“তাদের আদালতে হাজির করা হলে তারা স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত হন,” বলেছেন প্রসিকিউশন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আনিসুর রহমান।
Published : 20 Sep 2024, 10:05 PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আমিনুল ইসলাম তাদের ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করলে তারা স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিতে সম্মত হন।
প্রসিকিউশন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আনিসুর রহমান বলেছেন, বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঢাকার মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেন ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি গ্রহণ শুরু করেন।
জবানবন্দি গ্রহণ শেষে ছয় ছাত্রকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক, রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাদের কারাগারে উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়, বলেছেন আনিসুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, জুমার নামাজ শেষে দুপুর ২টার দিকে আদালতে আসেন মহানগর হাকিম সাদ্দাম হোসেন।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ফলাফল সম্পর্কে ছয় ছাত্রকে বোঝানো হয় এবং জবানবন্দি দেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করার জন্য তাদের কয়েক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় বলে তথ্য দিয়েছেন আনিসুর রহমান।
ছয়জনের মধ্যে জালাল মিয়া ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও হল ছাত্রলীগের সাবেক (সদ্য পদত্যাগকারী) উপ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের চলাকালে তিনি ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগে করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিগুলোতে সক্রিয় ছিলেন।
আহসান উল্লাহ ছিলেন ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং হল ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক উপ-সম্পাদক।
আল হোসাইন সাজ্জাদ ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
সুমন মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্র।
মুত্তাকীন সাকিন শাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এবং ওয়াজিবুল আলম সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে এক বার্তায় বলা হয়েছে, তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে, যেখানে আট শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
আটজনের মধ্যে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ কবির এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আবদুস সামাদ এখনও গ্রেপ্তার হননি।
তোফাজ্জলকে যেভাবে হত্যা করা হয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথি কক্ষে বুধবার রাতে ৩২ বছর বয়সি তোফাজ্জল হোসেন নির্যাতনের শিকার হন।
রাত ১২টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থী ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, তোফাজ্জলকে মারধরের আগে তাকে ভাত খাওয়ানো হয়, তখন তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভাত খেতে তার কেমন লাগছে।
খবর রয়েছে, ভাত খাওয়ানোর আগে-পরে তোফাজ্জলকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে এর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি উঠেছে।
তোফাজ্জলকে ধরে মারধর করা হচ্ছে, জানতে পেরে তার মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রের নম্বর ফোন দিয়ে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। সে যে মানসিক ভারসাম্যহীন, তা তাদের বলেছিলেন তানিয়া। তবে তারা শোনেননি।
তানিয়ার অভিযোগ, এরপর তাকে আরও বেশি করে মারধর করা হয়।
তোফাজ্জলের স্বজনেরা বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে এসেছিলে মরদেহ নিতে। তারা বলছেন, হলের ছাত্ররা তোফাজ্জলের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে তাদের ফোন করে তার মুক্তির জন্য টাকা চেয়েছিল। আর তার কেন এত নম্বর মুখস্থ, সেজন্য আরও মারধর করে।
মধ্যরাতে যখন তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছে। তার শরীরে ছিল মারধরের অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন।
ঢাকা মেডিকেল মর্গে নিহতের লাশ ময়নাতদন্তের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী গোলাম মোকলেসুর রহমান বলেন, নিহতের সারা শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
জীবনের করুণ কাহিনী
তোফাজ্জলের জীবনের কাহিনি বেশ করুণ।
মর্গে আসা মামাত বোন আসমা আক্তার তানিয়া বলেন, “দুই ভাই আর বাবা-মা মিলে ছিল তোফাজ্জলদের সুখী পরিবার। আট বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তোফাজ্জলের বাবা মারা যান। পাঁচ বছর আগে মারা যান তার মা।
“ওর মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। তখন তার বড় ভাই পুলিশের এসআই নাসির হোসেন তোফাজ্জলকে দেখেশুনে রাখতেন, মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতেন। সেই ভাইও গত বছর রোজায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর থেকেই ওকে দেখার আর কেউ নাই। ও পথে পথে একেবারে উন্মাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।”
তানিয়া বলেন, তারা তোফাজ্জলকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাকে ধরে বেঁধে কোথাও নেওয়া যায় না বলে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। সবশেষ তাকে যেদিন পাবনার মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার কথা ছিল, সেদিন সকালে শিকল ভেঙে পালিয়ে যান তিনি।
এরপর ঢাকায় সে এখানে ওখানে থাকতেন, ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন।
তানিয়া বলেন, “৫ তারিখ (৫ অগাস্ট) রাজু ভাস্কর্যের সামনে যখন টেলিভিশনগুলো লাইভ চলছিল তখন সে বারবার সামনে আসছিল। সে সাক্ষাৎকার দিতে চায়। ওর সেই ভিডিও আমরা দেখছি।”
তোফাজ্জলদের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বরিশাল বিএম কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স করলেও মানসিক সমস্যার কারণে কোনো কাজকর্ম করছিলেন না।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই ঘুরে বেড়াতেন। বুধবার রাতে কোনো এক পর্যায়ে চলে যান ফজলুল হক হলে। মোবাইল ফোন চুরির কারণে হলের বেশ কয়েকজন ছাত্র উত্তেজিত ছিলেন। তাকে দেখে জেরা করতে থাকেন তারা।