ঢাকা মেডিকেলে মর্মান্তিক সব ‘গল্প’

স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়েছেন মহিউদ্দিন। তার কথাতেই মা মেয়ে কাচ্চি ভাইয়ে গিয়েছিল। এখন নিজেকে অপরাধী ভাবছেন মহিউদ্দিন।

গোলাম মর্তুজা অন্তুবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Feb 2024, 10:44 PM
Updated : 29 Feb 2024, 10:44 PM

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স ও ট্রাক ভর্তি মরদেহ নিয়ে যাওয়ার শোনা যায় মর্মন্তুদ বেশ কিছু গল্পের।

বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে আগুন লাগার পর ঢাকা মেডিকেলে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহত ও মরদেহগুলো নিয়ে যাওয়া হতে থাকে রাত ১২টার আগে থেকে।

রাত একটার পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল ফ্রিজিং ট্রাকে করে একসঙ্গে আনা হয় বেশ কটি মরদেহ।

তার আগেই যখনই কোনো গাড়ি হাসপাতালে এসেছে স্বজনদের বিষয়ে জানতে আসা মানুষজন সেগুলোর দিকে ছুটে গেছে।

ধীরে ধীরে নিশ্চিত হয়ে যায়, ঢাকা মেডিকেলে যাদেরকে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই মৃত।

সেখানে আরো বহু মানুষ একইভাবে তাদের স্বজনদের খোঁজে ঘুরছিলেন। তারা হাসপাতালের ফটকে এসে জিজ্ঞেস করছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিতদের। তারা যখনই মর্গ দেখিয়ে দিচ্ছেন, কান্নায় ভেঙে পড়ছেন একেক জন।

মালয়েশিয়ায় ফ্যাশন ডিজাইনিং এ পড়তেন রিয়া। শেষ সেমিস্টারের ছাত্রী। ফ্লাইট ছিল শনিবার। যাওয়ার দুই দিন আগে ভিকারুননেসা পড়ুয়া ছোট বোন আরিশা আর সিটি কলেজে পড়ুয়া খালাত বোন লিমুকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলেন সেই ভবনে।

রিয়ার বাবা কোরবান আলী ঢাকা মেডিকেলে পাগলের মত ঘুরছিলেন মেয়েদের খোঁজে। জরুরি বিভাগের মর্গে তিন বোনের লাশ দেখতে পাওয়ার পর তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ করছিলেন পোশাক কারখানার মালিক কোরবান। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি ছিল না।

ভিকারুন্নেসা স্কুলের শিক্ষক লুৎফুন নাহার ও তার মেয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ছাত্রী জান্নাতি তাজরীনের মরদেহ মর্গে খুঁজে পেলেন গৃহকর্তা গোলাম মহিউদ্দিন।

তিনি বলছিলেন, তার স্ত্রী দাঁতের ব্যথায় ভুগছিলেন। দাঁত দেখাতে হাসপাতালে যান মেয়েকে নিয়ে। ফেরার পথে কাচ্চি খেয়ে আসার পরামর্শ দেন মহিউদ্দিনই। এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। বিলাপ করে কাঁদছিলেন।

সারি সারি মরদেহের মধ্যে দুটি ছিল বুয়েটের দুই শিক্ষার্থী নাহিয়ান ও লামিসা ইসলামের। লামিসার বাবা পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি।

বন্ধুরা খুঁজে পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন এমবিএর ছাত্র নুরুল ইসলামের লাশ। কাঁদতে কাঁদতে তারা ছোটাছুটি করছিলেন, চেষ্টা করছিলেন রাতের মধ্যে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে।

কাঁদতে কাঁদতে বন্ধুদের কাছে ভর দিয়ে হাসপাতালে ঢুকছিলেন এক তরুণ। ঢোকার মুখেই আর এক বন্ধুর কাছে শুনলেন প্রিয়জনটি শুয়ে আছে মর্গে। সেটি শুনে মেঝেতেই লুটিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন তিনি।

রাত একটা ২৪ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল প্রাঙ্গণে আসে বিরাট এক কাভার্ড ভ্যান। ফায়ার সার্ভিসের এই রেফ্রিজারেটর স্টোরেজ ট্রাকটি দেখে স্বজনদের আর বুঝতে বাকি থাকে না এর ভেতরে রয়েছে কেবলই লাশ। ট্রাক থেকে নামানো হয় একে একে দশটি মরদেহ। শুরু হয় উচ্চশব্দে কান্না। ট্রাকের ভেতরের মানুষরা যাদের কাছের মানুষ নন, তাদেরকেও চোখ মুছতে দেখা গেল।