বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই, ভারতের সঙ্গে রয়েছে, বলেন তিনি।
Published : 04 Jun 2024, 09:29 PM
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার অন্যতম সন্দেহভাজন সিয়াম হোসেনকে নেপাল কর্তৃপক্ষ যদি ভারতের কাছেও হস্তান্তর করে, তাতেও তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেছেন, “যদি একই অপরাধের ক্ষেত্রে দুই দেশ একজনকে দাবি করে, তবে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে নেপাল বিবেচনায় আনবে অপরাধের ধরনটা কী। হত্যা মামলা কোথায় হয়েছে। নেপাল বিভিন্ন বিবেচনা করার পর সিদ্ধান্ত নেবে সিয়ামকে কোন দেশের কাছে হস্তান্তর করবে।”
এমপি আনার হত্যার তদন্তে হারুনের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল গত শনিবার নেপালে যায়। সেখান থেকে ফিরে মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন হারুন।
তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের ‘প্রধান পরিকল্পনাকারী’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীন নেপাল হয়েই যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন।
“সে বিষয়ে আমাদের তথ্য সংগ্রহের বিষয় ছিল। পাশাপাশি এই হত্যা মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন সিয়াম এখন নেপালে গ্রেপ্তার হয়ে দেশটির কর্তৃপক্ষের হেফাজতে রয়েছে। ঢাকার পুলিশ এ দুইজনকেই দেশে ফেরানোর চেষ্টা করছে।”
গত ১১ মে চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনার। তার বন্ধু স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস কলকাতায় জিডি করার পর দুই দেশে তদন্ত শুরু হয়।
এরপর ২২ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এমপি আনারকে কলকাতার এক বাড়িতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় পুলিশের দেওয়া তথ্যে দেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই তিনজন হলেন- আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া, তানভীর ভুঁইয়া ও সেলেস্টি রহমান।
দুই দফা রিমান্ডের পর তানভীর ভুঁইয়া ও সেলেস্টি রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
আনার হত্যাকাণ্ডের খবরের দিনই তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন শেরেবাংলা নগর থানায় তার বাবাকে খুনের উদ্দেশে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে কলকাতায় দায়ের করা হয় হত্যা মামলা।
পুলিশ বলছে, এমপি আনার হত্যার ‘হোতা’ তার বাল্যবন্ধু ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ঝিনাইদহের আখতারুজ্জামান ওরফে শাহীন মিয়া। আর হত্যাকাণ্ডটি বাস্তবায়ন করেছেন চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা ওরফে শিমুল। আনার কলকাতায় যাওয়ার পরদিন বৈঠক করার জন্য আখতারুজ্জামানের ভাড়া বাসায় যান। সেখানেই আসামিরা তাকে হত্যা করে।
আনারের লাশ না মিললেও কলকাতার ওই বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে মাংসের টুকরা উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সেগুলো ভারতের কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
তদন্তের অংশ হিসেবে কলকাতা ঘুরে আসার পর নেপালে যায় বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশের প্রতিনিধি দল। তারা নেপালে থাকতেই সেখানে সিয়ামের আটক হওয়ার খবর আসে।
পুলিশের ভাষ্য, আনার হত্যার হোতা আক্তারুজ্জামান শাহীনের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন সিয়াম। তার বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনে।
আনার খুন হওয়ার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সিয়াম ঘটনার পর নেপালে পালিয়েছেন বলে তাদের ধারণা।
পুলিশের আবেদনে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মাহবুবুল হক গত রোববার সিয়ামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেন।
কী প্রক্রিয়ায় সিয়ামকে ফেরানো হবে, কোনো জটিলতা আছে কী না– এমন প্রশ্নে ডিবি কর্মকর্তা হারুন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। তবে আমরা কাঠমান্ডু পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। সিয়াম ভারতের পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড। ভারতের সঙ্গে নেপালের বন্দি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। নেপাল যদি ভারত কিংবা বাংলাদেশের যে কোনো একটি পক্ষের কাছে সিয়ামকে হস্তান্তর করে, তাহলে তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না।”
আখতারুজ্জামান শাহীনকে ফেরানোর বিষয়ে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্নও করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে হারুন বলেন, “হত্যাকাণ্ডের পর তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি ডেস্কের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। শাহীন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, তাই ইন্টারপোলকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।”
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি না থাকলেও ভারতের সঙ্গে তেমন চুক্তি থাকার বিষয়টি তুলে ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ভারতও শাহীনকে ফেরাতে ভূমিকা রাখবে। কারণ কলকাতায় হওয়া হত্যা মামলার আসামি শাহীন, ভারতের কাছেও শাহীন মোস্ট ওয়ান্টেড। আর শাহীনকে বাংলাদেশে ফেরাতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে আমরা আলোচনা করব।”
নেপালে এ মামলার তদন্তে কী অগ্রগতি হল জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বলেন, “এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের পর মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন ভারত থেকে নেপালের কাঠমান্ডু গিয়ে অবস্থান করেন। সেখান থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান।
“শাহীনের সহযোগী সিয়ামও কাঠমান্ডু গিয়ে আত্মগোপন করে। সিয়াম কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছে এমন খবর পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখার মাধ্যমে নেপালের পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়। ঢাকার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিয়ামকে গ্রেপ্তার করে কাঠমান্ডুর পুলিশ।
হারুন বলেন, “ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। এই মামলায় আমাদের ও ভারতের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। দুই দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা কাজ করছেন এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আমরা তাদের সঙ্গে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান করছি।
“সিয়ামকে ভারতের পুলিশের কাছে দিলে আমাদের তদন্তে কোনো সমস্যা হবে না। মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের ঘনিষ্ঠ ও কাছের মানুষ সিয়াম। সিয়ামকে যদি ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয় তাহলে আলামত উদ্ধারের ক্ষেত্রে সে ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে। আমরাও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারব।”
আনার হত্যা: জবানবন্দিতে তানভীরের 'স্বীকারোক্তি
এমপি আনার হত্যা: সিয়ামের বিরুদ্ধে পরোয়ানা
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময় অপরাধ করে নেপালে পালিয়ে যাওয়া নিয়েও সে দেশের পুলিশের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বলে জানান হারুন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে অপরাধ করে অনেকে অপরাধী নেপালে চলে যায়। রুট হিসেবে অনেকে অপরাধী নেপাল ব্যবহার করে। কাঠমান্ডুর বিভিন্ন স্তরের পুলিশের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অপরাধী কাঠমান্ডু গিয়ে আত্মগোপন করে থাকে সেটিও তাদের বলে এসেছি।
“আমি মনে করি, নেপাল পুলিশ ও বাংলাদেশ পুলিশের আন্তরিকতা আরও বাড়বে। নেপালের কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশি অপরাধীরা গিয়ে ‘সেইফ হোম’ বানাবে এটি আর হবে না। এই বার্তা কাঠমান্ডু পুলিশকে আমরা দিয়েছি।”
সম্প্রতি ঢাকায় আনারকে হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা এডিসি শাহিদুর রহমানকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে। এরকম আলোচিত একটা মামলার শুরুতেই কর্মকর্তাকে কেন বদলি করা হল জানতে চাইলে হারুন বলেন, “বদলির বিষয়টি আমাদের পার্ট নয়। এটি পুলিশ সদরের রুটিন ওয়ার্ক।”
কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনসের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসের টুকরোগুলো এখনো ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়নি জানিয়ে হারুন অর রশীদ বলেন, “এমপি আনারের পরিবার যাবে কলকাতায়। এরপর ডিএনএ স্যাম্পল টেস্ট করার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।”