নিরাপত্তাহীনতায় আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেক চিকিৎসক-কর্মকর্তা এখনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা
Published : 17 Aug 2024, 01:40 AM
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর হামলা, ভাঙচুর, পদ দখলের প্রভাব থেকে বাইরে নয় দেশের চিকিৎসা অঙ্গনও।
দেশের বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত হাসপাতালে আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে, দাপট দেখা দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের।
বিভিন্ন হাসপাতালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনার ভাস্কর্য, ছবি, ম্যুরাল, চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে, নামফলকও তুলে ফেলা হয়েছে।
নিরাপত্তাহীনতায় অনেক চিকিৎসক-কর্মকর্তা কর্মস্থলে আসা বন্ধ রেখেছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
সরকার পতনের দশম দিনেও চলছে এসব কর্মকাণ্ড। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, নিপসমের পরিচালক মো.সামিউল ইসলামের অফিস কক্ষের নামফলক ভেঙে ফেলেন একদল চিকিৎসক।
এ বিষয়ে জানতে সামিউলের মোবাইলে কল দিলে তিনি ধরেননি।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী একজন চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুপুর ১২টার দিকে একদল লোক ডিরেক্টর স্যারের রুমে গিয়ে স্যারের খোঁজ করেছেন। স্যার ওই সময় রুমে ছিলেন না। অন্য একটি রুমে ছিলেন। তারা কিছুক্ষণ চিৎকার, চেঁচামেচি করে। স্যারের নেমপ্লেট ভেঙে চলে যায়।”
সেখান থেকে বের হয়ে মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালকের অফিস ভাঙচুরের চেষ্টা করে একই লোকেরা।
ইনস্টিটিউটের পরিচালক কাজী শফিকুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সে সময় আমি অফিসেই ছিলাম। একদল লোক মিছিল করে এখানে আসে। তারা জোর করে আমার অফিসে ঢোকার চেষ্টা করে। তবে আমাদের স্টাফরা ঢুকতে দেয়নি। যাওয়ার আগে আমার নেমপ্লেট ভেঙে দিয়ে যায়।”
গত ৫ অগাস্ট ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক চিকিৎসক ও কর্মীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ভাঙচুর করে, শেখ হাসিনার নামফলক নামিয়ে ফেলে। প্রথম দুয়েকদিন কয়েকজন চিকিৎসক হাসপাতালে আসেননি। এখন মোটামুটি সবাই আসছেন বলে জানিয়েছেন একজন চিকিৎসক।
“প্রথমদিন অতি উৎসাহীরা কিছু ঝামেলা করেছিল। আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকরাও প্রথম দুদিন হাসপাতালে আসেননি। এখন আসা শুরু করেছেন। আমাদের স্যাররা খুবই আন্তরিক, এখন মোটামুটি সব ঠিক হয়ে গেছে”, বলেন এক চিকিৎসক।
ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান নিটোরেও আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকরা রোষের শিকার হয়েছেন।
৬ অগাস্ট ওই হাসপাতালের পরিচালকসহ কয়েকজন চিকিৎসকের অফিসকক্ষের নামফলক তুলে ফেলে বিএনপি ও জামায়াত অনুসারী চিকিৎসক, কর্মচারীরা।
সরকার পতনের পর কয়েকদিন অনেক চিকিৎসক অফিসে আসেনি।
পরিস্থিতি এখন ভালো আছে বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শুরুতে একটু ঝামেলা হয়েছিল। আমিও তিনদিন অফিসে আসিনি। এখন পরিস্থিতি শান্ত। আমরা অফিস করছি।”
প্রবল গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ অগাস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের। সেদিন থেকেই সারা দেশে সরকারি বেসরকারি স্থাপনা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী সমর্থকদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিপণিকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট শুরু হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনায় দেশে বড় বড় বিক্ষোভ।
এর বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা, সাংবিধানিক, সরকারি এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে বদল আসছে।
সরকার পতন আন্দোলনের ডাক দেওয়া সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণমাধ্যম কর্মীদের তালিকা করার পর বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সেই তালিকায় থাকা কয়েকজনকে চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে।
তবে স্বাস্থ্যখাতে এই ধরনের ঢালাও পরিবর্তন এখনও দেখা যাচ্ছে না, যদিও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন বিএনপি-জামায়াত অনুসারীরা।
বিএসএমএমইউতে এখনও উত্তেজনা
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়েছে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বিএসএমএমইউতে।
সরকার পতনের দাবিতে ডাকা অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিন ৪ অগাস্ট শাহবাগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন হাসপাতালে ঢুকে যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভাঙচুর পর করা হয় বিভিন্ন স্থাপনা।
পরের দিন সরকারের পতন হওয়ার দিনও বিএসএমইউতে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এ ব্লকের হোস্টেল থেকে চিকিৎসকদের বের করে দেওয়া হয়।
ভিসিসহ কর্মকর্তাদের অফিসকক্ষে তালা দেওয়া হয় সেদিন। সে সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসক, কর্মচারীদের একটা অংশ আত্মগোপনে চলে যান।
চিকিৎসকদের একটা অংশ হাসপাতালে আসা শুরু করলেও উপাচার্য এখনও অফিসে আসছেন না।
স্বাচিপের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত একজন চিকিৎসক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত রোববার থেকে অফিসে যাওয়া শুরু করেছি, কিন্তু এখনও বিব্রতকর অবস্থায় আছি। চিকিৎসকদের অনেকে এখনও অফিসে যাচ্ছেন না। ভিসি স্যার অফিসে যাচ্ছেন কম, বৃহস্পতিবারও অফিসে যাননি।”
আরেকজন চিকিৎসক বলেন, “৪ অগাস্টের পরই আমাদের অফিসের পরিস্থিতি বাজে হয়ে যায়। আমি চেয়ারম্যান স্যারকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম যাব না।
“আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কোনোকিছুরই ঠিক ছিল না। কে কোনদিক থেকে কী করে ফেলে! পরে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরাই আমাকে ফোন করে বলেছে কোনো ধরনের ঝামেলা হবে না। পরে ৮ তারিখ থেকে অফিসে যাচ্ছি।”
সরকার পতনের তিন দিনের মাথায় ৮ অগাস্ট বিএসএমএমইউর ১৭৩ জন ‘বঞ্চিত’ চিকিৎসককে পদোন্নতি দেওয়া হয়। উপাচার্যের বাসায় গিয়ে সেই আদেশে সই নিয়ে আসেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকদের পদোন্নতির পর কর্মচারীদের আন্দোলন এখনও চলছে। বৃহস্পতিবারও উপাচার্য, উপ উপাচার্যসহ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের দাবিতে মিছিল হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিএনপি সমর্থক কর্মচারীদের দুটি পক্ষ উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের পক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে উপাচার্য দীন মোহাম্মদ নুরুল হক এবং রেজিস্ট্রার এবিএম আবদুল হান্নানের মোবাইলে কল দিলেও তারা ধরেননি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ বাইরে
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. নওশাদ আলী স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটি সাংগঠনিক সম্পাদক-১ পদে আছেন। গত ৫ অগাস্টের পর তার কার্যালয়ের সামনের ফটোগ্যালারি ভাঙচুর করা হয়। এরপর থেকে তিনি আর অফিসে যেতে পারছেন না।
নওশাদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিএনপি-জামায়াতপন্থি চিকিৎসকরা ভাঙচুর করেছে, তাদের সঙ্গে বাইরের লোকজনও আছে।
“আমি অফিসে যেতে পারছি না। আমাদের চিকিৎসকও আছে, কিন্তু সমস্যা হলো তারা বাইরের লোকজন নিয়ে এসেছে, এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ড্যাবের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যেতে।”
সরকার পতনের পর থেকে হাসপাতালে যেতে পারছেন না স্বাচিপের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. রকিব সাদী। গত রোববার হাসপাতালে যেতে চাইলেও ধাওয়া খেয়ে চলে আসেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিরেক্টর স্যার বললেন কয়েকদিন ছুটি নিতে। এখন পাঁচদিনের ছুটিতে আছি। এর মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হলে, ছুটি শেষ হলে অফিসে যাব।”
অস্বস্তি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও
৫ অগাস্টের পর থেকে বিএনপি সমর্থক চিকিৎসক, কর্মচারীরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মিছিল থেকে শুরু করে নানা কর্মসূচি পালন করছে।
সরকার পতনের পর অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবিএম খুরশীদ আলম অফিসে এলেও এখন আর তিনি যাচ্ছেন না।
মহাপরিচালক ও ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাদের অপসারণসহ দুই দফা ২ দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে ‘বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার’ নামে একটি সংগঠন।
এই দাবিতে মঙ্গলবার সকাল থেকে মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মূল ফটকে অবস্থান নেয় তারা। দ্রুত এসব দাবি মানা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচিতে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
এরপর অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দেন খুরশীদ আলম। অন্যান্য কর্মকর্তাদের অনেকেও আসছেন না, আসলেও কিছু সময় অফিসে থেকে চলে যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মচারী বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিজি স্যার মঙ্গলবার থেকে আসেন নাই। মন্ত্রণালয়ে মিটিং থাকলে যান বলে শুনেছি। বড় স্যারদের অনেকেই অনুপস্থিত।”
দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়ে চাইলে এবিএম খুরশীদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত কয়েকদিনে চিকিৎসক, কর্মচারীদের হাজিরা কিছুটা কমেছে।
“চিকিৎসক, কর্মচারীদের হাজিরা নিয়মিত মনিটর করা হয়। তাতে দেখা যাচ্ছে গত কয়েকদিন উপস্থিতি কিছুটা কম। লোকজন ভয়ে আসে না, এক্ষেত্রে উপস্থিতি বাড়াতে হলে যারা এখন নেতৃত্বে আছেন তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”
ড্যাবের সভাপতি হারুন আল রশীদ বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনো চিকিৎসককে কোনো ধরনের হয়রানি, হুমকি না দিতে আমরা সারাদেশে চিঠি দিয়েছি। কোনোভাবেই যেন চিকিৎসাসেবা ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
তার দাবি, যেসব চিকিৎসক গত ১৫ বছর নানা ধরনের ‘অরাজকতা’ করেছেন, তারাই ভয়ে হাসপাতালে আসছেন না।
“তাদের শত আশ্বাস দেওয়ার পরও আসছে না। আমি একটা ঘটনাও দেখিনি আমাদের ডাক্তাররা প্রতিপক্ষ চিকিৎসককে হামলা করেছে, হুমকি দিয়েছে। কেন আসে না সেটা আপনারাও ভালো করে জানেন।
“তারা বহু চিকিৎসককে টর্চার করেছে। তবে যেটুকু ভয় ছিল সেটাও ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। কারণ, এখন পর্যন্ত কোনো ট্রান্সফার, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তার মানে এখনও তারা ভালো আছেন।”