জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, বঞ্চনার কথা আল্লাহর কাছে বলা ছাড়া আর কেউ নেই।
Published : 07 Aug 2024, 10:38 PM
ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনে কোণঠাসা হয়ে থাকা পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা ক্ষোভ প্রকাশ করতে সচিবালয়ে এসেছিলেন।
বুধবার সকাল থেকে বঞ্চিতরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জড়ো হতে শুরু করলেও তাদের ক্ষোভের কথা শোনার জন্য কোনো কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন না। কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্ষুব্ধ কর্মীরাও বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তবে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই এদিন সচিবালয়ে অনুপস্থিত থাকায় প্রশাসনের এই প্রাণকেন্দ্র কার্যত ফাঁকাই ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত জুন মাসে শুরু হওয়া সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে প্রাণঘাতি সংঘর্ষে রূপ নেয়। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ছয় ছাত্রের মৃত্যুর পর আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের ব্যানারে আন্দোলনে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সম্পৃক্ত হতে থাকে।
গত ৩ অগাস্ট সরকার পতনের এক দফা চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে পরদিন থেকে অসহযোগ কর্মসূচি শুরু করে আন্দোলনকারীরা। এর একদিনের মাথায় গত সোমবার টানা চার মেয়াদে সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে দেশত্যাগ করেন।
ওইদিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর গণমাধ্যমে এসে ঘোষণা করার পর থেকেই প্রশাসনে অস্থিরতা দেখা দেয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে পর দিন মঙ্গলবার সব সরকারি কর্মকর্তাদের দপ্তরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু মঙ্গলবার সচিবালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দিনের অর্ধেক সময় পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো উপস্থিতি ছিলনা। দুপুরের দিকে আগুন আতঙ্কের গুজব ছড়িয়ে কর্মকর্তারা কেউ দৌঁড়ে কেউ দ্রুত পায়ে হেঁটে সচিবালয় থেকে বেরিয়ে যান।
বুধবারও প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে নেই কোনো কর্মকর্তা। অনেকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ে এলেও নিয়মিত কাজ না করে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শে ব্যস্ত ছিলেন। যারা দপ্তরে উপস্থিত হননি তাদের কোনো বিপদ হলো কিনা, সেই খবর নিচ্ছিলেন কেউ কেউ।
সকাল থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের বারান্দায় প্রশাসন ক্যাডারের শত শত বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দেখা যায়। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা সেখানে গত সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে গালাগাল করছিলেন।
দুপুরে অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নাজমুছ সাদাত সেলিমের কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ১০- ১৫ জন কর্মকর্তা বসে আছেন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব সেলিম দপ্তরে নেই।
দুই-একজনের কাছে ক্ষোভের কারণ জানতে চাইলে তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।
“এটা আমাদের দপ্তর। এখানে আসতে আমাদের কোনো কারণ লাগে না, যা শুনেছেন তাই। আমাদের কোনো মূল নেতা নেই। কিছু বলতে হলে আমরা পরে বলব। আপতত এই বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে পরিচিতি পাওয়া সারওয়ার আলমকে পাওয়া গেল এপিডি দপ্তরে।
২৭তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি ২৭তম বিসিএসের। কেবল আমি নই, আমাদের ব্যাচের অনেকেই পদোন্নতি বঞ্চিত। এখানে এমনিতেই আসলাম।”
তার মতোই জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে পরিচিতি পেয়েছিলেন ২২তম বিসিএসের কর্মকর্তা মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। এদিন তিনি সচিবালয়ে বঞ্চিতদের দলে না থাকিলেও বঞ্চনার ক্ষোভ রয়েছে তারও।
মনজুর শাহরিয়ার বলেন, “আমি এখন অসুস্থতার কারণে বাইরে বের হতে পারছি না। তবে পদোন্নতির বঞ্চনা আমারও আছে।”
যোগাযোগ করা হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) অতিরিক্ত সচিব নাজমুছ সাদাত সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৭তম বিসিএস থেকে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই ডিএস বা উপসচিব হয়েছেন। ২২তম বিসিএসের নিয়োগপ্রাপ্তরা যুগ্মসচিব হয়েছেন।
বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানও।
১৩তম বিসিএসের এই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার তো দেড় বছর আগে সচিব হওয়ার কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত কেন পদোন্নতি পেলাম না তা তো জানি না। আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। হয়ত আরও কিছু কাজ করতে পারতাম। পেছনে সুতা বাঁধা ছিল; তাই করতে পারিনি। বলতে পারেন মূল্যায়ন করেনি।
“১৩তম ব্যাচের ৩২ জন সচিব হয়েছেন। মেধার দিক থেকে দুই জন ছিলেন আমার সামনে, বাকি ৩০ জনই মেধার দিক থেকে আমার পেছনে ছিল। বঞ্চনার কথা আল্লাহর কাছে বলা ছাড়া আর কেউ নেই।”
সরকার বদলেও অনেকে ‘হালুয়া-রুটির জন্য’ দৌড়াদৌড়ি শুরু করছে, এমন ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “কিছু মানুষ থাকবে যারা শুধু কাজ করবে। আর কিছু মানুষ হালুয়া-রুটির জন্য দৌড়াবে। নতুন সরকারের জন্য যে কদিন পারব, কাজ করে যাব। এই মুহূর্তে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। তারপরও আমি কাজ করে যাচ্ছি। কাল বাজার অভিযানে নামছি।”