বিধি লঙ্ঘনের তথ্য প্রকাশ পেলেও নির্বাচন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশন স্বপ্রণোদিতভাবে কখনই ব্যবস্থা নেয় না বলে ভাষ্য সংস্থাটির।
Published : 06 May 2024, 06:25 PM
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১১৭ জন কোটিপতি লড়াই করছেন বলে জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।
আগামী বুধবার ১৫০টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তার দুদিন আগে সোমবার ধানমন্ডিতে নিজেদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ১৪৪ উপজেলার প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে টিআইবি।
সংস্থাটির পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৫৬০ চেয়ারম্যান প্রার্থীর মধ্যে ৯৪ জনই কোটিপতি। এছাড়া ৬১১ ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৭ জন ও ৪৩৫ জন নারী ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে ৬ কোটিপতি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
প্রথম ধাপের ভোটে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান হিসেবে অংশ নেওয়াদের ৫৬ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী বলে জানান তিনি।
আইনিসীমার বাইরে জমির মালিকানা ১০ জনের
ষষ্ঠ ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে যারা চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্তত ১০ জনের আইনসীমার বাইরে অর্থাৎ ১০০ বিঘা বা ৩৩ একরের বেশি জমির মালিকানা রয়েছে বলে জানিয়েছে টিআইবি।
তাদের মধ্যে আছেন বান্দরবান সদর উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী এ কে এম জাহাঙ্গীর, তার সম্পত্তির পরিমাণ ৭৪ দশমিক ২৭ একর; এরপর আছেন যথাক্রমে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, তার সম্পত্তির পরিমাণ ৫৮ দশমিক ৯৮ একর; লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল ওয়াহেদ, সম্পত্তির পরিমাণ ৫১ দশমিক ৭২ একর; রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী আনোয়ারুল ইসলামের সম্পত্তির পরিমাণ ৫১ দশমিক ৬৭ একর; পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী কাজী আনিছুর রহমানে সম্পত্তি ৫১ দশমিক ০৮ একর; লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী জামসেদা জাং চৌধুরীর সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ দশমিক ০৬ একর; কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থী হাবিব উল্লাহর সম্পত্তি ৪০ দশমিক ৫ একর; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চেয়ারম্যান প্রার্থী আরিফুল আলম চৌধুরীর সম্পত্তির পরিমাণ ৪০ দশমিক ০১ একর।
সংসদ সদস্যর ১৩ স্বজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী
সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তা উপেক্ষা করে প্রথম ধাপের ভোটে ১৩ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানিয়েছে টিআইবি।
এদের মধ্যে রয়েছেন সংসদ সদস্যের ছেলে, চাচাতো ভাই, খালাতো ভাই, জামাতা, ভাইয়ের ছেলে, ভাই ও চাচা রয়েছেন।
এর মধ্যে তিন সংসদ সদস্যের ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করছেন। এর মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের পুত্র আসিবুর রহমান, নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলায় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক চৌধুরী এবং বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন প্রার্থী হয়েছেন।
‘পদক্ষেপ নেওয়ার দৃষ্টান্ত নেই’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “হলফনামা বিশ্লেষণ করে সম্পদ এবং আয়ের যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলোই আসলে পর্যাপ্ত কি না সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই যে তথ্য প্রকাশের সুযোগটা আমরা আইনগতভাবে পেয়েছি বাংলাদেশে, সেটির যে মূল লক্ষ্য সেটা অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা শুধু জানতে পারছি, কিন্তু কার্যকর কোনো কিছু পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে না।
“যাদের উপর দায়িত্ব; নির্বাচন কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্তু তাদের ভূমিকা স্বপ্রণোদিত ভাবে কখনই পালন করে না। তথ্য প্রকাশের পর তারা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন, এরকম কোনো দৃষ্টান্ত নেই।”
হলফনামা বিশ্লেষণ করে আরও কিছু পর্যবেক্ষণও তুলে ধরেছে টিআইবি-
>> ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
>> উপজেলা নির্বাচন দলীয় হলেও নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দিতামূলক করতে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কোনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি। এতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থনপুষ্ট।
>> বিএনপি এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলটি স্থানীয় প্রার্থীদের আটকাতে পারেনি। আগ্রহী প্রার্থীরা স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
>> উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে রাজনৈতিক লড়াই হবার কথা থাকলেও সেখানে দলগত অবস্থান প্রায় শূন্য।
>> স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ জাতীয় নির্বাচনের তুলনায়ও কম। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে নারী প্রার্থী আছেন মাত্র ২৫ জন।
>> জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ৫৬ শতাংশ।
>> চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৯ দশমিক ৮৬ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
>> নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫২ দশমিক ২২ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী/ গৃহস্থালী কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন।
>> গৃহিণী বা গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৯ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে, কৃষি থেকে আয় আসে ১৫ শতাংশের, আয় নেই ১২ শতাংশের, ৩৯ শতাংশ নিজেদের আয়ের কোনো স্বীকৃত উৎস দেখাননি।
>> সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪০ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে। অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী।
>> প্রায় ৯৩ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার নিচে, বাকি ৭ শতাংশ প্রার্থীর সম্পদ কোটি টাকার বেশি। দ্বিগুণ হয়েছে কোটিপতি প্রার্থীর সংখ্যা।
>> ২৩ দশমিক ৪১ শতাংশ প্রার্থীর ঋণ বা দায় রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫২৮ কোটি টাকার ঋণ বা দায় রয়েছে সিলেটের বিশ্বনাথের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আকুদ্দুছ আলীর।
>> প্রার্থীদের ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশের নামে মামলা আছে।