কারিগরিতে মেয়েদের পিছিয়ে থাকার জন্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
Published : 26 Apr 2023, 01:49 AM
পাঁচ দিন পর শুরু হতে যাওয়া এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় যারা অংশ নিতে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। তবে সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে তারা এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে।
এসএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আগামী ৩০ এপ্রিল। পরীক্ষা সামনে রেখে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ‘জাতীয় মনিটরিং ও আইন শৃঙ্খলা’ সংক্রান্ত কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির উপস্থাপিত তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে।
সেই তথ্যে দেখা যায়, এবছর এসএসসি ও সমমানে মোট ১১টি শিক্ষাবোর্ডে ২০ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নেবেন। যাদের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা ১০ লাখ ২১ হাজার ১৯৭ জন এবং ছাত্রী সংখ্যা ১০ লাখ ৫০ হাজার ৯৬৬ জন। অর্থাৎ, ছাত্রের তুলনায় ২ হাজার ৭৬৯ জন ছাত্রী বেশি অংশ নিচ্ছে।
গত বছরের সাথে তুলনা করলে এবছর মোট পরীক্ষার্থী বেড়েছে ৫০ হাজার ২৯৫ জন, যেখানে ছাত্রীর সংখ্যাই বেড়েছে ৩৮ হাজার ৬০৯ জন।
শিক্ষামন্ত্রী এই হিসাব টেনে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের এবছর যে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেড়েছে, তার ৮০ শতাংশই বেড়েছে ছাত্রীদের কারণে।”
সামগ্রিক হিসেবে ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার এই হিসাব স্পষ্ট নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে। সেখানে ছাত্র সংখ্যা ৭ লাখ ৭৯ হাজার ৮৭০ জন এবং ছাত্রী সংখ্যা ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪০৫ জন। অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে ছাত্রদের তুলনায় ৮৯ হাজার ৫৩৫ জন ছাত্রী বেশি অংশ নিচ্ছে।
দাখিলে বা মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ছাত্র অংশ নিচ্ছে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৩ জন এবং ছাত্রী অংশ নিচ্ছে ১ লাখ ৫১ হাজার ১২৮ জন। এখানেও ছাত্রীরা এগিয়ে ৭ হাজার ১৩৫ জন।
এই দুই বোর্ডের হিসাব মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষায় অগ্রগতির জানান দিলেও উল্টো চিত্র কারিগরি শিক্ষায়। এই বোর্ডে যেখানে ৯৭ হাজার ৩৩৪ জন ছাত্র পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে, সেখানে ছাত্রী সংখ্যা ৩০ হাজার ৪৩৩ জন।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, “এখানে ছাত্রী সংখ্যা অনেক কম। তিন ভাগের এক ভাগের চেয়েও কম।”
শিক্ষামন্ত্রী তথা সরকার যখন মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার উপর বেশি জোর দিচ্ছে, সেখানে এই উল্টো চিত্র কেন?
বিষয়টি বুঝতে জামালপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল হাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সমাজে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে মানুষের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতে আর্থিকভাবে দুর্বল যারা- তারা কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে এখানে আসে। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু অনেক মেয়েরা প্রায়োগিক শিক্ষা অর্জন করছে, মাঠে কাজ করছে।
“কিন্তু ভোকেশনাল নিয়ে আমাদের সমাজের চিন্তাটাই হচ্ছে- মেয়েরা হাতুড়ি-বাটাল, ড্রিল মেশিন নিয়ে মাঠেঘাটে কাজ করতে পারবে না। এই চিন্তা থেকেই মেয়েরা এই শিক্ষায় একটু কম আসে।”
সমাজে এই চিন্তা থাকলেও বাস্তবে মেয়েদের কারিগরি ক্ষেত্রে সফলতাই দেখছেন এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “বাস্তবতা ভিন্ন। আমার কলেজের অনেক মেয়ে আমি দেখেছি তাদের কিন্তু পারফরম্যান্স অনেক ভালো। খুব ভাল শিখছে, কাজ করছে।
“মেয়েরা এই কাজ পারবে না বা এই শিক্ষা নিতে পারবে না- এটা ভুল ধারণা। এই ভুল ধারণার জন্যই ভোকেশনালে মেয়ে শিক্ষার্থী কম।”
তবে কারিগরিতে মেয়েদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তিনি।
ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক তাসমিয়াহ রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারিগরি খাতের কাজ এখনও পুরুষদের দখলে। একটা এসি বা ফ্রিজ ঠিক করার পেশায় কোনো নারী যুক্ত হলে সেটা এখনও নিউজ হয়। তার মানে কী? নারীর অংশগ্রহণ এতটাই কম যে, সেটা নিউজ হওয়ার মতো বিষয়। অবচেতনে মানুষ এখনও মনে করে, কারিগরি বিষয়ক কাজ ছেলেদের জন্য। সে কারণে মেয়েদেরকে এই শিক্ষায় দিতে চায় না।
“চাকরির বাজারের প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন ছেলেরাও অন্য ক্ষেত্রে না যেতে পারলে কারিগরিতে আসে। মেয়েদের বেলায় কারিগরিতে আসার ক্ষেত্রে এই বাধাটা আরও বেশি। বাবা-মা যখন মেয়েকে পড়াতে চায়, তখন তারা চান, তাদের মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডারসহ পরিচিত খাতে চাকরি করুক।”
কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের পিছিয়ে থাকা কী বার্তা বহন করছে, সে জিজ্ঞাসা ছিল শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর দুটো দিক আছে। প্রথমত প্রান্তিক পর্যায়ে আমাদের যে মেয়েরা শিক্ষার্জন করে, তাদের পরিবারগুলো অনেক বিপন্ন। এ ধরনের শিক্ষায় তাই মেয়েদের পেছনে অনেক পরিবার বিনিয়োগ করতে চায় না। এই অর্থনৈতিক দিকটি সামাল দিতে ভোকেশনাল শিক্ষায় সরকার যদি মেয়েদের বৃত্তি দিত, ভালো থাকার ব্যবস্থা-হোস্টেলের ব্যবস্থা করত, ভালো খাবারের ব্যবস্থা থাকত; তাহলে কিন্তু মেয়েরা এদিকে আসতে পারত। ভালো মানের একটা বৃত্তি পেলে তারা পরিবারকে কিছু দিতে পারত।
“আরেকটি দিক হচ্ছে এ ধরনের শিক্ষায় আসতে গণিতে বা বিজ্ঞানে যে জ্ঞান লাগে, তা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে আমাদের মেয়েরা পায় না। একে তো শিক্ষকরা ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞানে ভালো পাঠদান করান না। আবার পরিবারগুলোও মেয়েদের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে জোর দিয়ে নজর দেয় না। সেই সাথে রক্ষণশীলতা তো আছেই। মেয়েরা কিন্তু বোঝা হতে চায় না, সেটা চায় না বলেই আমাদের মেয়েরা গার্মেন্টসে আসে। ভোকেশনাল শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়লে তাদের বসে থাকতে হত না। উপার্জন করতে পারত, উন্নত জীবন পেত, আবার সেই উপার্জন কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষায়ও বিনিয়োগ হত।”
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরীও কারিগরিতে মেয়েদের কম আসার কিছু কারণ চিহ্নিত করেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু লোকাল লেভেলে ডিমান্ড আর সাপ্লাইয়ের মধ্যে পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। এই বয়সের মেয়েদের জন্য যদি নারী প্রশিক্ষক থাকে, তবে বাবা মায়েরা নিরাপদ বোধ করেন মেয়েদের পাঠাতে।
“এটা হাতে-কলমে শিক্ষা, এখানে ল্যাব না থাকলে, প্রশিক্ষক না থাকলে মেয়েরা আসবে না। আবার বড় সমস্যা আবাসিক সুবিধা না থাকা। উপজেলা থেকে একটা মেয়ে জেলা শহরে কারিগরি শিক্ষা নিতে আসবে না যদি না তার আবাসিক সুবিধাটা থাকে।”
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মহসিনের কাছে ছাত্রীদের কম অংশগ্রহণ নিয়ে জানতে চাইলে তিনিও সমাজ বাস্তবতার বাধার কথাই তুলে ধরেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়েরা কারিগরি শিক্ষা নেবে- সমাজে এই মানসিকতা এখনও গড়ে ওঠেনি। সবাই ভাবে, মেয়েরা শিক্ষা নিলে সাধারণ ধারায় নেবে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে, বা মাস্টার্স ডিগ্রি করবে।”
নানা অঞ্চলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “পরিবার থেকে দূরে অনেক বাবা-মা মেয়েদের পাঠাতে নিরাপদ বোধ করে না। অনেক মেয়ে সুযোগ পেয়েও পড়তে আসে না।”
কারিগরি শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন সচিব।
তিনি বলেন, “ডিপ্লোমাতে যে মেয়েরা সুযোগ পাবে, তারা যেন নিজ নিজ এলাকার কলেজগুলোতে সিট পায়; সে লক্ষ্যে আমরা নীতিমালা সংশোধন করেছি। আবার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো ও ডুয়েটে যেন কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সিট বাড়ে সে লক্ষ্যেও আমরা কাজ করি। এগুলো হলে কারিগরি শিক্ষায় মেয়েরা ও তাদের অভিভাবকরা আগ্রহী হবে বলে প্রত্যাশা করছি।”