“যেহেতু ষড়যন্ত্রের অপরাধ বাংলাদেশে হয়েছে, এর বিচার বাংলাদেশে হতে পারে। একইসঙ্গে হত্যার অপরাধের বিচার হতে পারে ভারতে।”
Published : 03 Jun 2024, 01:28 AM
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে কলকাতায় ‘হত্যা’ করার পরিকল্পনা ঢাকায় বসে আঁটা হয়েছিল বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে; দুই দেশে ঘটা এই ‘নৃশংস’ হত্যাকাণ্ডের বিচার কীভাবে হবে তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলছেন, বিচার প্রক্রিয়াকে ‘হত্যার ষড়যন্ত্র’ এবং ‘হত্যা’র অপরাধ হিসাবে দুইভাবে ভাগ করা যেতে পারে।
“যেহেতু ষড়যন্ত্রের অপরাধ বাংলাদেশে হয়েছে, এর বিচার বাংলাদেশে হতে পারে। একইসঙ্গে হত্যার অপরাধের বিচার হতে পারে ভারতে।”
দুই বিচার একসঙ্গেই চলতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “ষড়যন্ত্রের বিচার বাংলাদেশে চলতে পারে, সমান্তরালে হত্যার বিচার চলতে পারে ভারতে, এখানে কোনো সমস্যা হবে না। কেননা, দুই অপরাধই পৃথক অপরাধ।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ যোগ দিয়ে এমপি আনার হত্যার তদন্ত, বিচার এবং ঘটনার ‘হোতা’ আখতারুজ্জামান শাহীনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরানোর প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দেন বিচারপতি মানিক।
ইংরেজি ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠানটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলেও দেখা যাচ্ছে।
যা যা ঘটেছে
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। প্রথমে কলকাতার বরাহনগরে তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন।
এরপর স্থানীয় থানায় জিডি করেন গোপাল বিশ্বাস। তদন্ত শুরু হয় দুই দেশে। ২২ মে সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে খবর আসে, নিউ টাউনের এক বাড়িতে খুন হয়েছেন এমপি আনার।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারতীয় পুলিশের দেওয়া তথ্যে বাংলাদেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডেও নেওয়া হয়।
ওই তিনজন হলেন- আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া (৫৬), তানভীর ভুঁইয়া (৩০) ও সেলেস্টি রহমান (২২)।
এছাড়া মঙ্গলবার যশোর থেকে সাইফুল আলম মোল্লা মেম্বার নামে আরেকজনকে আটক করে ডিবি। তাকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খুলনার শিমুল ভুঁইয়ার সহযোগী বলা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার ‘হোতা’ তার বাল্যবন্ধু ও ঝিনাইদহের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন মিয়া। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল। আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য নিউ টাউনে আখতারুজ্জামান শাহীনের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে।
তদন্তের এক পর্যায়ে জিহাদ হাওলাদার নামের এক কসাইকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডিকে জিহাদ বলেছেন, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই তিনি ‘সব কাজ’ করেছেন। আরও চারজন বাংলাদেশি এই কাজে সাহায্য করেছেন।
ভারতীয় গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল বাংলাদেশে এসে ২৪ মে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যান। এরপর ২৫ মে কলকাতায় যান বাংলাদেশের ডিবির তিন কর্মকর্তা। তারাও কসাই জিহাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাকে নিয়ে সেই বাড়ি ঘুরে দেখেন, যেখানে আনারকে হত্যার কথা বলা হচ্ছে।
ডিবি কর্মকর্তারা কলকাতায় অবস্থানকালে সঞ্জিভা গার্ডেনস নামের বিলাসবহুল ওই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের সেপটিক ট্যাংক থেকে বেশ কিছু মাংসের টুকরা উদ্ধার করা হয়।
ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পরে সেগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। এই ডিএনএ নমুনা মেলানোর জন্য রক্তসম্পর্কীয় স্বজন প্রয়োজন হয়। সেজন্য এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ভারতে যাওয়ার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রানধির জেসওয়াল সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বলেন, এ তদন্তে বাংলাদেশকে ‘পূর্ণ সহায়তা’ দেওয়া হবে।
“ভারত উভয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক্ষেত্রে সমন্বয় করছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য আদানপ্রদান করছে। চলমান তদন্তের অংশ হিসাবে আমাদের দিক থেকে সরকার বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে পূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন এবং বিস্তারিত তদন্তে ‘বিশেষ তদন্ত দল’ গঠন করেছে ভারতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এ ঘটনায় ২২ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এমপি আনারের মেয়ে ডরিন একটি মামলা দায়ের করেন, যেখানে তার বাবাকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের’ অভিযোগ আনা হয়। তবে আসামি হিসেবে সেখানে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
শনিবার ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের মামলা ভারতে হওয়ায় সেটার বিচারকাজ সেখানেই হবে।
“ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। কাজেই ভারত সরকারই এটা দেখবে, যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে তাদের দেশে। যেখানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, মূল মামলার তদন্ত তারাই করবেন। সেখানে যদি আমাদের সম্পৃক্ত করে আমরা সহযোগিতা করব।”
বিচার করবে কোন দেশ?
ভারত-বাংলাদেশ দুদেশের আইন অনুযায়ী দুদেশে পৃথকভাবে কিংবা কোনো একদেশে বিচার হতে পারে বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “দুই দেশেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা যতটুকু জেনেছি, ষড়যন্ত্রটা হয়েছে বাংলাদেশের ঢাকায়। এরপর আনারের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ষড়যন্ত্রের শেষ হয়েছে, যা ছিল ভয়াবহ রকমের নিষ্ঠুর ও নৃশংস।
“দুদেশের আইন অনুযায়ী বিচারটা বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতে হতে পারে। কিন্তু হত্যার বিচার হতে হবে ভারতে, তবে আসামি কাস্টডিতে থাকতে হবে। কেননা হত্যাকাণ্ডের পেছনে হোতা হিসাবে যে আখতাজ্জামান শাহীনের নাম বলা হচ্ছে, তাকে ফেরাতে হবে আমাদের।”
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় তাকে ফেরানোর চেষ্টা ভারতকেই করতে হবে বলে মত দেন ইমিগ্রেশন ও প্রত্যর্পণ আইনের এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সেই চুক্তি রয়েছে। কোনো অভিযুক্ত বা পলাতক আসামিকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে চুক্তিটা দরকার। যেহেতু ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, শাহীনকে হস্তান্তরের জন্য ভারত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আবেদন করতে পারে।”
নিজ দেশের নাগরিক হলেও যুক্তরাষ্ট্র শাহীনকে হস্তান্তর করতে পারে বলে মনে করেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
তিনি বলেন, “একটা প্রশ্ন আসতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র কি তার নিজ দেশের নাগরিককে প্রত্যর্পণ করতে পারে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ। একজন অভিযুক্ত যে দেশের নাগরিক সে দেশে থাকলেও তাকে প্রত্যর্পণ করা যায়। এটা সমস্যা নয়।
“কিন্তু যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে কোনো প্রত্যর্পণ চুক্তি নাই, সে কারণে বাংলাদেশের পক্ষে তাকে ফেরত আনা সম্ভব নয়। সেই দিক থেকে হত্যার বিচার হতে হবে ভারতে। কেননা শাহীনকে হাজির করা কেবল বিচারের উদ্দেশ্যে নয়, পাশাপাশি হত্যার তথ্য পাওয়ার জন্যও অত্যাবশ্যকীয়। সে কারণে ভারত কিংবা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে পেতে হবে তাকে।”
বিচার প্রক্রিয়াকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে– এমন মত দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারব বলেন, “ষড়যন্ত্রটাই একটা অপরাধ, এটাকে হত্যার অপরাধ থেকে আলাদা করা যেতে পারে।
“যেহেতু ষড়যন্ত্রের অপরাধ বাংলাদেশে হয়েছে, এর বিচার বাংলাদেশে হতে পারে। একইসঙ্গে হত্যার অপরাধের বিচার হতে পারে ভারতে। বাস্তবিক অর্থে দুই অপরাধের বিচার দুদেশেই হতে পারে। এক্ষেত্রে কোন অপরাধটার বিচার করা হবে, সেই প্রশ্নে একটা ছাড় দিতে হবে।”
‘মৃত্যুদণ্ড না দিতে বলতে পারে যুক্তরাষ্ট্র’
মৃত্যুদণ্ডের আইন আছে এমন দেশে পলাতক আসামিদের ফেরত পাঠাতে চায় না বিভিন্ন দেশ; শাহীনকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র সে পথে হাঁটতে পারে কি না, এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে।
উত্তরে তিনি বলেন, “অনেক দেশের প্রত্যর্পণ আইনে একটি বিধান রয়েছে যে, কোনো দেশের উচিত হবে না কোনো অভিযুক্ত বা পলাতককে এমন দেশে পাঠানো, যেখানে গেলে তাকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
“তবে গ্রহণকারী দেশ যদি এমন লিখিত দেয় যে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না, তাহলে সেই বিধান উৎরানো যেতে পারে।”
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “ভারতে মৃত্যুদণ্ড আছে কেবল এ কারণে একজন খুনিকে ফেরত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানানো হবে- তা কিন্তু নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে জোর দিতে পারে যে, দোষী প্রমাণ হলেও তাকে যেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হয়।
“এর বাইরে প্রত্যর্পণ আইনের আওতায় থাকা পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো পলাতক আসামিকে ফেরত দিতে বাধ্য। এই দিক বিবেচনায় আমরা বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভারতের কাছে ফেরত দেবে।”
জড়িতদের সবাই বাংলাদেশি, বিচারে কি জটিলতা হবে?
এমপি আনার ‘হত্যার’ সঙ্গে জড়িতদের প্রায় সবাই বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় ভারতে বিচারের ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “না। কেননা, খুনের সঙ্গে জড়িতরা বাংলাদেশের নাগরিক হলেও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে; ভারত তাদের সবাইকে ফেরত পাঠাতে বলতে পারে।
“বাংলাদেশ এক্ষেত্রে তাদেরকে (আসামিদের) সেখানে পাঠাতে অনাগ্রহী হবে না, বরং আগ্রহীই হবে। বিচার যদি ভারতে হয়, এক্ষেত্রে কোনো জটিলতা আমি দেখি না। আবার বাংলাদেশেও যদি বিচার হয়, কোনো সমস্যা হবে না।”
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় এমপি আনারের মেয়ে ডরিন তার বাবাকে ‘হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের’ অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু শুরুতে পরিবার বলেছিল, তিনি নিজে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছেন।
এই অবস্থায় অভিযোগ প্রমাণে কোনো অসুবিধা হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি মানিক বলেন, “না। কেননা প্রসিকিউশনকে কেবল এটাই প্রমাণ করতে হবে যে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে এসব বিষয় আর প্রাসঙ্গিক থাকে না। কেন তিনি ভারতে গেছেন, সেটা আর কারও দেখার বিষয় না।”
দ্রুত বিচার আইনে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরামর্শ দিয়ে সাবেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বলেন, “এই বিচারের ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি, বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেই দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। আমি আশা করি, এই মামলার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।”
সংসদীয় আসন শূন্য হতে ‘সময় লাগবে, সমস্যা হবে না’
এমপি আনারের মৃত্যুতে ঝিনাইদহ-৪ আসন শূন্য ঘোষণা করতে কিছু সময় লাগলেও তাতে কোনো জটিলতা হবে না বলে মনে করছেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা শুনেছি, একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে মাংসের টুকরা উদ্ধার করা হয়েছে, পাশাপাশি কিছু চুলও পাওয়া গেছে।
“এটা পুরো প্রেক্ষাপট পাল্টে দিয়েছে। এটা ছাড়া হয়তো হত্যার বিচার এগোনো অসম্ভব হত না, তবে কঠিন হত। এখন প্রশ্ন এগুলো কার মাংস, কার চুল? কার শরীর থেকে এই মাংস আর চুল এসেছে, তা নির্ধারণ করা জটিল কিছু নয়।”
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক বলেন, ডিএনএ এবং ফিঙ্গারপ্রিন্ট নির্ধারণের পদ্ধতির উন্নতির কারণে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা, এটা কার মাংস বা কার চুল তা নির্ধারণ করা এখন খুবই সহজ।
“যদি এমপি আনারের মেয়ের ডিএনএ এর সাথে মেলানো হয়, তা খুব সহজে জানা যাবে এগুলো আনারের শরীরের অংশ কি না। যখন এটা জানা যাবে, তখন তার খুনের বিষয় নিশ্চিত হওয়া এবং তার আসন শূন্য ঘোষণা করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সংসদের জন্য এটা অসুবিধা হবে না।”
এমপি আনারের মেয়ের সঙ্গে ওই মাংস বা চুলের ডিএনএ না মিললেও সংসদে ৯০ দিন অনুপস্থিতির কারণে স্পিকার যে আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারেন, সেই বিধান কার্যকরের সুযোগ থাকার কথা তুলে ধরেন মানিক।
তিনি বলেন, “আবার রাষ্ট্রপতিও এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চাইতে পারেন। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। এক্ষেত্রে কিছু সময় লাগতে পারে, কিন্তু কোনো সমস্যা হবে না।”
‘শাহীনকে ফেরানোর ক্ষমতা ইন্টারপোলের নেই’
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ইন্টারপোলের গঠন ও ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে তারা কোনো পলাতক আসামিকে প্রত্যর্পণ করতে পারে না। তবে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে।
“দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক শিক্ষিত ও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ প্রায় বলে থাকে, ইন্টারপোল একজন পলাতক আসামিকে ফেরত আনবে। তারা বলে কারণ, তারা ইন্টারপোলের গঠন ও সক্ষমতা সম্পর্কে জানে না। নিশ্চিতভাবে ইন্টারপোলের এত ক্ষমতা নেই…
“কারণ, কোনো দেশই বিদেশি এলিমেন্ট ইন্টারপোলকে এমনটা করতে দেবে না। এটা সেই দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘনের সমতুল্য। কোনো ব্যক্তিকে ফেরত আনা তো দূরে থাক, পৃথিবীর কোনো দেশে এমন আইন নাই যে, ইন্টারপোল কোনো ব্যক্তিকে আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।”
অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারপতি বলেন, “বাংলাদেশে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, কেননা আইন তাকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। যেমন ৫৪ ধারা কিংবা অন্য সংবিধির ফলে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোথাও ইন্টারপোলকে এমন কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।”
তবে কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে পালিয়ে গেলে তথ্য আদানপ্রদানের মাধ্যমে ইন্টারপোল সহযোগিতা দিতে পারে জানিয়ে বিচারপতি মানিক বলেন, “এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ জানে, শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের পালিয়ে গেছে এবং শাহীন সেদেশের নাগরিক।
“কিন্তু ভারত বা বাংলাদেশের পুলিশ জানে না যে, আসলে সে যুক্তরাষ্ট্রের পালিয়েছে কি না। যদি তাই হয়, তাহলে আমেরিকার কোন অঙ্গরাজ্যে আছে, তার ঠিকানা কী, সে আমেরিকার নাগরিক কি না-এগুলো ভারত বা বাংলাদেশের পুলিশ জানে না।”
এসব তথ্যের জন্য ইন্টারপোলের সহযোগিতা দরকার হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, “কারণ, এই তথ্যগুলো খুব প্রয়োজনীয়। শাহীনকে প্রত্যর্পণের আবেদন করার জন্য ভারতকে প্রথমে জানতে হবে, সে কোথায় আছে, তার ঠিকানা কি বা সে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক কি না।
“সেক্ষেত্রে এই তথ্যগুলো কেবল ইন্টারপোলই সরবরাহ করতে পারে। কেননা, পুরো পৃথিবীজুড়ে তার নেটওয়ার্ক রয়েছে।”
ইন্টারপোলের ভূমিকাকে ‘খাটো করে দেখা যাবে না’ মন্তব্য করে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “কিন্তু অন্য কোনো দেশ থেকে একজন পলাতক আসামিকে ইন্টারপোল ফেরত আনবে- এমনটা বলা একেবারে বাজে কথা। যারা এটা বলছে, তারা বাস্তবে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তাদেরকে ইন্টারপোলের স্ট্যাটাস, তাদের সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে হবে।”
তিনি বলেন, ইন্টারপোল মূলত পৃথিবীর অনেক পুলিশ বাহিনীর একটি সংগঠন। এটা জাতিসংঘের কোনো সংস্থা বা অঙ্গ নয়। তবে তারা ১৯৯৬ সাল থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক হিসাবে রয়েছে। অসংখ্য এনজিও জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক হিসাবে রয়েছে, ইন্টারপোল তাদের একটি। পর্যবেক্ষক হিসাবে সাধারণ অধিবেশনসহ বিভিন্ন সভায় ইন্টারপোল যোগ দিতে পারে।
মিডিয়া ট্রায়ালকে সবসময় ‘নিরুৎসাহিত করা উচিত’
এমপি আনার হত্যার তদন্ত চলার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উৎসাহী হয়ে সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি মানিবক বলেন, “এই ঘটনা খুবই নৃশংস, খুবই নিষ্ঠুর। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ খুব কমই আছে।
“সুতরাং গণমাধ্যমকে এটা প্রকাশ করা থেকে বিরত রাখা অসম্ভব। সে কারণে এটা কেবল বাংলাদেশে নয়, ভারতেও ঘটছে। আমি মনে করি, গণমাধ্যমে ফিরিয়ে রাখা এক্ষেত্রে খুব কঠিন। আবার কী ঘটছে, সেটা জানতে মানুষও খুব উৎসুক।”
মিডিয়া ট্রায়ালকে সবসময় ‘নিরুৎসাহিত করা উচিত’ বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে (আনার হত্যা) আমি গণমাধ্যমের এমন কোনো খবর দেখি নাই, যেটা ভবিষ্যতে বিচারকে প্রভাবিত করবে। সুতরাং আমি এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন নই।”
বিচার বিভাগে দুর্নীতি, মামলার দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের দুর্নীতির বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আদালতে দুর্নীতির বিষয়টি আমি অস্বীকার করতে পারছি না। তবে বর্তমান প্রধান বিচারপতি ও তার আগের প্রধান বিচারপতি বিষয়টিকে খুব কঠোরভাবে নিয়েছেন।
“তারা নিম্ন আদালতে দুর্নীতিপরায়ন ব্যক্তিদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সেটা খুব সফল হয়েছে। সেই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। আশা করি, এমন সময় আসবে যখন আমরা বলতে পারব, পুরো বিচারব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা হয়েছে।”
মামলায় দীর্ঘসূত্রতাকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে এ পরিস্থিতি উত্তরণের পরামর্শ দিয়েছেন বিচারপতি মানিক।
তিনি বলেন, যাই হোক না কেন, দেওয়ানি বা ফৌজদারি যে কোনো মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।
“আমাদের এমন মামলাও আছে এক নারীকে হত্যার বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়েছে ঘটনার ৩০ বছর পরে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। আইনি ভাষায় বলতে গেলে, জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড।
“তবে বিচারে দেরি হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। কেবল কোনো একটি কারণে বিচারে দেরি হয় না। একটি কারণ হচ্ছে, তদন্ত কর্মকর্তাকে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় বদলি, কোনো কোনো সময় তিনি অবসরে চলে যান, তবে তার সাক্ষ্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
অভিযুক্তদের হুমকিতে অন্য সাক্ষীদের আদালতে না আসাকে দেরির আরেকটি কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মানিক বলেন, “অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্টের মত পুলিশ প্রতিবেদন দিতে দেরি করেন। এটাও দেরির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।”
বিচারকদের বদলি এবং বিচারক সংকটকেও বিচারে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে দেখছেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
তিনি বলেন, “কোনো কোনো সময় বিচারকরা বদলি হয়ে যান। ফলে কোনো হত্যার বিচারে কমপক্ষে তিনজন বিচারক শুনানি নেন। এটাও দেরির একটা কারণ।
“বিচারক সংকটও রয়েছে। সবক্ষেত্রে আপনি দেখবেন, মাসের পর মাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছরের পর পর পদ খালি থাকে। বিচারক না থাকার কারণেও শুনানি হয় না।”