পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়েছে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে।
Published : 15 Sep 2024, 06:15 PM
আর্থিকসহ অন্যান্য খাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা জানার পাশাপাশি এক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দলের বৈঠকে এ আলোচনা হওয়ার কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
বৈঠকের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এক ব্রিফিংয় তিনি বলেন, “প্রথম আশ্বাস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে তারা কাজ করতে চান, সেটার প্রতিফলন হিসাবে সরকার গঠনের দ্বিতীয় মাসের প্রথমেই তারা এ প্রতিনিধি দলটি পাঠিয়েছেন।
“দ্বিতীয়ত, আমরা আর্থিক সংস্কারের জন্য যে সমস্ত খাতকে চিহ্নিত করেছি, এই সবগুলো বিষয়ে তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।”
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফরে যুক্তরাষ্ট্রের ছয় সদস্যের এই প্রতিনিধি দল শনিবার ঢাকায় এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু।
রোবরার সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর অর্থ ওবাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে মার্কিন প্রতিনিধি দল। এরপর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা।
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০ কোটি ডলারের সহায়তার বিষয়ে চুক্তি সই হয়।
দুপুরে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ব্রিফিংয়ে এসে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম।
তিনি বলেন, “ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই নতুন বাংলাদেশ সূচিত হওয়ার পর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকার ইতোমধ্যে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, সে সমস্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা এই প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেছি।
“যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার তারা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।”
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এই সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় আর্থিক খাত ও রাজস্ব খাতের সংস্কার, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ক্ষেত্র, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শ্রমপরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করেছি।”
পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর কৌশল নিয়ে আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “আমরা ব্রডলি আর্থিক খাতের সংস্কারের ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছি এবং যে বিষয়টা আপনি উল্লেখ করেছেন, অর্থ পাচার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে এক্সপার্টিজ আছে, সেটা হয়ত আমরা ব্যবহার করব; আলাপ আলোচনাটা শুধুমাত্র শুরু হয়েছে, এটার চূড়ান্ত হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।”
বিকালে গভর্নরের সঙ্গে মার্কিনি প্রতিনিধি দলের বৈঠকে আর্থিক খাতের সংস্কার ও অর্থপাচার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের মধ্যাহ্নভোজ সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
এসব আলোচনাকে নিকট ভবিষ্যতে ‘অর্থবহ সম্পৃক্ততার ভিত্তি’ হিসাবে বর্ণনা করে পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন বলেন, “সামনে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়ত এই আলোচনাটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।”
ইউএসএআইডি’র পক্ষ থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা ছাড়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার অন্য কোনো বিষয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের কোনো সদস্য।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়বস্তু তুলে ধরে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক ফেইসবুক পোস্টে বলেছে, “প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাতকালে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন আমাদের প্রতিনিধিদল।
“যেহেতু বাংলাদেশ আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত।”
অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে দূতাবাস বলেছে, “বাংলাদেশের নব উদ্যমে প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়াকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করব।
“এ লক্ষ্যে শীর্ষ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের সাথে আলাপে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও টেকসই উন্নয়নকে ঘিরে তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে আমাদের সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে।”
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে তাদের আরেকটি পোস্টে বলা হয়, “আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
‘শিডিউল মিললে’ দেখা হতে পারে ইউনূস-বাইডেনের
সময় মিললে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাক্ষাতের সম্ভাবনার কথা বলেছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে তাদের মধ্যে কোনো বৈঠকের বিষয় চূড়ান্ত হয়েছে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যান, সাধারণত তিনি কোনো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন না, এখন পর্যন্ত সেটা আমরা জানি।
“সেক্ষেত্রে, আমি যতটুকু জানি, রিসেপশন ধরনের হয়ে থাকে। যদি দুপক্ষের শিডিউল মেলে তাহলে হয়ত সেখানে দেখা হওয়া একটা সম্ভাবনা আছে।”
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে আজকে আমার সাথে এই বৈঠকে আলোচনা হয়নি।”
শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয় টেনে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “শ্রম আইন নিয়ে আমরা যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছি, সে পদক্ষেপ সম্পর্কে তাদেরকে বলেছি এবং যে পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে তারা নোট নিয়েছেন। এগুলোকে তারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসাবে স্বীকৃতি দেন; তবে, এক্ষেত্রে আলোচনা অব্যাহত থাকবে।”
র্যাবের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “সাধারণভাবে আমরা র্যাবের সংস্কার নিয়ে যে সমস্ত কাজকর্ম করছি, সেগুলো তুলে ধরেছি সেটা তাদেরকে অবহিত করেছি, এই আলোচনা চলমান থাকবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে জিএসপি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা তুলে ধরে সচিব বলেন, “জিএসপি নিয়ে সাধারণ একটা আলোচনা হয়েছে এবং এটার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে কথা হয়েছে।”