অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, “আদিবাসীদের দিনের পর দিন স্বীকৃতি না দিয়ে এখন অদৃশ্য করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে”
Published : 10 Oct 2022, 10:08 PM
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেছেন, কোনো স্বর্গ তারা চাইছেন না, শুধু নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ বন্ধ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছেন।
সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত ‘আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, “আমরা আদিবাসীরা কোনো স্বর্গ দাবি করছি না আমাদের জন্য, আমরা শুধু আমাদের মানবিক অধিকার চাই, আমাদের ভূমির ওপর আমাদের অধিকার চাই।”
প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ভারতেও আদিবাসীদের জন্য আদিবাসী নীতি এবং ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এসেও দেশে আদিবাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।”
আগামী দিনে আদিবাসী-বাঙালি সবাই মিলে আদিবাসীদের ভূমি অধিকার আদায়ে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সঞ্জীব বলেন, “আমাদের অধিকারের কথা সবাইকে নিয়েই বলতে হবে। বাঙালিদের মধ্যে যারা সচেতন আছেন, মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা আমাদের পাশে থাকবেন। আমরা সকলে মিলেই আমাদের দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলব।”
আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, “আদিবাসীদের দিনের পর দিন স্বীকৃতি না দিয়ে এখন অদৃশ্য করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। মিডিয়াতেও আদিবাসীরা আর দৃশ্যমান নাই। এই অবস্থাকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে।”
তিনি বলেন, “১৫-২০ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় থেকে পাহাড়ে বসবাসরত সেটলারদের লিস্ট করা হয়েছিল, যেখানে দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা বাতিল করে সেখানকার জমির মালিকদের ফিরিয়ে দিলেই পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যায়।”
বেসরকারি সংস্থা বেলার নির্বাহী পরিচালক রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমাদের লড়াই করতে হবে এবং পাড়তে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাবো? শপিংমল, পার্ক দিয়ে যাব? তাদের জন্য বন, নদী, পাহাড় দিয়ে যেতে হবে তা আমাদের বুঝতে হবে।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের উদ্দেশে রিজওয়ানা বলেন, “আপনারা আপনাদের সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে দাবি তোলেন। সমতল, পাহাড় আলাদা না করে একসাথে দাবি তুলতে হবে। প্রথাগত হওয়ার কারণে আপনাদের জমির কাগজ নাই, আপনারা আপনাদের সপক্ষে কাগজ তৈরি করে দেওয়ার দাবি তোলেন। আপনাদের পক্ষে যে আইন আছে, তা যত দুর্বল হোক, তা বাস্তবায়নের দাবি তোলেন, সকলের সাথে সংযোগ করেন।”
লেখক ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, “৭১-এ যে রাষ্ট্র হয়েছে, তা সবার হয়ে ওঠেনি। হয়েছে বাংলা ভাষাভাষীদের, আবার সাংবিধানিকভাবে সংখ্যাগুরু বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্র হয়েছে। আমাদেরকে দেশটা, রাষ্ট্রটা সবার করে তুলতে হবে।
“আমরা দেখেছি পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি কমিশন হয়েছে প্রায় দুই দশক হয়ে গেছে, কিন্তু একটিও ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারেনি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পুঁজির সর্বগ্রাসী রূপান্তরের ফলে ভূমির ওপর এই আগ্রাসন চলছে। সেটা কেবল আদিবাসী নয়, বাঙালিদের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। বহুজাতির দেশ হওয়া সত্ত্বেও আদিবাসীদের ওপর ও তাদের ভূমির ওপর এই আগ্রাসন জারি রয়েছে।”
আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং বলেন, “এই দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে গাড়িতে পতাকা ওড়ায়। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবন বাঁচাতে দেশান্তরি হয়েছেন, তাদের ভূমি প্রতিনিয়ত কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আলফ্রেড সরেন, নরেন্দ্র মুণ্ডাকে মেরে ফেলা হল, তার কোনো বিচার আমরা পাইনি।”
সভায় মূল বক্তব্য পড়েন হেলেনা তালাং। কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সঞ্চালনায় সভায় অন্যদের মধ্যে আদিবাসী নারী নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব চঞ্চনা চাকমা, ইউসিজিএমের সহসভাপতি অজয় এ মৃ, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেকসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।