এ প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখন মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের জুলাই থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
Published : 23 Mar 2025, 06:47 PM
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার পানি শোধনাগারের একটি প্রকল্পের খরচ সংশোধন করে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা বাড়াল অন্তর্বর্তী সরকার।
রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প ফেজ-৩ এর দ্বিতীয় সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেক চেয়ারপারসন মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এই সভা হয়। পরে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, “এখানে আমরা সময় ব্যয় করেছি। এটা ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প। এটার সমস্যা হল, এটা ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে দুই পারসেন্ট। এই বছরের বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা।
“তার মানে হল, সবাই বোঝে বড় সমস্যা হচ্ছে, ঢাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে টেকসই সমাধান... এটা শেষ পর্যন্ত সমাধান হবে না।"
ভূগর্ভস্থ পানির সংকট এবং পানি শোধনের জন্য বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি থাকায় মূলত এ প্রকল্প সরকারের টেনে নিচ্ছে বলে ইঙ্গিত দেন উপদেষ্টা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, "এক সময় না একসময় এ ভূগর্ভস্থ পানি, এখনই তো অনেক নিচে কূপ খনন করতে হয়। এরপর তো আর পাওয়া যাবে না।
"কাজেই সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করতেই হবে। সারফেস ওয়াটার, যে কারণে খরচও করতে পারছে না, কিন্তু বিদেশি ঋণ অনেক কমিটেড আছে, বাংলাদেশি টাকাও অনেক, চার হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ ১১ হাজার কোটি টাকা।"
প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা থাকার পরও কেন অগ্রগতি হচ্ছে না, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, "বিরাট প্রকল্প, কিন্তু কিছুতেই কেউ প্রগ্রেস করতে পারছে না। কারণ কারো মাথায় ঢুকছে না প্রযুক্তিগতভাবে কী করতে হবে।"
এ প্রকল্প যখন নেওয়া হয়, তখন মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের জুলাই থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৫৯৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারই এক দফা এর খরচ বাড়ায়। প্রথম সংশোধন করে এর ব্যয় বৃদ্ধি করে প্রকল্পের খরচ ঠিক করা হয় ৭ হাজার ৫১৮ কোটি ৩ লাখ টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ প্রকল্পের আরও ৮ হাজার ৪৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা বাড়িয়ে প্রকল্পের সাকূল্যে ব্যয় ধরেছে ১৬ হাজার ১৪ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। মেয়াদ ঠিক করা হয়েছে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্পের খরচ বাড়লেও উপদেষ্টা এটিকে শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন দেওয়ার কথা বলেন। এ প্রকল্পের অগ্রগতি এবং নদীর পানির প্রাপ্যতা সময়ে সময়ে দেখে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তার ভাষ্য।
খরচ বাড়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, "সমস্যা হল যে বুড়িগঙ্গা থেকে নেওয়া যাবে না, কারণ বুড়িগঙ্গা এত দূষিত, এত ধরনের কেমিকেল এর মধ্যে মিশ্রিত, যে ওটার খরচ অনেক বেশি হবে।
"বুড়িগঙ্গাকে কি আবার রক্ষা করা যায়? পরিষ্কার করা যায়? এত সহজে না। তাহলে শীতলক্ষ্যা। বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যা যাওয়া হয়েছে। শীতলক্ষ্যার পানি সমানভাবে দূষিত। এগুলো ঠিক নরমাল দূষিত তা নয়। এগুলো বিভিন্ন বর্জ্য এবং কেমিকেলস, কেমিকেলসে শোধন করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল।"
ভিন্ন উৎসের ভাবনায় শেষ পর্যন্ত মেঘনা থেকে পানি আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, "মেঘনা হল নারায়ণগঞ্জের উত্তর দিকে। এখন মেঘনা থেকে পানি আনতে গেলে সমস্যা হল, এখানে জায়গা ঠিক করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার সাহারিয়া নামক স্থানে।
"মেঘনা নদীর ডান তীরে লাইন বসিয়ে শোধনাগার এবং ট্রিটমেন্ট করে সায়দাবাদ পর্যন্ত আনা। কিন্তু এটাও যে বসে আছে কারণ মেঘনা নদীর অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। মেঘনা নদীও মরে যাচ্ছে।"
তিনি বলেন, "তার ওপর আবার মেঘনার আশেপাশে অনেক কলকারখানা গড়ে উঠছে। যখন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে, বোধহয় অনেক সময় লাগবে। ততদিনে মেঘনা নদীও যদি সমান দূষিত হয়ে যায় আর যদি পানির সংকট দেখা দেয় তাহলে তো আবার সেই...।
"আমরা এই প্রকল্প পাস করে দিয়েছি আপাতত। যতদূর করছে ওখানে মেঘনা নদীর পাড়ে। সেখান থেকে এটা চলতে থাকুক। কিন্তু তার সঙ্গে মেঘনা নদী এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নদ-নদীর যে সিস্টেম এটা ঠিকভাবে কখনও গবেষণা করা হয়নি।"
পায়রা সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল ‘অর্থনীতির বিষফোঁড়া’
পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল প্রকল্পকে ‘অর্থনীতির বিষফোঁড়া’ আখ্যা দিয়ে এ প্রকল্পেরও শর্ত সাপেক্ষে দ্বিতীয় সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্ট।
এ প্রকল্পেরও ৯১১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে ৫ হাজার ৪২৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মূল প্রকল্প ছিল ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকার। আওয়ামী লীগ সরকার এক দফা এর ব্যয় বাড়িয়ে করেছিল ৪ হাজার ৫১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
তার ভাষ্য, "পায়রা সমুদ্র বন্দর বলা হলেও মূলত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আনতে এই বন্দর করা হচ্ছে। এটাকে সমুন্দ্র বন্দরতো দূরের কথা, নদী বন্দর বলা যায় না।
"বাণিজ্য উপদেষ্টাতো বলেছিলেন নদীর নাব্য হিসেবে এটাকে ঘাট বলা যায়। তবে এ প্রকল্পের জন্য প্রতিবছর ড্রেজিং করতে হবে। এতে প্রচুর অর্থ খরচ হবে। এটি বাদ দিয়ে প্লেনে কয়লা আনা যায়। যা হোক, ভুল প্রকল্প হলেও অনেক কাজ হয়েছে, অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই শেষ করতে হবে।"
সংস্কারের অংশ হিসেবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় যেসব কাজে হাত দিয়েছে তাও তুলে ধরেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, দুদিন আগে সরকারি ক্রয় আইনের সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে দরপত্রে ১০ শতাংশ দরপ্রস্তাবের সীমা বাদ যাচ্ছে। তাতে একক ঠিকাদার চক্রের কাজ পাওয়া বন্ধ হবে এবং সকল দরপত্র অনলাইনেই হবে। শতভাগ দরপত্র ইজিপিতে যুক্ত করতে হবে।
সেই সঙ্গে প্রকল্পের প্রকল্পের পরিকল্পনা খসড়া থেকে বাস্তবায়নের সকল পর্যায়ে অগ্রগতি, মূল্যায়ন, বিশেষজ্ঞ মন্তব্য যা আসে তা অনলাইনেই প্রকাশ করতে আইএমইডিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিনের সভায় এই দুই প্রকল্পসহ ২১ হাজার ১৩৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ের মোট ১৫টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে।
এরমধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৪ হাজার ১৯৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ছয় হাজার ৫৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৪০৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।