‘মন্ত্রী এমপিরা পাবলিক বাসে চড়লে নিরাপত্তা দেবে কে?’

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন বলছেন, “আজকে সংগীতের সঠিক চর্চা হচ্ছে না। অর্থবহ সংগীত হচ্ছে না। এতেও শব্দ দূষণ হচ্ছে।”

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2023, 11:44 AM
Updated : 7 Feb 2023, 11:44 AM

মন্ত্রী-এমপিরা কেন প্রাইভেট কার ছেড়ে গণ পরিবহন ব্যবহার করতে পারেন না, তার একটি ব্যাখ্যা পাওয়া গেল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেনের কথায়।

মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক মতবিনিময় সভায় এ প্রসঙ্গ উঠলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, তারা পাবলিক বাসে চড়লে তাদেরকে নিরাপত্তা দেবে কে?

পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্প’ এর আওতায় আয়োজিত এই সচেতনামূলক মতবিনিময় সভায় সংরক্ষিত আসনের এই সংসদ সদস্য ছিলেন প্রধান অতিথি।

খোদেজা নাসরিনের আগে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান এ বিষয়ে বলেন, “১৯৯৫ সাল থেকে এই আন্দোলন করে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে হতাশ লাগে। আজকে ঢাকা শহরে প্রাইভেট কারভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখি। একটা রাস্তার ৭০-৮০ ভাগ গাড়ির দখল থাকে…।

“আমরা পরিবেশ আন্দোলন করি। অথচ আমাদের বাড়িতে এসি, গাড়িতে এসি, অফিসে এসি। আমাদের এমপি মন্ত্রী যারা, তারা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করেন না। কিন্তু আমরা প্রাইভেট কারকে বাদ দিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা হিসেবে না গড়ে তুলি, তাহলে এই বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ কমবে না।”

পরে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সেই প্রসঙ্গ ধরে কথা বলেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন।

তিনি বলেন, “আপনারা বলছেন যে এমপি মন্ত্রীরা বাসে চড়বেন। কিন্তু পাবলিক বাসে চড়লে তাদেরকে নিরাপত্তা দেবে কে? বাসে চড়লে আমাদের অনেকের রোষানলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ সবার দাবি-দাওয়া তো আমরা পূরণ করতে পারব না।”

শব্দ দূষণ রোধের জন্য টিভি স্ক্রলে, পাড়া-মহল্লায় জনসচেতনতা সৃষ্টি করার ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন যুব মহিলা লীগের এই নেতা।

তিনি বলেন, “যখন ড্রাইভারকে লাইসেন্স দেওয়া হবে, তখন তাদের শব্দ দূষণের বিষয়ে ট্রেনিং দিতে হবে। ট্রাফিক পুলিশকে আরও বেশি গুরুত্ব দিত হবে।”

শব্দ দূষণের জন্য কেবল গাড়ির হর্ন ও ভবন নির্মাণের সময় সৃষ্ট শব্দই না, শহরে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত বিভিন্ন কনসার্টকেও দায়ী করেন খোদেজা নাসরিন।

তিনি বলেন, “আজকে সংগীতের সঠিক চর্চা হচ্ছে না। অর্থবহ সংগীত হচ্ছে না। এতেও শব্দ দূষণ হচ্ছে। উচ্চস্বরে অর্থহীন যে সংগীত চর্চা হচ্ছে, তা অচিরেই বন্ধ করতে হবে।”

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, “বায়ু দূষণের পরেই হলো শব্দ দূষণ। ধীরে ধীরে আমরা একটা বধির জাতিতে পরিণত হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছি। একটু দেরি হলে ড্রাইভাররা এমন জোরে হর্ন বাজায়…। শব্দ দূষণের জন্য বেশি দায়ী এই ড্রাইভার। আমাদের উচিৎ, ড্রাইভার এবং গাড়ির মালিককে লাইসেন্স দেওয়ার সময় এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা।”

বিভিন্ন ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের অজুহাতে’ বিদেশে গিয়ে অর্থ খরচ না করে গাড়ির মানোন্নয়নের জন্য টাকা খরচ করার পরামর্শ দেন তিনি। 

“আমাদের এখানে কিছু একটা হলেই বিদেশে চলে যায়। এসবে টাকা খরচ না করে গাড়িতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, যাতে সীমার বাইরে শব্দ করলে সেখানে একটা সংকেত দেয় যে কোন গাড়ি শব্দ দূষণের জন্য দায়ী। অতিরিক্ত হর্ন দিলে সেটা যেন সিস্টেমে চলে যায় এবং তারপর ওকে শাস্তির আওতায় আনা যায়।”

শব্দ দূষণের জন্য ২০ শতাংশ মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছে এবং ৭১ শতাংশ মানুষ হতাশা ও উদ্বেগের মাঝে নিমজ্জিত হচ্ছে বলে তথ্য তুলে ধরেন আলমগীর কবির। তিনি বলেন, “মানুষের থেকে বন্যপ্রাণীর ক্ষতি বেষি হচ্ছে। আজকে এই শব্দ, বায়ু দূষণের ফলে পাখি কমে গেছে ঢাকায়।”

আইনগতভাবে হাইড্রলিক হর্ন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সেটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) অতিরিক্ত নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রবিউল আলম মনে করেন, শব্দ দূষণের জন্য পুলিশকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা উচিৎ না।

“পুলিশের কি শব্দ মাত্রা পরিমাপ করার যন্ত্র আছে? আমরা শব্দ দূষণ রোধে সাউন্ড ব্যারিয়ার দিতে পারি।”

আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সাবেক উপাচার্য স্থপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, শব্দ খারাপ না। তবে ভুল সময়ে, ভুল জায়গায় শব্দ করা হলে তা দূষণ হয়।

“সব দূষণ একই জায়গায় সৃষ্টি হয়। দূষণের উৎস মন। তাই দূষণ রোধে আমাদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে। আসলে আমাদের কালচারের মধ্যে দূষণ ঢুকে গেছে। গাড়ির হর্ন না দিলে রিকশা গাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আমাদের ড্রাইভাররা প্রত্যেকেই একেকটা বাঘ। নিজের অস্তিত্ব বর্ণনা করতে করতে রাস্তা দিয়ে যায়। তাই এগুলা হলো সোশাল ও সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টর। তাই আমাদেরকে সবার আগে উৎসটাকে মনিটরিং করতে হবে।”

অন্যদের মধ্যে স্ট্যামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার এবং উবারের পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রধান মোহাম্মদ আলী আরমানুর রহমান অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে জরিপ ও মতবিনিময় সভার কার্যক্রমে সার্বিক সহযোগিতায় করছে ইকিউএমএস কনসালটিং লিমিটেড এবং বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ণ কেন্দ্র (ক্যাপস)।