পাশাপাশি ভবন মালিকেরও শাস্তি দাবি করা হয়েছে।
Published : 05 Mar 2024, 06:05 PM
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় অর্ধশত প্রাণহানির পর রেস্তোরাঁ স্থাপনে প্রত্যয়নকারী সাত সরকারি সংস্থা ও ভবনটির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে পরিবেশবাদী তিন সংগঠন।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউটট অব প্ল্যানার্স-বিআইপি ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন-বেলা।
বাপার সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘‘দেখা গেছে, হাতে গোনা দুই-একটি ক্ষেত্রে মামলা হলেও সাজার কোনো নজির নেই। আমাদের মূল দাবি, অবহেলাজনিত কারণে ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও এর হতাহতের বিপরীতে ভবন নির্মাণ, অকুপেন্সি সার্টিফিকেট এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অনুমোদন প্রদানকারী ১০টি সংস্থাকে দায়ী করে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ এবং ভবন মালিককে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসেবে গণ্য করে আইনের আওতায় আনা হোক।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, একটি রেস্তোরাঁ স্থাপনে সাতটি সংস্থার ১০টি প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে আছে-সিটি করপোরেশনের অনাপত্তিপত্র; একই প্রতিষ্ঠানের ই-ট্রেড লাইসেন্স; পরিবেশগত ছাড়পত্র; জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেস্তোরাঁ লাইসেন্স; সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের লাইসেন্স, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দোকান লাইসেন্স; একই প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স, রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সনদ; ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ফায়ার লাইসেন্স এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের অবস্থানগত ছাড়পত্র।
গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণ যায়। বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে অনুমোদন নিলেও সেখানে রেস্তোরাঁ করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু আট তলা ওই ভবনে ব্যবসা করছিল ১৪টি রেস্তোরাঁ ও খাবারের দোকান।
ভবনে ছিল না কোনো ফায়ার একজিট। একমাত্র সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডারসহ রেস্তোরাঁর মালামাল। কাচে ঘেরা ভবনের উপরের ফ্লোরগুলো থেকে নামতে না পেরে ধোঁয়ার বিষক্রিয়ায় অধিকাংশের মৃত্যু হয়।
এই ঘটনাকে ‘অবেহলাজনিত হত্যাকাণ্ড’ বর্ণনা করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “অগ্নি দুর্যোগ প্রতিরোধে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সামগ্রিক কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে হবে। অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড রোধপূর্বক নিরাপদ নগরী গঠন নিশ্চিতে যথাযথ ও সমন্বিত কার্যকরী পদক্ষেপ নিতেই হবে।”
অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় করণীয় হিসেবে সরকারকে ১১ দফা প্রস্তাব দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনকারী তিন সংগঠনের তরফে, যার মধ্যে আছে-
তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সরকারি ছয়টি মন্ত্রণালয় বা সংস্থার সমন্বয়ে টাস্ক ফোর্স গঠন করে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ এবং ‘অতি বিপজ্জনক’ ও ‘বিপজ্জনক’ ভবনের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা;
ড্যাপ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যতয়কারী রাজধানীর ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ ভবনকে নিয়মের আওতায় আনা;
ভবনের সামনে প্রতিবছর ব্যবহারযোগ্যতার (নবায়ন) সনদ প্রকাশ্যে টানানোর ব্যবস্থা করা;
বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিআরএ) প্রতিষ্ঠা করা;
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ‘সিভিল ডিফেন্স’ অংশকে শক্তিশালী করে সকল শিল্প ও বাণিজ্যিক ভবনে প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা;
অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ-আইন সময়োপযোগী করা;
সরকারের ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার ফর ডিজাস্টার’ অনুযায়ী দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্ব দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা;
স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন স্থাপন করা;
অগ্নি ঝুঁকি ও নিরাপত্তা বিষয়ক গণসচেতনতামূলক প্রচার ও জনসংযোগের ব্যবস্থা করা;
নগরীর বিদ্যমান পুকুর, খাল, অন্যান্য জলাশয় পুনরুদ্ধার করে তা সংরক্ষণ, ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা করা এবং
প্রত্যয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করা।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সারাদেশে গত ৯ বছরে এক লাখ ৯০ হাজার ১৬৭টি অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে; যাতে মারা গেছে ১ হাজার ৫১ জন, আহত হয়েছে ৩ হাজার ৬০৬ জন।
“ঢাকাসহ সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে অনুমোদনহীন অবৈধ ভবন, অবৈধ ভূমি ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব। বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড ও ইমারত বিধিমালয়ে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের পাশাপাশি বাধ্যতামূলক করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুমোদিত ব্যবহার পরিবর্তন অথবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত করা হচ্ছে অথবা ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করার কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছে।
“যেসব সংস্থা প্রত্যায়নপত্র দিয়েছে তাদের কোনো তদারকিও নেই। ফলে বার বার মানুষ একটা মৃতুকূপের শিকার হচ্ছে, জীবন-প্রাণ হারাচ্ছেন, সৃষ্টি হচ্ছে মানবিক বিপর্যয়।”
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাপার অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যাপক আতিয়ার রহমান, আলমগীর কবির, আহমেদ কামরুজামান মজুমদার, বেলা’র সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এস হাসানুল বান্না, বিআইপি’র আদিল মুহাম্মদ খান, শেখ মুহাম্মদ মেহেদী হাসান।