সিলেটে নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাতিল করতে হয় আয়োজন।
Published : 06 Sep 2024, 10:19 PM
জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি উঠার পর দেশজুড়ে লাখো কণ্ঠে বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, কেউবা রাজপথে নেমে এই গানের সুরেই জানাচ্ছেন দেশকে ভালোবাসার প্রত্যয়।
মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীত নিয়ে সব রকম ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার বার্তাও এসেছে বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি থেকে।
গত মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী।
শুক্রবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় সংগীত গেয়ে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জোগানো বিভিন্ন গানও পরিবেশন করেন তারা।
সংগীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ছায়ানট তাদের নিয়মিত সংগীত শিক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা সমাবেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের একটি ভিডিও সকালে তাদের অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজে প্রকাশ করে।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় সংগীত গেয়ে তো নিয়মিতই আমরা আমাদের শিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করি। আজকের সমাবেশের ভিডিও প্রকাশের বিশেষ একটি দিক তো আছেই। আমরা চাই জাতীয় সংগীতের মর্মবাণী যেন সবার মাঝে পৌঁছায়।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের গুঞ্জন পাঠাগারে শুক্রবার সকালের কর্মসূচিতে শতকণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। পাঠাগারটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বপন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় সংগীত তো আমরা পাঠাগারের যে কোনো আয়োজনেই নিয়মিত পরিবেশন করি। তবে আজকে আমরা শতকণ্ঠে গেয়েছি মূলত আমান আযমীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে।”
কুষ্টিয়া পৌরসভার বিজয় উল্লাস চত্বরে এই আয়োজন হয় ‘সংস্কৃতিকর্মী’ নামে একটি ব্যানারে। এতে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। সঞ্চালনা করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সরওয়ার মুর্শেদ।
জাতীয় সংগীত ও পতাকাসহ বাঙালি জাতির অস্তিত্বের উপর উগ্রবাদী আগ্রাসন রুখতে এই আয়োজন করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
প্রগতিশীল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা বিকাল ৫টায় কক্সবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই কর্মসূচি পালন করে ‘ক্রিয়াশীল সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন’ এর ব্যানারে।
তারা জাতীয় সংগীত ছাড়াও দেশাত্মবোধক গানও পরিবেশন করেন। অংশ নেওয়া সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- উদীচী শিল্পী-গোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পী-গোষ্ঠী, খেলাঘর আসর, কক্সবাজার থিয়েটার, থিয়েটার আর্ট, সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন, প্যানোয়া ও কমবা।
উদীচীর কেন্দ্রীয় আয়োজন
জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিপরীত পাশের সড়কে হয় উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের আয়োজন। এতে অংশ নেয় সংগঠনের মহানগর শাখাসহ জাতীয় খেলাঘর আসর। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে অংশ নেন সেখানে। সংস্কৃতিকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও কণ্ঠ মেলান।
উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে জানানো হয়, দেশের সব জেলা ও বিদেশে তাদের শাখা সংসদের শিল্পী-কর্মীরাও একই কর্মসূচি পালন করেছে। তাতে অংশ নিয়েছে সাধারণ মানুষও।
উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, “আমরা দায়বদ্ধ মানুষের প্রতি। আমাদের অর্জন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যখনই কোনো আঘাত আসবে, আমরা তার প্রতিবাদ করব।”
জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা কারও দানে পাওয়া নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “লাখো শহীদের রক্তে পাওয়া এ আমাদের অর্জন। এই অর্জনকে কোনোভাবেই কলঙ্কিত করা যাবে না।
“যখনই কেউ মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীতে আঘাত করবে, আমরা তার প্রতিবাদ করবই।”
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, “যখনই দেশের উপর, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর আঘাত এসেছে- আমরা প্রতিবাদ করেছি। এবারও জাতীয় সংগীত গেয়ে এই কর্মসূচি, সেই ধারাবাহিক প্রতিবাদেরই অংশ।”
নিরাপত্তা শঙ্কায় বাতিল
সিলেটে সংস্কৃতিকর্মীরা বৃহস্পতিবার শহীদ মিনারের উন্মুক্ত স্থানে সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার কর্মসূচি নিলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে একদিন পেছানো হয়। উন্মুক্ত স্থানের বদলে সেটি নেওয়া হয় নগরীর কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে। সেখানেও শেষ মুহূর্তে আয়োজনটি স্থগিত করা হয়।
আয়োজনের অন্যতম সমন্বয়ক অরূপ বাউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিরাপত্তা শঙ্কার কারণেই আমরা আয়োজনটি প্রস্তুতি নিয়েও করতে পারিনি।”
জাতীয় সংগীত গাইতে নিরাপত্তার শঙ্কা কেন? প্রশ্নে অরূপ বাউল বলেন, “এই উদ্যোগ নেওয়ার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাদের বিনীতভাবে নিরাপত্তা বিষয়ক সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়।
“এছাড়া এই আয়োজনকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের আয়োজন বলে প্রচার চালায় কেউ কেউ। এ কারণে সবার কথা ভেবে আমরা কর্মসূচিটি স্থগিত করি।”
নাট্যকর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যে জাতীয় সংগীত আছে, তা পরিবর্তন হওয়ার মত কোনো কারণ নেই। কেউ একজন বললেই তো তা পরিবর্তন হয়ে যাবে না।”
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানসহ প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক’ এর সঙ্গে যুক্ত এই শিক্ষক বলেন, “জাতীয় সংগীত অপরিবর্তিত থাকবে এবং কেউ জাতীয় সংগীত গাইতে গেলে নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি হবে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার উপর যে নিপীড়ন হয়েছে, মানুষ হত্যা হয়েছে- তার বিচার যেমন সরকার করবে, আবার যে কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন করার জন্য নিরাপদ পরিবেশও তৈরি করে দেবে সরকার। আমরা সেটাই প্রত্যাশা করি।”
ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে।
আয়োজনটির অন্যতম সমন্বয়ক মেহেদী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেখানে ‘লাল জুলাইয়ের কবিতা’ শিরোনামে আরেকটি আয়োজন একই সময়ে ছিল। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ কেউ আমাদের জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ এই আয়োজনের সুযোগে মাঠে সক্রিয় হতে পারে। যার জন্য আমরা কর্মসূচিটি স্থগিত করি।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শুক্রবার বিকেলে ‘লাল জুলাইয়ের কবিতা’ শিরোনামের কর্মসূচিটি আয়োজন করে ‘সাধারণ আবৃত্তিশিল্পীবৃন্দ’ নামে একটি প্লাটফর্ম। এই আয়োজনটির সূচনা হয় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। একইসঙ্গে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
‘লাল জুলাইয়ের কবিতা’ আয়োজনের অন্যতম সমন্বয়ক আলমগীর হোসেন শান্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করেছি।”
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, রাঙামাটি, গাইবান্ধা, কুষ্টিয়া ও কক্সবাজার প্রতিনিধি।