‘পুইড়া মরতে নাতিডারে ঢাকায় আনলাম’

রেস্তোরাঁর মাচায় আগুনে পুড়ে ঘুমন্ত অবস্থায় শরীফের মৃত্যু হয় বলে দাবি নানা আবুল কাশেমের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2022, 05:56 PM
Updated : 15 August 2022, 05:56 PM

অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে নাতির পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকায় নিয়ে যান নানা। দৈনিক ৪০০ টাকা মজুরিতে চকবাজারের ‘বরিশাল রেস্টুরেন্টে’ একটি কাজও জুটিয়ে দেন।

কয়েকদিন আগে ১০ দিনের বেতন পেয়ে বাড়িতে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছেন ১৫ বছরের শরীফ। এসব বলতে বলতেই কেঁদে ফেলেন অন্য একটি রেস্তোরাঁয় বাবুর্চি হিসেবে কাজ করা নানা আবুল কাশেম।

“এতোটুকু পোলারে এত কষ্টের কামে দিতে চাই নাই। কিন্তু কী করুম, তাগো সংসার যে চলে না। এহনে সবাই কইতাছে পুইড়া মারতে নাতিডারে ঢাকায় আনলাম। আমি কী কমু ওর বাপ-মায়েরে।”

ঢাকায় মেসিয়ারের চাকরির একমাস না যেতেই সেই রেস্তোরাঁর মাচাতেই সোমবার দুপুরে ঘুমন্ত অবস্থায় শরীফের মৃত্যু হয় বলে দাবি করছেন নানা আবুল কাশেম। যদিও রাত পর্যন্ত শরীফের লাশ শনাক্ত করা যায়নি।

সোমবার বেলা ১২টার দিকে চকবাজারের কামালবাগে দেবী দাস ঘাট এলাকার চারতলা একটি ভবনে আগুন লাগার পর ফায়ার সর্ভিসের ১০টি ইউনিট সোয়া দুই ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনে।

আগুন নেভার পর ভবনের নিচতলায় ‘বরিশাল রেস্টুরেন্টের’ ছাদের নিচে কাঠ দিয়ে বানানো মাচা থেকে উদ্ধার করা হয় ছয়জনের লাশ। সেখানে রেস্তোরাঁর কর্মীরা ঘুমাতেন বলে জানান চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম।

উদ্ধার করা মৃতদেহগুলো রেস্তোঁরার কর্মীদের বলে জানান, ফায়ার সার্ভিসের অয়্যারহাউজ ইনস্পেক্টর আনোয়ারুল ইসলাম।

তবে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী স্বজনরা তাদের লাশ শনাক্ত করতে পারেননি। কয়েকটি লাশ পুড়ে চেহারা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না। যে কারণে শরীফের মৃত্যু হয়েছে কি না সেটাও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আবুল কাশেম জানান, শরীফদের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনার তীরচর গ্রামে। তার বাবা কৃষিকাজ করেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে শরীফ ছোট, বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিলেন শরীফ।

এর মধ্যেই তার বাবার মেরুদণ্ডে জটিলতা শুরু হয়, তিনি একেবারেই বিছানায় পড়ে যান। তার ওপর তার চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে পরিবারটির প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ হয়ে যায়।

“কোরবানি ঈদের এক সপ্তাহ পরে শরীফরে ঢাকা নিয়া আসি। পরে ৪০০ টাকায় মেসিয়ারের চাকরিতে ঢুকাইয়া দেই।”

বরিশার রেস্তোরাঁর মালিক ফখরুদ্দিন পূর্ব পরিচিত বলে জানান বাবুর্চি আবুল কাশেম। তবে আগুন লাগার পর থেকে ফখরুদ্দিন লাপাত্তা।

নিখোঁজ ছয়জন

চকবাজার থানার পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর বিপরীতে বরিশাল রেস্তোঁরার ছয় কর্মী নিখোঁজ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

নিখোঁজ ব্যক্তিরা হলেন- রেস্তোঁরাটির রুটি বাননোর কারিগর ওসমান সরদার (২৫), কর্মী বিল্লাল (৩৪), স্বপন (২২), শরীফ (১৫), মোতালেব (১৮) ও রুবেল (২২)।

নিখোঁজ শরীফের মামা মো. আরিফ জানান, তারা লাশ শনাক্ত করতে পারেননি।

তবে বিল্লালের সম্বন্ধী জিয়াউদ্দীন বলেন, “আমরা বিল্লালের লাশ শনাক্ত করছি। ওই পাঁচটি বডি পুইড়া অঙ্গার হইছে। তবে বিল্লাল মোটা-গাটা, মুখে দাড়ি আছে, শরীরে স্পট আছে সব স্পষ্ট। চেহারা চেনা যায়।

“তয় আমাগো কইছে লাশ এহনই দিবো না। পোস্ট মর্টেম হইব তারপর প্রশাসন আইসা লাশ বুঝায়া দিব।”

আগুনের সূত্রপাত কোথায়?

স্থানীয়রা জানান, চারতলা যে ভবনটিতে আগুন লেগেছিল তার উপরে তলাগুলোতে খেলনা তৈরি ও সংযোজনের কারখানা এবং গুদাম। তবে ভবন মালিককে পাওয়া যায়নি।

তারা বলছেন, বরিশাল রেস্তোঁরায় লাইনের গ্যাস ব্যবহার করা হতো। তার পাশে একটি স্যান্ডেল (ইভা) তৈরির কারখানা। স্যান্ডেল তৈরিতে অতি দাহ্য রাসায়নিক পাউডার ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

পাশের দোকানের কর্মী বিল্লাল জানান, ভবনটির মালিক রেস্তোঁরায় গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করতে নিষেধ করেছিলেন।

তিনি বলেন, “পরে গ্রামের জমি বেচে টাকা এনে নয় লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে কিছুদিন আগে রেস্তোঁরাটিতে গ্যাসের সরবরাহ লাইন লাগান মালিক। দিনে-রাতে রেস্তোঁরাটি ভালোই চলত।”