃতীয় বিশ্বের ওপরে! এটাকেই ওয়াসি আহমেদ ‘দারিদ্র্যের রসায়ন ও পশ্চিমা মনস্তত্ত্ব্’ বলেই অভিহিত করছেন। দারিদ্র্য বা তা থেকে মুক্তি নিশ্চয় এত সহজ-সরল কিছু নয় বলেই যুক্তি দিচ্ছেন তিনি।
এ পর্যন্ত আমরা ওয়াসি আহমেদের ‘প্রগতিশীলতার ইচ্ছাপূরণ’ শীর্ষক বইয়ের যে প্রবন্ধগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলোর কেন্দ্রে রয়েছে রাজনীতি। তার এই রাজনীতি-সচেতন প্রবন্ধগুলো কোনও আপ্তবাক্য হয়ে ওঠেনি, বরং সেগুলো পরম নির্ভরতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তিবাদের ওপরে। আর তার যুক্তিগুলো গড়ে উঠেছে কোনও না কোনও তাত্ত্বিক কাঠামোর ওপরে ভিত্তি করেই। এটাই এই বইয়ের সৌন্দর্য বলে আমরা মনে করি। এটা দুঃখজনক যে আজকালকার বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ যা ইচ্ছে তাইই বলে বেড়াচ্ছেন, তার পেছনের যুক্তিগুলো দেখাবার মতো দায়িত্ববোধ করছেন না, মানে-- তিনি যা মুখে উচ্চারণ করবেন সেটাই বেদবাক্য হয়ে উঠবে বলেই তিনি ধরে নিচ্ছেন, ভ্রমবশতই নিশ্চয়। এ অনৈতিক ও ক্ষতিকর প্রবণতা থেকে প্রবন্ধকার ওয়াসি আহমেদ যোজন যোজন দূরে রয়েছেন। প্রবন্ধ এমনই বস্তুনিষ্ঠ হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি। ওয়াসি আহমেদ বাংলা প্রবন্ধের সেই মূল্যবান ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দিলেন। তার জন্য সাধুবাদ রইলো।
প্রগতিশীলতার ইচ্ছাপূরণ
ওয়াসি আহমেদ
প্রকাশক: কথাপ্রকাশ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৪৪
দাম: টাকা-৪০০