প্রত্যন্ত গ্রামের কেউ সাপ দেখে ফোন করে সহায়তা চাইছেন। কেউ কেউ বন কর্মকর্তাদের ভাবছেন সাপুড়ে। আবার বিদেশ থেকে প্রবাসীদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য পরামর্শ চাইছেন।
Published : 25 Jun 2024, 11:18 PM
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক আর গুজবের মধ্যে বন অধিদপ্তরের পাঁচটি হটলাইন নম্বরে ঘণ্টায় গড়ে ২০০ ফোন আসছে দেশ-বিদেশ থেকে।
প্রত্যন্ত গ্রামের কেউ সাপ দেখে ফোন করে সহায়তা চাইছেন। কেউ কেউ বন কর্মকর্তাদের ভাবছেন সাপুড়ে। আবার বিদেশ থেকে প্রবাসীদের কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের জন্য পরামর্শ চাইছেন।
বন অধিদপ্তরের বন্যপপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কর্মীদের এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে গত বৃহস্পতিবার থেকে।
এ ইউনিটের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৃহস্পতিবার রাত থেকে ফোন আসার চাপ শুরু হয়। প্রতিটা নম্বরে ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৪০টা কল এসেছে। অনেকগুলো নম্বর ওয়েটিংয়ে ছিল।”
তিনি জানান, আগে তারা সাপের বিষয়ে সপ্তাহে বড়জোর দুয়েকটা ফোন পেতেন। সব মিলিয়ে দিনে ফোন আসত পাঁচ থেকে সাতটি। এখন হটলাইনের সবগুলো নম্বর সামাল দিতে হিমশি খেতে হচ্ছে।
অসীম মল্লিকের ধারণা, কোনোভাবে তাদের নম্বরগুলো ফেইসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ হয়ত লিখছে, যেখানেই সাপ দেখবেন, এই নম্বরে ফোন দেবেন। এভাবেই নম্বরগুলো ছড়িয়ে পড়ছে।
“হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। সাপ মারার ছবি পাঠিয়েছে অনেকে, জীবিত সাপের ছবিও পাঠিয়েছে। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা শুধু রাসেলস ভাইপার।”
এ বন্যপ্রাণী পরিদর্শক বলেন, যত সাপ দেশে আছে, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই নির্বিষ। গত কয়েকদিনে প্রচুর ‘দাগি ঘরগিন্নি’ সাপ মারা পড়ছে। হলুদ-কালো ছোপের কারণে অনেকে এটাকে রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা মনে করছেন। ঢোরা সাপের বাচ্চাগুলাকেও অনেকে রাসেলস ভাইপার মনে করছেন। এই সাপগুলো সচরাচর মানুষের কাছাকাছি থাকে।
“আমরা শুধু ফরিদপুরে রাসেলস ভাইপার পেয়েছি, পদ্মার চরে এটাতো স্বাভাবিক। কুমিল্লা থেকে অনেকে অভিযোগ পাঠিয়েছিল, পরে দেখলাম এটা ঘরগিন্নি সাপ। জামালপুর থেকে পাঠিয়েছে, সেটা দেখলাম চেলা সাপ।”
অসীম মল্লিক বলেন, সোশাল মিডিয়ায় এ সাপ নিয়ে যেসব ভিডিও ঘুরপাক খাচ্ছে, তার বেশিরভাগই ভারতের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাভাবে ছড়িয়ে সেগুলো আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।
“আমরা মানুষকে বোঝাচ্ছি, বেশিরভাগই নির্বিষ সাপ। ছবি পাঠিয়ে দেখিয়েছি কোনটা রাসেলস ভাইপার। অনেকে আগে অনেক সাপ দেখছে, কিন্তু তা নিয়ে ভয় ছিল না। রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক শুরুর পর তারাও সব সাপকে রাসেলস ভাইপার ভাবছেন।”
গত কয়েক বছর ধরে বর্ষা মৌসুমে, বিশেষ করে বন্যা ও ঢলের সময় লোকালয়ে রাসেলস ভাইপারের দেখা মিলছে। এ বছর বেশ কয়েকজন দংশিতও হয়েছেন; তাদের বেশিরভাগই কৃষক, ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে।
কিন্তু সেই খবর এমন আতঙ্ক তৈরি করেছে যে, সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশাল মিডিয়া- সর্বত্র চলছে আলোচনা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ নিয়ে উদ্বেগ দেখালেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
>> এক যুগ আগে যেখানে ১৭টি জেলায় বিষধর এ সাপের দেখা মিলেছে, এখন তা ছড়িয়েছে প্রায় ২৬-২৭টি জেলায়।
>> কোথাও কোথাও সাপ দেখে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ দিনেই পিটুনির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ১১টি সাপ।
>> সাপ নিধন যে দণ্ডনীয় অপরাধ, সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্রাণীর ভারসাম্য রক্ষায় জোর দিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
>> স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছে, সাপের বিষের প্রতিষেধক সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক প্রধান আমির হোসাইন চোধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বছরে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে সাপে কাটে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ মারা যায়। রাসেলস ভাইপারের দংশনে মারা যায় ১০০ জনের মত।
“সুতরাং অন্যান্য সাপের তুলনায় রাসেলস ভাইপার কম বিষাক্ত, আগ্রাসীও কম। কিছু কিছু জায়গায় আক্রান্ত হয়েছে মানুষ, কিন্তু গুজব বেশি উঠে গেছে।”
তিনি জানান, বন অধিদপ্তর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার করা হয়েছে। অনেক এলাকার মানুষ রাসেলস ভাইপার সাপ চিনতে পারছে না।
“যে কোনো সাপ দেখেই বলছে রাসেলস ভাইপার। কিন্তু এর বিস্তৃতিটা পদ্মা নদী সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে। সাপটা পাশের দেশেও আছে, অনেক দেশেই আছে; আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
আমির হোসাইন চোধুরী বলেন, “এসব এলাকায় যারা সাপ নিয়ে কাজ করে, আর আমাদের ২৫০টির বেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে। এই সংগঠনগুলোর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে শনিবার রাতে মিটিং করেছি। কারণ প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে আমাদের লোকবল নেই, সাধারণ মানুষদের সচেতন করার জন্য এসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তাদের সাথে বসেছি, তাদেরকে বলেছি- গ্রাম পর্যায়ে যেন সচেতনতাটা বাড়ানো যায়। এছাড়া জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গেও আমাদের টিম যোগাযোগ রাখছে।”
বিচিত্র অভিজ্ঞতা, উদ্বিগ্ন প্রবাসীরও
বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক জানান, তারা দেশের বাইরে থেকেও অনেক ফোন পাচ্ছেন। তারা জানতে চাইছেন দেশে থাকা তাদের বাবা-মায়ের জন্য করণীয় কী।
“অনেকে ফোন দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা বলে। যেসব আলোচনা করার কথা না, সেসব আলোচনা করে। অনেকে বলে, ‘আপনি তো সাপুড়ে! আসেন, সাপ ধরতে।’ তখন বলি, যদি সাপ ধরার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই যাব।
“আমরা তাদের বোঝাই, কখনো যদি সাপে কাটে, তাহলে ওঝার কাছে না গিয়ে উপজেলা মেডিকেল বা জেলা মেডিকেলে যেতে হবে দেরি না করে। অ্যান্টিভেনম আছে হাপতালগুলোতে। আমরা তাদেরকে আশ্বস্ত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।“
অ্যান্টিভেনম নিয়ে গবেষণা কতদূর
প্রায় দুই বছর আগে রাসেলস ভাইপারের অ্যান্টিভেম তৈরির কাজ শুরু করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়।
তিনি বলেন, “অ্যান্টিভেনম তৈরি করা একটা লম্বা প্রক্রিয়া। আমাদের দুই ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করার কথা ছিল। মুরগী, ছাগল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, অ্যান্টিবডি সংগ্রহের পর্যায়ে আছে এখন। অ্যান্টিবডি তৈরি করে দেখব সেটা কাজ করে কিনা। আর অ্যান্টিভেনম তৈরি করাটা হচ্ছে একটা ফার্মাসিউটিক্যাল প্রক্রিয়া। অ্যান্টিবডি যদি কাজ করে তাহলে অ্যান্টিভেনম তৈরি করা হবে এবং সেটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি তৈরি করবে।”
তার পরামর্শ, রাসেলস ভাইপার দেখলে ‘সৌজন্যের সঙ্গে’ এড়িয়ে যেতে হবে, মারতে যাওয়া যাবে না। তাকে তার মত থাকলে দিলে সে কখনো ছোবল দিতে আসবে না।
“এটা যদি মাথায় থাকে, তাহলে এ সাপগুলোকে ধরে ধরে মেরে ফেলার কারণ হয় না। আর সাপে কাটলে প্রথম কাজ হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়া।”
সাপের দংশনের ক্ষেত্রে করণীয়
- দংশিত অঙ্গ নড়াচড়া করা যাবে না। পায়ে দংশন হলে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশন হলে হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাত পায়ের গিরা নাড়াচাড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে।
- আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে।
- ঘড়ি বা অলংকার বা তাবিজ, তাগা ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন।
- দংশিত স্থানে কাটা যাবে না, সুঁই ফোটানো যাবে না, কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগানো বা অন্য কিছু প্রয়োগ করা যাবে না।
- সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না।
- যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যেতে হবে।
- আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ রাসেলস ভাইপারের বিষ-প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়।
বিষধর সাপ চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেনও।
তিনি বলেছেন, “স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে আমি বলব, আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। রাসেলস ভাইপারে দংশনের যে ওষুধ তা আমাদের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আমি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি, কোনো অবস্থাতেই অ্যান্টিভেনোমের ঘাটতি থাকা যাবে না।”
আরও পড়ুন...
রাসেলস ভাইপার নিয়ে উভয় সংকট, ছড়াচ্ছে জেলায় জেলায়
রাসেলস ভাইপার: নিধন নয়, 'করণীয়' জানাল সরকার
রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্যমন্ত্রী