“দুই বছর আগেও যখন যাই, তখনও এইটা নষ্টই দেখলাম, এখনও তাই,” বললেন এক পথচারী।
Published : 24 Jun 2024, 09:19 AM
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন ফুটব্রিজে ভারি ব্যাগ কাঁধে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠলেন ঝিনাইদহের স্বপন; বিরক্ত স্বরে বললেন, চলন্ত সিঁড়িতে যদি পায়ে হেঁটেই উঠতে হয়, তাহলে এর দরকারটা কি!
বিমানবন্দর সংলগ্ন ব্যস্ত সড়ক পার হতে প্রতিদিন চলন্ত সিঁড়ির এই ফুটব্রিজটি ব্যবহার করেন হাজারো পথচারী। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলন্ত সিঁড়ি অচল থাকায় ভোগান্তিতে পড়ছেন তারা।
সিঁড়ি না চলায় পায়ে হেঁটেই ফুটব্রিজে উঠছেন পথচারীরা; কেউ আবার অচল সিঁড়ি দেখে ঝুঁকি নিয়েই পার হচ্ছেন রাস্তা।
শনিবার দুপুরে স্থানীয় চা-পান বিক্রেতা গোলাম গাউছ রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছিলেন, “প্রতিদিন বহুত মানুষ এয়ারপোর্টে আসে যায় গাট্টি-বোচকা লইয়া। হ্যারা এই চলন্ত সিঁড়ি বাইয়্যাই ওডানামা করে। অনেকে গালি-গালাজও করে।”
খুলনা থেকে আসা আবদুল্লাহ আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সৌদি আরব যাব। আর্থিক অবস্থা ভালো না, তাই গাড়ি রিজার্ভ করে আসতে পারি নাই। ব্যাগগুলা কাঁধে কইরা এই নষ্ট সিঁড়ি বাইয়্যা উঠতে খবর হইয়া গ্যাছে।”
তার ভাষ্য, “দুই বছর আগেও যখন যাই, তখনও এইটা নষ্টই দেখলাম। এখনও তাই। সবকিছু উন্নত হয়, এই সামান্য জিনিসটা ঠিক অয় না।”
বিমানবন্দর এলাকার চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজটি নিয়ে পথচারীদের ভোগান্তি দীর্ঘ দিনের। ঢাকার উত্তর সিটিতে এমন আরও দুটি ফুটব্রিজ আছে। একটি বনানী সৈনিক ক্লাব সংলগ্ন, আরেকটি যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে।
সৈনিক ক্লাব এলাকায় চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজটি দুপুর ১টা থেকে আড়াইটা এবং রাত ১০টার পর বন্ধ থাকার কথা থাকলেও প্রায়শই সেটি বন্ধ দেখা যায়। পথচারীরা বলছেন, অনেক সময় সেটি নষ্ট পড়ে থাকে। আবার মেরামতও করা হয়।
বনানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ইমরাউল রাফাত। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই এস্কেলেটরটা মাঝেমধ্যেই বন্ধ থাকে। নির্দিষ্ট টাইম ছাড়াও বন্ধ থাকে। অনেকসময় নষ্ট হয়, দুই একদিন পর আবার দেখি চালু। কেন হুটহাট বন্ধ হয়, বা কখন আবার মেরামত হয়, জানি না।”
বনানীর ফুটব্রিজটি ধরে নিয়মিত আসা–যাওয়া করেন বিদিশা আহমেদ। তার ভাষ্য, “এই এস্কেলেটরগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমি দুই বছর ধরে এদিক দিয়ে যাতায়াত করি চাকরিসূত্রে। মাঝেমধ্যে দেখি দুই-তিন দিন ধরেই বন্ধ।
“সিঁড়ি না চললে বেশ বিরক্ত লাগে ফুট ব্রিজ ব্যবহার করতে। দেখা গেল নিচে একসঙ্গে অনেক মানুষ পার হচ্ছে। তাদের সঙ্গে তখন আমিও পার হয়ে যাই। ফুটব্রিজে উঠিই না।”
যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে সানাউল হক নামের এক পথচারী বললেন, “এই ব্রিজের এস্কেলেটরগুলো প্রায় সময়ই নষ্ট হয়ে বন্ধ থাকে। বিড়ম্বনায় পড়ি তখন।”
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মী বলেন, “কখনো দেখি অফিস টাইমেই মেরামত চলে। মাঝেমধ্যে আবার এস্কেলেটরের মুখের গেট তালা লাগানো থাকে। তখন সিঁড়িগুলোতে মানুষের জট লেগে যায়।”
সৈনিক ক্লাব এলাকার চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজটি চালু হয় ২০১৪ সালে। সেসময় কেইস (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রজেক্ট) প্রকল্পের আওতায় ফুটব্রিজটিতে চলন্ত সিঁড়ি বসানো হয়। পরে তা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর দুই বছর পর ২০১৬ সালে বিমানবন্দর বাস স্টপেজে চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজ নির্মাণ করেন তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক। আর ২০২১ সালে চালু হয় যমুনা ফিউচার পার্ক সংলগ্ন ফুটব্রিজ।
এই তিনটি চলন্ত সিঁড়ির ফুটব্রিজ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকার উত্তর সিটি।
জানতে চাইলে সিটির প্রধান প্রকৌশলী মো. মঈন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের এস্কেলেটরটির বেল্ট চুরি হয়েছিল, সেটি আমরা কয়েকদিন আগে ঠিক করে দিয়েছি।
“আর বিমানবন্দরের সামনেরটার বিষয়ে আমি আসলে জানি না কী সমস্যা হয়েছে। আমি দুই তিন-দিনের মধ্যে জেনে জানাতে পারব।”
উঁচু ফুটব্রিজ বেয়ে উঠতে পথচারীদের সময় আর ভোগান্তি লাঘবে চলন্ত সিঁড়ি বসানো হলেও এখন দীর্ঘ সময় অচল পড়ে থাকার পেছনে দুর্বল ব্যবস্থাপনার কথা বলছেন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফুটব্রিজগুলো ভালো উদ্দেশ্যে হলেও এগুলো অচল বা ঘনঘন মেরামতের বিষয়টা এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের মেনটেইন্যান্স ও সুপারভিশন দুর্বল। এগুলোর পাইলটিং করে বোঝা গেল, এই উদ্যোগ ‘ব্যর্থ’।”
আদিল বলেন, “প্রথমত এগুলো স্থাপনের পর কেন যথাযথ মেরামত করা সম্ভব হল না, সেটি নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। আর যেহেতু ‘ব্যর্থ’ হয়েছে, এখন দেখতে হবে এগুলো ছাড়াই কীভাবে মানুষকে ফুটব্রিজ ব্যবহারে উৎসাহী করা যায়।
“এজন্য ফুটব্রিজগুলোর ডিজাইনে কার্যকর পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে মানুষ সেগুলো ব্যবহারে আগ্রহী হয়।”